ঘামে ভেজা কালো পোলো টি-শার্ট, ডেনিম প্যান্ট, একহাতে মাইক্রোফোন আর একহাতের আঙুলের নিশানায় শ্রোতার-স্রোত। ঘর্মাক্ত হাসি মুখ, আলুথালু চুলের এই শিল্পীকে গতকাল দক্ষিণ কলকাতার নজরুল মঞ্চে শেষবারের মতো গাইতে শোনা গেল। পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে গান গেয়ে মন জয় করা, ৫৩ বছর বয়সী এই শিল্পী জীবনের শেষ গান গাইলেন সিটি অফ জয়, কলকাতায়।
মালয়ালি পরিবারের সন্তান কৃষ্ণকুমার কুন্নাথের ছোট থেকে বেড়ে ওঠা দিল্লিতে। দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের কিরোরী মল কলেজ থেকে গ্র্যাজুয়েট হবার পর, কয়েকমাস মার্কেটিং-এ কাজ করে, অন্যান্য মধ্যবিত্ত স্ট্রাগলারদের মতো কৃষ্ণকুমারও পাড়ি দেন স্বপ্নের নগরী মুম্বাইতে। তখন যদিও ‘বোম্বে’ ছিল এই শহরের নাম। গান গাইতে ভালবাসতেন, তাই গেয়েই নিজেকে প্রতিষ্ঠা করবেন এই ছিল স্বপ্ন। খুবই সাধারণ একটা স্বপ্ন নিয়ে বোম্বে পৌঁছেছিলেন এই সাধারণ ছেলেটি। কিন্তু অল্প কিছুদিনেই মধ্যেই তাঁকে অসাধারণত্বে পৌঁছে দেয় তাঁর গলা। কখনও কোন প্রথাগত পদ্ধতিতে গানের তালিম নেননি কৃষ্ণকুমার।
জিঙ্গেল (বিজ্ঞাপনের জন্য তৈরি ছোট ছোট গান) গেয়ে রেকর্ডিং-এর দুনিয়ায় পা রাখেন কৃষ্ণকুমার। বলিউডের সুরকার, লেসলী লেউইস তাঁকে দিয়ে প্রথম জিঙ্গেল রেকর্ড করান। ১১টি আলাদা ভাষায় প্রায় ৩৫০০ জিঙ্গেল গেয়েছেন প্লে-ব্যাক গানের জগতে আসার আগে তিনি। সাধারণভাবে জিঙ্গেল গাইয়েদের চেনার সুযোগ থাকে না, তবে তাঁর গলা বেশিদিন তাঁকে অলক্ষ্যে রাখেনি। নজরে পড়েন প্রখ্যাত সঙ্গীত পরিচালক এ.আর রহমানের। ১৯৯৬ সালে ‘কাঢাল দেসম’ বা দুনিয়া দিলওয়ালে কি (হিন্দি ভার্সন) নামে একটি তামিল ছবির জন্য কৃষ্ণকুমার কুন্নাথের গলায় দুটি গান রেকর্ড হয় প্রথমবারের জন্য। এই রেকর্ডিং-এ তাঁর সহশিল্পী ছিলেন পদ্মশ্রী হরিহরণ। ওই বছরই গুলজারের ছবি ‘মাচিস’-এর জন্যও গান রেকর্ড করেন। বিশাল ভরদ্বাজের সুরে ‘ছোড় আয়ে হাম’ এই গানটি রেকর্ডিং-এর পর সারাভারত আবিষ্কার করে এক নতুন গায়কীকে।
কৃষ্ণকুমার হয়ে ওঠেন কে কে। বলিউড পায় এক নতুন আওয়াজ। যে আওয়াজের ওপর ভর করে বলিউড পাড়ি দেয় নতুন সুরের দরবারে। ১৯৯৯ সালে বলিউড ছবি ‘হাম দিল দে চুকে সনম’-এ প্লেব্যাক গায়ক হিসাবে প্রথম আত্মপ্রকাশ কে কে’র। এই ছবির ‘তড়প তড়প কে ইস দিল’ গানটি ঝড়ের গতিতে জনপ্রিয় হয়। এই বছরই তাঁর প্রথম অ্যালবাম ‘পল’ (সময়)–এ সুর দেন বন্ধু লেসলী লেউইস। এই অ্যালবামের ৮টি গানই খুব জনপ্রিয় হয়। মুক্তির পর দেশের নতুন প্রজন্মের ঠোঁটে ঠোঁটে ছড়িয়ে ‘পল’ আর ‘ইয়ারো’ গান দুটি। বলিউডে কে কে’র হাত ধরে জন্ম নেয় নতুন এক সঙ্গীত ঘরানা ‘ইন্ডি-পপ’।
হিন্দি, বাংলা, তামিল, তেলেগু, কান্নাড়া, মালায়লাম, মারাঠি, গুজরাটি ও অন্যান্য ভাষাতেও গান গেয়েছেন এই শিল্পী। ৫০০ এরও বেশি হিন্দি গানে গলা দিয়েছেন তিনি। হিন্দি ছাড়া অন্য ভাষার গান মিলিয়ে তাঁর ডিস্কোগ্রাফিতে গানের সংখ্যা ১২০০ এরও বেশি। সিনেমার গানের পাশাপাশি টেলিভিশন, মিউজিক শো-তেও গেয়েছেন তিনি। প্রথম অ্যালবামে মুক্তির ৮ বছর বাদে মুক্তি পায় দ্বিতীয় অ্যালবাম ‘হামসফর’ (সাথী)। এই অ্যালবামের গানগুলিতে তিনি নিজেই সুর দেন। বলিউডের এমন কোন সঙ্গীত পরিচালক নেই যিনি, কে কে’র সাথে কাজ করেননি। এ. আর রহমান থেকে শুরু করে গুলজার, বিশাল ভরদ্বাজ, অনু মালিক, প্রীতম, সেলিম-সুলেমন, রশিদ খান, শান্তনু মৈত্র, জিৎ গাঙ্গুলি - এঁরা সকলেই কে কে’র সাথে কাজ করেছেন। ২৮ বছরের বলিউড কর্মজীবনে অনেক চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে নিজের পাকাপোক্ত জায়গা করে নিয়েছিলেন ৫৩ বছরের এই শিল্পী। তবে ৫৩ তেই থেমে গেল সেই যাত্রা। আমরা হারালাম কৃষ্ণকুমার কুন্নাথকে।
শিল্পীর জীবন বোধহয় এরমই হয়। কলেজ ফেস্টে কলকাতায় গান গাইতে এসেছিলেন তিনি। আর মুম্বাই ফেরা হল না তাঁর। নজরুল মঞ্চের স্টেজে অনুষ্ঠানের শেষে গাইলেন ‘হম রহেঁ ইয়া না রহেঁ কল, কল ইয়াদ আয়েঙ্গে ইয়ে পল’। হোটেলে ফিরে এলেন। তারপর নিঃশব্দে চলে গেলেন সুরের দেশে। জীবন কত আকস্মিক হতে পারে এই ঘটনা আরও একবার তা মনে করিয়ে দিল। স্টেজে যে মানুষটা ৭০০০ দর্শককে মাতিয়ে রাখল, তিনি ঘরে ফিরে একা একা চলে গেলেন। রেখে গেলেন স্মৃতিটুকু।
৯০এর প্রজন্মের কাছে কে কে’র গাওয়া এই গানগুলি একটি অনুভূতি সমান। সদ্য শেখা নতুন গিটারে ‘ইয়ারো দোস্তি’ সহজেই তুলে কলেজের ছেলে-মেয়েরা যেমন তাঁর গান গেয়ে ফেলতে পারতেন, তেমনই প্রত্যাখিত প্রেমিক, ঘরফিরতি ক্লান্ত যাত্রী, নেসাতুর রাতের ডিপ্রেসডদের প্লে-লিস্টে জায়গা করে নিয়েছিলেন কে কে, তাঁর সুরের জাদুতে। শিল্পী হয়তো এরকমই হয়। তাঁর শিল্পে একটা নিজস্ব জাদু থাকে। সেই জাদু আসলে ডাইমেনশনের। আজকের প্রজন্ম যেখানে থ্রি-ডি, ফোর-ডি তে পৌঁছে গেছে, সেখানে গানকে কিভাবে বিভিন্নভাবে আলাদা আলাদা ডাইমেনশনে উপস্থাপন করা হবে তা নিয়ে বিস্তর কাজ করেছেন এই শিল্পী। তাঁর গাওয়া গানগুলি একটি অপরটির থেকে আলাদা, কিভাবে গান নিয়ে প্রতিনিয়ত এক্সপেরিমেন্ট করা যায় তা কিভাবে নতুনদের কাছে পৌঁছে যায় তা খেয়াল রাখতেন কে কে।
পরিশেষে, কলকাতা তাঁকে গাইতে দেখল শেষবারের মতো। দিল্লিতে জন্ম এই শিল্পীর জীবনাবসান হল মহানগরী কলকাতায়। ভক্তদের উদ্দেশ্যে দিয়ে গেছেন অসংখ্য গান, যা থেকে যাবে আগামীতেও। কে কে থাকুক স্মৃতিতে, কে কে থাকুক ফোন-গ্যালারীতে, কে কে থাকুক শান্ত ক্যাফেতে, কে কে থাকুক দুপুরের অবসাদে, কে কে থাকুক আগামীতে, শান্তিতে, না ফেরার দেশে। আলভিদা কে কে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন