নীতিশ কুমার কি আবারও শিবির পরিবর্তন করতে পারেন? বিহারের মুখ্যমন্ত্রী, তথা জেডি(ইউ) সর্বেসর্বা নীতিশ কুমার এই মুহূর্তে ইন্ডিয়া মঞ্চের গুরুত্বপূর্ণ নেতা। অল্প কিছুদিন আগেই যিনি এনডিএ-র হাত ছেড়ে আরজেডি-র সমর্থনে সরকার গড়ে এখনও বিহারের মুখ্যমন্ত্রী। আচমকাই দলের সর্বভারতীয় সভাপতির পদ থেকে লালন সিং-কে সরিয়ে নিজেই সেই পদে বসায় নীতিশ কুমারকে নিয়ে ফের গুঞ্জন শুরু হয়েছে রাজনৈতিক মহলে।
২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে বিহার এনডিএ এবং ইন্ডিয়া মঞ্চ – দুই পক্ষের জন্যই গুরুত্বপূর্ণ। রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী নীতীশ কুমার যে পক্ষ বেছে নেবেন আগামী লোকসভা নির্বাচনে সেই পক্ষই লাভবান হবে একথা স্পষ্ট। যদিও নীতিশকুমার লোকসভা নির্বাচনের আগে আরও একবার পালটি খাবেন বলে মনে করছে বিজেপি এবং আপাতত বিজেপি সেই সুযোগের অপেক্ষায়।
বর্তমানে, নীতিশ কুমার ইন্ডিয়া মঞ্চের সাথে আছেন। যা বিজেপির পক্ষে বিহারে যথেষ্ট চিন্তার কারণ। অন্যদিকে ইন্ডিয়া মঞ্চের নেতৃত্বের পরিকল্পনা বিহার, পশ্চিমবঙ্গ এবং ঝাড়খন্ড থেকে এনডিএ-র আসনসংখ্যা যতটা সম্ভব কমানো। ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনে, বিজেপি পশ্চিমবঙ্গে ১৮টি, বিহারে ১৭টি এবং ঝাড়খণ্ডে ১২টি আসন জিতেছে। অর্থাৎ মোট আসন ৪৭ আসন। বিহার ও ঝাড়খন্ডের বর্তমান রাজনীতির গতিপ্রকৃতি অনুসারে লালু নীতিশের জোট বজায় থাকলে আসন সংখ্যার বিচারে বিজেপিকে অনেকটাই ক্ষতির মুখে পড়তে হবে।
বিজেপি থিঙ্ক ট্যাঙ্ক জানে যে আরজেডি নেতা লালু প্রসাদ যাদব এবং নীতীশ কুমার যদি বিহারে একত্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন তবে দলিত, মহাদলিত, মুসলিম, ওবিসি এবং ইবিসি ভোটব্যাঙ্কের একটি বড় অংশ তাদের সাথে যাবে এবং তারা সহজেই অধিকাংশ আসনে জয়লাভ করবে। সেক্ষেত্রে বিজেপির কাছে শুধুমাত্র উচ্চবর্ণ এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায়ের ভোট থাকবে, যা ভোট জয়ের জন্য যথেষ্ট নয়।
যদি নীতীশ কুমার বিজেপির সাথে যান, তাহলে বিপুল সংখ্যক দলিত, মহাদলিত, মুসলিম, ওবিসি এবং ইবিসি ভোটাররা এনডিএকে ভোট দেবেন এবং বিহারে ১৭টি আসন ধরে রাখা গেরুয়া ব্রিগেডের পক্ষে সহজ হবে।
বিজেপির কাছে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে নীতীশ কুমার এবং লালু প্রসাদ বিহারে জোট বেঁধে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করলে, আবারও ২০১৫ সালের বিধানসভা নির্বাচনের ফলাফলের মতই ফলাফল হবে। সেবার আরজেডি ৮০ আসন পেয়েছিল, জেডি-ইউ ৬৯ এবং বিজেপি ৫৯ আসন পায়৷
অন্যদিকে নীতীশ কুমার যখন বিজেপির সঙ্গে গিয়ে জেডি-ইউ পেয়েছিল মাত্র ৪৩টি এবং বিজেপি ৭৪টি আসন। সেই সময়ে, নীতীশ কুমার এবং জেডি-ইউ-এর অন্যান্য নেতারা বিজেপির বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ তোলেন। বিজেপি নেতারা বারবারই ২০১৯ লোকসভা নির্বাচনের কথা উল্লেখ করেন। যখন বিজেপি ১৭ টি আসন জিতেছিল, জেডি-ইউ জেতে ১৬ এবং এলজেপি ৬ আসন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী এবং বিজেপির জোরদার প্রচারের কারণেই জেডি-ইউ-এর আসন বেড়েছিল বলে দাবি বিজেপির।
২০১৯ লোকসভা ভোটের ফলাফলের পরেই জেডি-ইউ এবং বিজেপির মধ্যে মতপার্থক্য দেখা দেয়। জেডি-ইউ নরেন্দ্র মোদী সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদে একটি মন্ত্রিসভা এবং দুটি প্রতিমন্ত্রীর দপ্তর চায়। যদিও বিজেপি তা দিতে রাজী হয়নি। বদলে বিজেপির পক্ষ থেকে পূর্ণমন্ত্রীর একটি মাত্র পদের প্রস্তাব দেওয়া হয়। মন্ত্রিসভার দ্বিতীয় সম্প্রসারণের সময় বিজেপি শুধুমাত্র একটি মন্ত্রিপদ দিতে রাজি এবং আরসিপি সিং কেন্দ্রীয় ইস্পাত মন্ত্রী হন।
এছাড়া আঞ্চলিক দলগুলিকে শেষ করার জন্য বিজেপির জাতীয় সভাপতি জে পি নাড্ডার বক্তব্যও নীতীশ কুমারকে বিজেপির বিরুদ্ধে বিক্ষুব্ধ করে তোলে। এরপরেই তিনি আরজেডি, কংগ্রেস এবং বাম দলগুলির সহায়তায় সরকার গঠন করেন।
রাজনৈতিক মহলের অনুমান ২০২৪ সালের লোকসভা নির্বাচনে নীতীশ কুমার ইন্ডিয়া মঞ্চে থাকলে, বিহারে বিজেপির ফল খারাপ হবে।
জেডি-ইউ-এর জাতীয় সভাপতির পদ থেকে লালন সিংয়ের পদত্যাগের পর, নীতীশ কুমার দলের লাগাম নিজের হাতে তুলে নিয়েছেন। এরপর তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নিতে পারেন এবং ফের এনডিএ-র সঙ্গে যাওয়ার বিষয়টিও উড়িয়ে দেওয়া যায় না।
বিজেপির ওবিসি শাখার জাতীয় সাধারণ সম্পাদক নিখিল আনন্দ বলেন, “নীতীশ কুমার একজন অপ্রত্যাশিত ব্যক্তি যিনি সাধারণত মানুষকে অবাক করে দেন। লালন সিংকে সরিয়ে দলের জাতীয় সভাপতি না হলে জেডি-ইউ হয়তো বিভক্ত হয়ে যেত। তিনি আপাতত জেডি-ইউকে বিভক্ত হওয়া থেকে বাঁচিয়েছেন। দলের জাতীয় সভাপতি হওয়ার পর তাঁকে পাল্টা দিতে লালুপ্রসাদ যাদবের সামনে দাঁড়াতে পারেন তিনি। বিজেপির সমর্থনে সুশাসন শুরু করা নীতীশ কুমার এখন লালু প্রসাদের শিবিরে থাকায় দেশ বিস্মিত।”
আরজেডি মুখপাত্র মৃত্যুঞ্জয় তিওয়ারি বলেন, “নীতীশ কুমার জেডি-ইউ-এর অবিসংবাদিত নেতা এবং লালন সিং নিজেই তা বলেছিলেন। লালন সিং দলের জাতীয় সভাপতির পদ ছেড়ে দিয়ে নীতীশ কুমারকে নতুন জাতীয় সভাপতির প্রস্তাব দেন। এক্ষেত্রে অন্য কোনো নেতার নাম প্রস্তাব করলে অনেক প্রশ্ন উঠত। হয়তো একটি অংশ এটি গ্রহণ করত এবং অন্যটি না করত।”
তিনি আরও বলেন, "মিডিয়ার সব খবরের কোনো সত্যতা নেই। নীতীশ কুমার এনডিএ-র সঙ্গে যেতে চাইলে, জেডি-ইউ-এর কেউ তাঁকে বাধা দেবে না। তাই, লালন সিংয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা যে তিনি লালু প্রসাদ যাদবের ঘনিষ্ঠ, তা ঠিক নয়।"
তবে নীতীশ কুমার মুখ্যমন্ত্রী পদে দুই পক্ষ থেকেই উত্তাপের মুখোমুখি হবেন। লালু প্রসাদ চান তাঁর ছেলে তেজস্বী যাদব মুখ্যমন্ত্রী হোক আর বিজেপি চায় বিহারে নিজের মুখ্যমন্ত্রী।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন