অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়ায় আসক্তির ফলে বিঘ্নিত হচ্ছে মানসিক ভারসাম্য। এমনটাই বলছেন চিকিৎসক এবং মনোবিজ্ঞানীরা। সম্প্রতি, এমনই এক ঘটনার শিকার হয়েছেন ঝাড়খণ্ডের ১৮ বছর বয়সী এক তরুণ।
মানসিক চিকিৎসার জন্য রাঁচির কাঙ্কে সেন্ট্রাল ইনস্টিটিউট অফ সাইকিয়াট্রিতে (সিআইপি) ওই যুবককে নিয়ে গিয়েছিল তাঁর বাড়ির লোক। পরিবারের সদস্যদের দাবি, গত দুই মাস থেকে কলেজে যাচ্ছেন না তিনি। বাড়ি থেকে বের হতে ভয় পাচ্ছেন এবং গত ৪-৫ দিন ধরে খাওয়া-দাওয়া বন্ধ করে দিয়েছেন। এমনকি, অনেক বোঝানোর পরও তাঁকে মাত্র ২-৪ চামচ খাবার খাওয়ানো গেছে।
ওপিডি (OPD)-তে সিনিয়র ডাক্তার পরীক্ষা করার আগে একজন জুনিয়র ডাক্তার ছেলেটির লেখাপড়া, শখ, পেশা, মাদকাসক্তি ইত্যাদি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করেন। কাউন্সেলিং-র পর জানা যায়, ছেলেটি তাঁর বন্ধুদের সাথে বিভিন্ন জায়গায় ভ্রমণ করতেন এবং ভ্রমণের ভিডিওগুলি ইনস্টাগ্রাম, ফেসবুক এবং ইউটিউবের মতো সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্মে নিয়মিত আপলোড করতেন।
চিকিৎসকদের মতে, প্রায় ৬৫-৭০ টিরও বেশি ভিডিও তৈরি করা সত্ত্বেও, সন্তুষ্ট হতে পারেননি ওই তরুণ। ধীরে ধীরে নিজেকে ব্যর্থ মনে করতে শুরু করেন তিনি। ফলে ক্রমশ নিদ্রাহীনতায় আক্রান্ত হন এবং তাঁর মনের মধ্যে সর্বক্ষণ অজানা ভয় কাজ করতে থাকে।
প্রতিমাসে সিআইপি (CIP)-তে এই ধরণের বেশ কিছু ঘটনা নথিভুক্ত করা হচ্ছে। দেখা গেছে, এই জাতীয় সমস্যার প্রধান কারণগুলি সোশ্যাল মিডিয়ায় নাম-খ্যাতি, লাইক-ভিউ এবং মন্তব্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে সম্পর্কিত।
এই প্রসঙ্গে রাজেন্দ্র ইন্সটিটিউট অফ মেডিকেল সায়েন্সেস (RIMS)-র সিনিয়র সাইকিয়াট্রিস্ট অজয় বাখলা জানান, সোশ্যাল মিডিয়া আসক্তি আজকাল মানসিক অসুস্থতার একটি প্রধান কারণ৷ এটি এমন একটি সমস্যা, যার ফলে সাধারণ মানুষ ভার্চুয়াল জীবনে অনেক কিছু আশা করছে এবং কাঙ্ক্ষিত ফলাফল না পেয়ে হতাশায় ভুগছে। অতিরিক্ত সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারের ফলে সাধারণ মানুষ অজান্তেই নিজেদেরকে বিখ্যাত সেলিব্রিটিদের সাথে তুলনা করতে শুরু করেন। ফলে নিজস্ব পোস্টে প্রত্যাশিত প্রতিক্রিয়া না পেয়ে হতাশ হন। ধীরে ধীরে বিষণ্ণতা গ্রাস করে তাঁদের।
সোশ্যাল মিডিয়ায় তাত্ক্ষণিক সাফল্য অর্জনের লোভ মারাত্মক আকার নিচ্ছে। ব্যবহারকারীরা রিল, ভিডিও এবং সেলফি তোলার জন্য তাঁদের জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলতেও পিছপা হচ্ছে না। ঝাড়খণ্ডে প্রায় প্রতি মাসেই সোশ্যাল মিডিয়ার সাথে সম্পর্কিত বিভিন্ন দুঃখজনক ঘটনাগুলি সামনে আসছে। যেমন -
১) গত ৯ অক্টোবর চাইবাসা জেলার হর্টিকালচার কলেজের ৮-১০ জন শিক্ষার্থী সঞ্জয় নদীতে স্নান করতে আসেন। রিল তৈরি এবং সেলফি তুলতে গিয়ে প্রবল স্রোতে ভেসে যায় চাত্রার রাজন কুমার সিং এবং দুমকার শচীন কুমার সিং। পরের দিন ন্যাশনাল ডিজাস্টার রেসপন্স ফোর্স (এনডিআরএফ) তাঁদের মৃতদেহ উদ্ধার করে।
২) গত ১৬ অক্টোবর, লাতেহার রেলওয়ে স্টেশনের কাছে একটি নদীর সেতুতে সেলফি তোলার সময় মালগাড়ির ধাক্কায় গুরুতর জখম হন ৩ যুবক। তাঁদের মধ্যে নাসির আনসারি নামে এক যুবক ঘটনাস্থলেই মারা যান।
৩) জুন-জুলাই মাসে জামশেদপুরে এরকম তিনটি ঘটনা ঘটেছে, যেখানে রিল বা সেলফি তুলতে গিয়ে নদীতে ভেসে গেছে তিনজন। গত ২ জুলাই, ২৪ বছর বয়সী সুরজ কুমার ওরফে সোনু নামের এক তরুণ ইনস্টাগ্রাম রিল তৈরি করতে গিয়ে ডুবে মারা যান।
৪) ৫ জুলাই, ১৬ বছর বয়সী বিক্রান্ত সোনি বাগবেরা এলাকার খরকাই নদীতে ডুবে যায় এবং জুনের তৃতীয় সপ্তাহে বাগবেরার বরোদা ঘাটে ডুবে ১৭ বছর বয়সী এক কিশোর মারা যায়।
মনোবিজ্ঞানী ডাঃ ধর্মেন্দ্র কুমারের কথায়, সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহারকারীদের থেকেও বিভিন্ন অ্যাপ নির্মাতাদের জন্য কঠোর নির্দেশিকা তৈরি করা দরকার। ভিডিও, রিল তৈরি করতে গিয়ে যেভাবে সামাজিক রীতিনীতি উপেক্ষা করা হচ্ছে, তা যত দ্রুত সম্ভব নিয়ন্ত্রণ করা প্রয়োজন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন