গত কয়েক বছর ধরে বাঙলার রাজনীতিতে আলোড়ন ফেলা শিক্ষক দুর্নীতি নিয়োগের রায়ে আরও একবার জোর ধাক্কার সামনে রাজ্য সরকার। আদালতের আজকের রায়ে প্রমাণ হয়ে গেল এই নিয়োগে সার্বিকভাবে দুর্নীতি হয়েছিল। যে অভিযোগ বহু দিন ধরে করে আসছিলেন রাজ্যের বিরোধীরা। সারদা, নারদ কেলেঙ্কারি পেরিয়ে আসা রাজ্যে এত বড় আর্থ সামাজিক বিপর্যয়ের উদাহরণ খুব কমই আছে।
কলকাতা হাইকোর্টের নির্দেশে এদিন বাতিল হয়ে গেল ২০১৬ সালের সম্পূর্ণ নিয়োগ প্রক্রিয়া এবং চাকরি হারালেন প্রায় ২৬ হাজার জন। দেশে অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচন পর্ব চলাকালীন আদালতের এই রায় রাজ্য সরকারের অস্বস্তি যে অনেকটাই বাড়ালো তাতে সন্দেহ নেই। তবে এদিনের রায় থেকে এটাও প্রমাণ হয়ে গেল যে রাজ্যের এসএসসি নিয়োগে লাগামছাড়া দুর্নীতি হয়েছিল। পাশাপাশি স্বচ্ছ নিয়োগের দাবিতে ১১৩৫ দিন ধরে যে সব চাকরিপ্রার্থীরা আন্দোলন করে যাচ্ছেন তাঁরা কিছুটা হলেও স্বস্তি পেলেন।
স্বভাবতই প্রশ্ন উঠবে সীমাহীন এই দুর্নীতি দায় কার? রাজ্য সরকার, এসএসসি, রাজ্যের ক্ষমতাসীন দল – কেউই বোধহয় এই দায় অস্বীকার করতে পারে না। কারণ বিরোধীরা বহুদিন ধরে অভিযোগ করেছে যে শাসক দলের অঙ্গুলি হেলনে মোটা মোটা টাকার বিনিময়ে বহু চাকরি হয়েছে। বহু অযোগ্য প্রার্থী যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে টাকার বিনিময়ে চাকরি পেয়েছেন।
এক্ষেত্রে এই সার্বিক দুর্নীতির জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ, বেশ কিছু নেতা-মন্ত্রী, শাসকদলের কর্মী, শিক্ষা দপ্তরের আধিকারিকরা যেমন দায়ী, তেমনই যারা টাকার বিনিময়ে অন্যকে বঞ্চিত করে এতদিন ঘাপটি মেরে চাকরি করছিলেন তাদের কেউই কম দায়ী নন। কারণ অযোগ্য সেই প্রার্থীরা চাকরি পাবার জন্য কোনও আধিকারিক, কোনও নেতা অথবা কোনও মন্ত্রীকে ধরেছিলেন, টাকা দিয়েছিলেন এবং বিনিময়ে ঘুরপথে, যোগ্য প্রার্থীদের বঞ্চিত করে তাদের চাকরির ব্যবস্থা করা হয়েছিল।
আদালত এদিন জানিয়েছে, মোট ১৭ রকমের দুর্নীতি হয়েছিল। যার মধ্যে ওএমআর শিট জালিয়াতি আছে, মেধাতালিকায় অদল বদল ঘটানো সহ নানারকম বিষয় আছে। এই নিয়োগ দুর্নীতি যে শাসকদলের মদতে, সুপরিকল্পিতভাবে করা হয়েছিল তা এখন দিনের আলোর মত পরিষ্কার।
রাজ্য বিগত সময়ে বন্ধ ফ্ল্যাট থেকে টাকা উদ্ধার দেখেছে, খাটের তলা থেকে টাকা উদ্ধার দেখেছে। শাসকদল ঘনিষ্ঠদের বাড়ি থেকে বান্ডিল করে রাখা কোটি কোটি টাকা উদ্ধার দেখে নড়েচড়ে বসেছিল রাজ্যবাসী। রাতারাতি গ্রেপ্তার হয়েছিলেন রাজ্যের প্রাক্তন শিক্ষামন্ত্রী থেকে শাসকদলের একাধিক নেতা, বিধায়ক এবং বেশকিছু আধিকারিক। আজকের রায়ের পরে পুরো বিষয়টার সঙ্গে শাসকদলের যোগসাজোশ আরও অনেকটাই স্পষ্ট হয়ে গেল।
কিন্তু এরপরেও কিছু কথা থাকে। যে কথা না বললে কিছু মানুষের সঙ্গে অবিচার করা হয়। এদিন আদালতের রায়ে যতজনের চাকরি বাতিল হয়ে গেল তাঁরা সবাই কি বেআইনি পথে, দুর্নীতি করে চাকরি পেয়েছিলেন? বোধহয় না। এদের মধ্যেও অবশ্যই বেশ কিছু যোগ্য প্রার্থী নিশ্চই আছেন। যারা যোগ্যতার নিরিখেই চাকরি পেয়েছিলেন। এই রায়ের ফলে সেই যোগ্য প্রার্থীদেরও সাময়িক সমস্যায় পড়তে হবে। তাদের কোনও ভুল না থাকা সত্ত্বেও সামাজিকভাবেও তাঁরা বেশ কিছুটা সমস্যায় পড়বেন। যা কোনোভাবেই কাম্য নয়।
যদিও আশার কথা, আদালত জানিয়েছে, সমস্ত ওএমআর শিট পুনঃমূল্যায়ন করে নতুন করে প্যানেল তৈরি করতে হবে এবং সেই ক্ষেত্রে যোগ্য প্রার্থীরা অবশ্যই স্বাভাবিকভাবেই ফের প্যানেলে জায়গা পাবেন। সেই প্রক্রিয়া দ্রুত হোক। কোনোভাবেই যেন একজন যোগ্য প্রার্থীও চাকরি থেকে বঞ্চিত না হন। দুর্নীতির পাঁকে আকন্ঠ ডুবে যাওয়া রাজ্যের এক সামান্য অধিবাসী হিসেবে আপাতত সেটুকুই চাওয়া।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন