একটু দেরিতে হলেও অপরাজিত দেখলাম। বিভিন্ন জায়গায় এই নিয়ে লেখা চোখেও পড়েছে। কানায় কানায় ভর্তি প্রায় সমস্ত শো। বেরোনোর সময় প্রায় সবারই মুখে পরিতৃপ্তি। এটা অবশ্যই ছবির সাফল্য। ছবি দেখে আমার অনেকবার সত্যজিৎ রায়ের লেখা Our Film Their Film এর কথা মনে হচ্ছিলো। বইয়ের কিছু বক্তব্য এখানে পর্দায় এনে ফেলেছেন পরিচালক। এই ধরণের বাংলা ছবির বাণিজ্যিক সাফল্যের দিক থেকে দেখলে এই ছবি হয়তো ইতিহাস তৈরী করতে পারে। রবীন্দ্রনাথের পর বাঙালির সত্যজিৎ মুগ্ধতা সর্বজনবিদিত। পরিচালক অনীক দত্ত অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সাথে সঠিক সময়ে সঠিক একটা বিষয় নির্বাচন করেছেন, তা টিকিট কাউন্টার বা হলে ঢোকার লাইন দেখলেই স্পষ্ট।
অনীক দত্ত এবং উৎসব মুখোপাধ্যায়ের জুটি গল্প বলার সময় সবসময়েই একটা সুন্দর বুনন উপহার দেন। এক্ষেত্রেও এক লেজেন্ডারি পরিচালকের এক লেজেন্ডারি সিনেমা বানানোর যাবতীয় খুঁটিনাটি, ওঠাপড়া অত্যন্ত সুকৌশলে বুনে দেওয়া আছে মাকড়শার জালের মত। এই ছবির পরতে পরতে নস্টালজিয়া ভরপুর। নস্টালজিয়া প্রিয় সাধারণ বাঙালি দর্শক তাই সহজেই সেই জালে জড়িয়ে পড়ছেন। এখানেই তারা বাজিমাত করেছেন।
ছবিতে সত্যজিৎ রায়ের ভূমিকায় জিতু কামাল অসামান্য। হাঁটা, কথা বলা, বসা, তাকানো কখনোই মনে হয়েনি এটা জিতু কামাল। অভিনেতা হিসাবে তার হোমওয়ার্ক অসাধারণ। একই সাথে এক্ষেত্রে বলতেই হয় চন্দ্রাশীষ রায়, যিনি ডাব করেছেন তার কথাও। এদের দুজনের অভিনয়ই অসম্ভব ভালো। যে সোমনাথ কুন্ডুর (যিনি এই সিনেমার মেক-আপ করেছেন) দক্ষতায় আমরা সত্যজিৎ রায়কে ফিরে পাই তাঁরও এক্ষেত্রে অভিনন্দন প্রাপ্য। ছবিতে ব্যবহার করা পোষাকের ক্ষেত্রেও শুচিস্মিতা দাসগুপ্ত একটা রিসার্চ করেছেন বলেই স্পষ্ট আভাস পাওয়া যায়।
চলচ্চিত্রে সংগীতের ব্যবহারও বেশ ভালো। দেবজ্যোতি মিশ্রর করা অর্ক মুখার্জির গাওয়া 'আমাদের পাঁচালি' গান ইতিমধ্যেই মানুষের মন ছুঁয়ে গেছে। আরেকটা মজাদার বিষয় হলো, সত্যজিৎ রায় নিজে যেরকম বেশিরভাগ সময়ই নতুনদের সুযোগ দিতেন, তার ওপর তৈরী ছবিতেও কোনো তথাকথিত তারকা কিম্বা বাজার চলতি বাণিজ্যিক ফর্মুলা ব্যবহার না করেও পরিচালক প্রমাণ করে দিয়েছেন যে একটা ছবিকে হিট করানো যায়।
কিন্তু ব্যস, এতটাই। আর কিছু খুব ভালোলাগার জায়গা পেলাম না সিনেমাটায়। সিনেমায় একটা দারুণ দৃশ্য যা মন ছুঁয়ে গেলো, তা বলতে গেলেও পথের পাঁচালী সিনেমার অনুকরণ করা দৃশ্যর কথা বলতে হয়। সুতরাং প্রশ্ন আসে ১৯৫৫ সালে যে মাস্টারপিস একজন বানিয়ে গেছেন ২০২২ সালে তার অনুকরণ আমি কেন দেখবো? শুধুই বায়োপিক মনে করে! ওয়াল্ড মুভি বা বিশ্ব চলচ্চিত্রে বাংলা সিনেমার পিছিয়ে পড়ার কারণ কি তবে সত্যজিৎ, ঋত্বিক বা মৃণালকে অতিক্রম করতে না পারা! তাদের দেখানো রাস্তায় হাঁটতে গিয়ে সেই গোলকধাঁধাতেই আটকে পড়ছিনা তো আমরা! একজন সিনেমাপ্রেমী হিসাবে মাথায় গ্রামার বই নিয়ে ছবি দেখতে বসে নস্টালজিক জালের বাইরে থাকলে এই ধরণের প্রশ্ন মাথায় ঘুরতে শুরু করে।'
তবে, সত্যজিৎ রায়ের সময় নতুন পরিচালককে যেমন সিনেমা করতে গেলে হিমশিম খেতে হত প্রোডিউসারের জন্য, আজও তার কোনরকমই উন্নতি হয়নি। অবস্থাটা একই। বলা যায় আরও করুণ। আবার, সত্যজিৎ রায়কে নিয়ে তৈরি এই ছবি প্রথম সপ্তাহে ১ কোটি ৮৬ লাখ টাকার ব্যবসা করেছে। এটা বাংলা সিনেমার জন্য অবশ্যই একটা সুসংবাদ। অপরাজিত যে জয়ী হয়েছে সেটা বাংলা ইন্ডাস্ট্রির স্বাস্থ্যের জন্য খুবই প্রয়োজনীয়। পরিচালক সহ এই ছবির প্রযোজক এবং যে সমস্ত কলাকুশলীরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন তাঁদের প্রত্যেককে আন্তরিক অভিনন্দন। শেষে একটাই কথা। আমার কাছে এখনও পর্যন্ত ‘ভূতের ভবিষ্যত'ই অনীক দত্তর মাস্টারপিস।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন