গোটা পশ্চিমবঙ্গের মানুষের কাছে কলকাতা শহরের সিনেমা হল বললে প্রথম যে কয়েকটি নাম মনে আসে তার মধ্যে একটি ‘নন্দন’, সত্যজিৎ রায় যার নামকরণ করেছিলেন। অথচ সেই নন্দনেই জায়গা পেল না তাঁর জীবনভিত্তিক ছবি 'অপরাজিত'। এই ঘটনা ঘিরে ক্ষোভ তৈরি হয়েছে সিনে-প্রেমী মানুষদের মধ্যে।
আজ শুক্রবার, প্রেক্ষাগৃহে নতুন ছবি মুক্তির দিন। আজ অন্যান্য ছবির পাশাপাশি রিলিজ় করেছে ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ খ্যাত পরিচালক অনীক দত্তের বহুল চর্চিত নতুন ছবি ‘অপরাজিত’। প্রবাদপ্রতিম পরিচালক সত্যজিত রায়ের কালজয়ী ছবি ‘পথের পাঁচালি’ বানানোর নেপথ্যের কাহিনীর ওপর আধারিত এই ছবি।
শহর কলকাতার সিনে-প্রেমী মানুষদের অন্যতম আখড়া হল নন্দন। আচার্য জগদীশ চন্দ্র বোস রোড ও ক্যাথিড্রাল রোডের সংযোগস্থলে অবস্থিত পশ্চিমবঙ্গ ফিল্ম সেন্টার – নন্দন। ১৯৮৫ সালে এই প্রেক্ষাগৃহের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন সত্যজিত স্বয়ং। এছাড়াও আজকের এই অত্যাধুনিক প্রেক্ষাগৃহ নন্দনের ভিতরের থিয়েটারের ডিজাইন, বাইরের নামাঙ্কন, এমনকি ‘নন্দন’ নামকরণের পিছনে যাঁর নাম ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে, তিনি সত্যজিত রায়। তাঁর ব্যক্তিগত উদ্যোগ, পরামর্শ ও সহযোগিতায় তৎকালীন বাম সরকার প্রতিষ্ঠা করেছিল এই প্রেক্ষাগৃহ। কিন্তু সেই সত্যজিতের জীবন আধারিত ছবি ‘অপরাজিত’ জায়গা পেল না তাঁর ‘নন্দন’-এ।
ইতিপূর্বে ‘ভবিষ্যতের ভূত’ ছবির মুক্তির সময়ও এমনই সমস্যায় পড়তে হয়েছিল পরিচালক অনীককে। সূত্রের খবর ‘নন্দন’ এবং টালিগঞ্জের ‘রাধা’ প্রেক্ষাগৃহে দেখানো হচ্ছে না ‘অপরাজিত’ ছবিটি। যদিও শহর ও শহরতলীর বেশ কিছু মাল্টিপ্লেক্স ও অল্প সংখ্যক সিঙ্গেল স্ক্রিনে আজ রিলিজ় করছে এই ছবি।
এই প্রসঙ্গে এক সংবাদমাধ্যমে পরিচালক অনীক দত্ত জানিয়েছেন, 'ছবিটা দেখার জন্য বহুদিন দর্শকের প্রতীক্ষা ছিল। বর্তমান সময়েও সকলের পক্ষে মাল্টিপ্লেক্সে গিয়ে ছবি দেখা সম্ভব নয়। তাই নন্দন বা শহরের অন্যান্য সিঙ্গল স্ক্রিনগুলিতে ছবিটি দেখানো হলে, অনেক মানুষের কাছে পৌঁছতে পারত এই ছবি।' তিনি আরও বলেন, ‘আমার ছবির দর্শক নন্দনে ছবি দেখতে পছন্দ করেন। ছবিটি নন্দনে তোলা হয়নি বলে হতাশ হয়েছে দর্শককুল।’
কিছুদিন আগে সিটি কলেজে ছবির প্রচারে গিয়েছিলেন ছবির কলাকুশলীরা। এ-বিষয়ে পরিচালক বলেন, ‘পড়ুয়ারা সেখানে আমার কাছে অতি উৎসাহের সঙ্গে জানতে চেয়েছিলেন, ছবিটি নন্দনে আসছে কি না? আমি বেশ কয়েক দিন ধরেই শুনছিলাম, ছবিটি নন্দনে দেখানো না হতেও পারে। তাই ওঁদের প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারিনি। নন্দনে ছবিটি দেখানো হলে অবশ্যই ভাল হত। শুধু তো শহর নয়, শহরতলির দর্শকেরাও ছবি দেখতে আসেন নন্দনে।’
পরিচালক অনীক দত্ত বরাবরই তাঁর ‘সিনেমার ভাষা’ নিয়ে আলোচনায় থাকেন। ‘ভূতের ভবিষ্যৎ’ হোক বা ‘ভবিষ্যতের ভূত’ অথবা ‘আশ্চর্য প্রদীপ’, তাঁর ছবির ভাষা আধুনিক এবং তা মাঝে মধ্যেই অস্বস্তিতে ফেলে শাসকদলকে। অনীকের সাম্প্রতিক ছবিকে নন্দনে না দেখানোর পিছনে কি কোন রাজনৈতিক কারণ রয়েছে? এ বিষয়ে এখনও স্পষ্ট করে কিছু বলেননি পরিচালক। কিন্তু নন্দনে হল না পাওয়ার ঘটনায় যথেষ্ট আক্ষেপ রয়েছে পরিচালকের। ছবির প্রযোজনা সংস্থা ফ্রেন্ডস কমিউনিকেশনস সরকারি মহলের সঙ্গে বিষয়টি নিয়ে আলোচনায় বসবে বলে জানিয়েছেন।
এই মুহূর্তে নন্দনে যে ছবিগুলি চলছে সেগুলি হল – দেবের ছবি ‘কিসমিস’, সোহমের ছবি ‘কলকাতার হ্যারি’ ও মিমির ছবি ‘মিনি’। প্রসঙ্গত, এই তিনজন অভিনেতার সাথে শাসকদলের প্রত্যক্ষ যোগাযোগ রয়েছে। দেব ও মিমি রাজ্যের শাসকদলের সাংসদ সদস্য ও সোহম বিধানসভার সদস্য। অন্যদিকে, ‘অপরাজিত’র গায়ে শাসক দলের কোনও ছোঁয়া নেই। আর অনীক তাঁর আগের ছবির রিলিজের মঞ্চ থেকে সরাসরি আক্রমণ করেছিলেন মুখ্যমন্ত্রীকে। অপরাজিতের নন্দন-রিলিজ় আটকে যাওয়ার পিছনে সেই ঘটনার কোনো যোগাযোগ রয়েছে কিনা তা এখনও স্পষ্ট হয়নি। তবে তৃণমূল নেত্রী তথা অভিনেত্রী সায়নী ঘোষ ফেসবুকে 'অপারাজিত' নিয়ে দীর্ঘ পোস্ট করলেও নন্দনে জায়গা না পাওয়া নিয়ে কোনও মন্তব্য করেননি।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন