অষ্টাদশ লোকসভা নির্বাচনে যে যে রাজ্য থেকে এনডিএ-র মূল শরিক বিজেপি জোরদার ধাক্কা খেয়েছে সেই তালিকায় শীর্ষে অবশ্যই উত্তরপ্রদেশ। যোগী রাজ্যে বিজেপির এই ফলাফল এনডিএ শিবিরের কাছে অপ্রত্যাশিত। কারণ ভোটের মুখে মুখে ঘটা করে অযোধ্যায় রামমন্দির উদ্বোধনের পর মনে করা হয়েছিল এই হাওয়াতেই এবার উত্তরপ্রদেশে বাজিমাত করবে বিজেপি। এমনকি ভোটের আগে যতগুলো জনমত সমীক্ষা হয়েছে তার সবগুলোতেই বিজেপিকে প্রায় ফুল মার্কস দিয়ে রাখা হয়েছিল। যদিও নির্বাচনী ফলাফল প্রমাণ করেছে সব জনমত সমীক্ষাই ভুল ছিল এবং কার্যত উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভরাডুবি হয়েছে। সংখ্যাগরিষ্ঠতার চেয়ে ৩২ আসন পিছনে পড়ে যাবার অন্যান্য কারণের সঙ্গে এটাও অন্যতম প্রধান কারণ। শুধুমাত্র উত্তরপ্রদেশেই বিজেপির আসন কমেছে ২৯টি।
উত্তরপ্রদেশে এবার বিজেপি তথা এনডিএ-র ভোট যেমন কমেছে তেমন এই উত্তরপ্রদেশ থেকেই বিগত মন্ত্রীসভার সাত জন মন্ত্রী পরাজিত হয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী বারাণসী কেন্দ্র থেকে জয়ী হলেও তাঁর জয়ের ব্যবধান কমে এসেছে দেড় লক্ষে। যে রামমন্দিরের কাঁধে ভর দিয়ে বিজেপি ভোট বৈতরণী পেরোনো চেষ্টা করেছিল মন্দির খ্যাত সেই ফৈজাবাদ কেন্দ্রেই বিজেপির শোচনীয় পরাজয় ঘটেছে। যদিও ফৈজাবাদ কেন্দ্রের অধীন পাঁচটি বিধানসভা কেন্দ্রই বিজেপির দখলে। এর পেছনে শুধু যে প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা কাজ করেছে এমন নয়। বরং উত্তরপ্রদেশে বিজেপির এই পরাজয় প্রমাণ করে দিয়েছে যে সাধারণ মানুষ ঘৃণার রাজনীতি পছন্দ করছেন না। সাধারণ মানুষ লখিমপুর খেরির ঘটনা ভালোভাবে নেননি। সাধারণ মানুষ আরএলডি-র জয়ন্ত চৌধুরীর শিবির বদলকেও মান্যতা দেননি এবং সাধারণ মানুষ 'মোদী কী গ্যারান্টি'-তে আস্থা রাখেননি।
কী বলা হয়েছিল উত্তরপ্রদেশের ওপিনিয়ন পোলে?
মার্চ ২০২৩ থেকে মার্চ ২০২৪-এর মধ্যে ৮টি প্রতিষ্ঠিত সংস্থা উত্তরপ্রদেশের নির্বাচন নিয়ে জনমত সমীক্ষা করেছিল। যার সবকটিতেই এনডিএ-কে অনেক এগিয়ে রাখা হয়েছিল। এবিপি নিউজ-সি ভোটার মার্চ ২৪-এ শেষ যে সমীক্ষা করে সেখানে বলা হয়েছিল এনডিএ পেতে পারে ৭৪ আসন এবং বিরোধী ইন্ডিয়া ৬টি। ইন্ডিয়া টুডে-সি ভোটার ফেব্রুয়ারি ২৪-এর সমীক্ষায় জানিয়েছিল এনডিএ ৭২, ইন্ডিয়া ৮। টাইমস নাও-ইটিজি ডিসেম্বর ২৩-এর সমীক্ষায় জানিয়েছিল এনডিএ ৭০-৭৪ এবং ইন্ডিয়া ৪-৮। ইন্ডিয়া টিভি-সিএনএক্স অক্টোবর ২০২৩-এ জানিয়েছিল ফলাফল হতে পারে এনডিএ ৭৩ এবং ইন্ডিয়া ৭। সমীক্ষায় ভোট প্রাপ্তির শতকরা হারের ক্ষেত্রে বলা হয়েছিল এনডিএ পেতে পারে ৫১ শতাংশ ভোট এবং ইন্ডিয়া ৩৫ শতাংশ। বিএসপি ৮ শতাংশ এবং অন্যান্যরা ৬ শতাংশ।
কী জানিয়েছিল এক্সিট পোল?
রিপাবলিক পি মার্ক, ইন্ডিয়া নিউজ, ইন্ডিয়া টিভি-সিএনএক্স, ইন্ডিয়া টুডে অ্যাক্সিস মাই ইন্ডিয়া, জন কী বাত, নিউজ নেশন, নিউজ ২৪-টুডেজ চাণক্য সহ যতগুলো সংস্থা এক্সিট পোল বা বুথ ফেরত সমীক্ষা করেছিল সকলেরই দাবি ছিল এবারও বিজেপি তথা এনডিএ উত্তরপ্রদেশ থেকে প্রায় ৭০টি আসন পেতে চলেছে। বিভিন্ন সংস্থা এনডিএ-র পক্ষে মোটামুটি ৭৪, ৬৯, ৬৮, ৬৭, ৬৪ তেই নিজেদের সমীক্ষার ফলাফলে জানিয়েছিল। ব্যতিক্রম ছিল ডিবি লাইভ। যারা বলেছিল বিজেপি তথা এনডিএ পেতে পারে ৪৬ থেকে ৪৮ এবং ইন্ডিয়া পেতে পারে ৩২ থেকে ৩৪। একমাত্র এঁদের ফলাফলই অনেকটা কাছাকাছি এসেছে। এইসব মূলধারার সংবাদমাধ্যমের বাইরে একাধিক অল্টারনেটিভ মিডিয়া জানিয়েছিল এবার উত্তরপ্রদেশে বিজেপির ভরাডুবি হতে চলেছে। ফলাফলের পর প্রমাণ হয়ে গেছে মেইনস্ট্রিম নয়, অল্টারনেটিভ মিডিয়াই এক্ষেত্রে সম্পূর্ণ সফল।
উত্তরপ্রদেশের ফলাফল যা দাঁড়ালো
উত্তরপ্রদেশের ৮০ আসনের মধ্যে ৭৫ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে বিজেপি জয়ী হয়েছে ৩৩ আসনে। গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় যা ২৯টি কম। জোটসঙ্গী আরএলডি ২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ২টি তে, আপনা দল (এস) ২টি আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ১ আসনে জয়ী হয়েছে। অন্যদিকে সমাজবাদী পার্টি ৬২ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৩৭ আসনে জয়ী, কংগ্রেস ১৭ আসনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে ৬ আসনে এবং আজাদ সমাজ পার্টি একক শক্তিতে ৮ আসনে লড়াই করে ১টি আসনে জয়ী।
২০১৯ এবং ২০২৪-এর লোকসভা নির্বাচনের ফলাফল পাশাপাশি রাখলে দেখা যাবে আসন সংখ্যার পাশাপাশি বিজেপির ভোট শতাংশও উল্লেখযোগ্য হারে কমেছে। ১৯-এর লোকসভা নির্বাচনে ৪৯.৯৮% ভোট পেয়ে বিজেপি জিতেছিল ৬২ আসনে। ১.২১% ভোট পেয়ে আপনা দল (এস) জিতেছিল ২ আসনে। অর্থাৎ এনডিএ জয়ী হয়েছিল ৬৪ আসনে। বাকী ১৬ আসনের মধ্যে বিএসপি ১০ (১৯.৪৩%), সমাজবাদী পার্টি ৫ (১৮.১১%) এবং আরএলডি কোনও আসনে জয়লাভ করেনি (১.৬৯%)। কংগ্রেস ৬.৩৬% ভোট পেয়ে ১টি আসনে জয়লাভ করে।
২৪-এর সদ্যসমাপ্ত নির্বাচনে বিজেপির ভোট প্রাপ্তির হার ৪১.৩৭%, আপনা দল-এর ০.৯২% এবং আরএলডি-র ১ শতাংশের কাছাকাছি। অর্থাৎ বিজেপির ভোট কমেছে ৮.৬১%, আপনা দলের ০.২৯ শতাংশ এবং আরএলডি-র প্রায় ০.৪৯ শতাংশ। বিরোধী ইন্ডিয়া-র মধ্যে সমাজবাদী পার্টির প্রাপ্ত ভোটের হার ৩৩.৫৯%, কংগ্রেসের ৯.৪৬% এবং তৃণমূলের ০.৪৭%। পরিসংখ্যান অনুসারে সমাজবাদী পার্টির ভোট বেড়েছে ১৫.৪৮%, কংগ্রেসের ৩.১%। এনডিএ বা ইন্ডিয়া – কোনও শিবিরের সঙ্গেই না থেকে একক শক্তিতে লড়াই করে মায়াবতীর বিএসপি ভোট পেয়েছে ৯.৩৯ শতাংশ। অর্থাৎ গত লোকসভা নির্বাচনের তুলনায় প্রায় ১০ শতাংশ ভোট হারিয়েছে মায়াবতীর বিএসপি।
আসন সংখ্যা কমার পাশাপাশি কমপক্ষে ১০টি কেন্দ্রে বিজেপির ভোট প্রাপ্তির হার কমেছে উল্লেখযোগ্যভাবে। যার মধ্যে আছে মথুরা (১,৬১,২২৯), মুখ্যমন্ত্রী যোগী আদিত্যনাথের খাসতালুক গোরখপুর (১,৩১,২৮৮), আমেথি (৯৬,৪৮২), এলাহাবাদ (৯১,১০৪), গাজিয়াবাদ (৯০,৩৩৩), প্রধানমন্ত্রীর কেন্দ্র বারাণসী (৬১,৬৯৪), মানেকা গান্ধীর কেন্দ্র সুলতানপুর (৫৮,০৪০), অরুণ গোভিলের কেন্দ্র মীরাট (৩৯,৭১৫), রামমন্দিরের কেন্দ্র ফৈজাবাদ (২৯,২৯৯), রাজনাথ সিং-এর কেন্দ্র লখনৌ (২০,৩১৭)। ১২ আসনে বিজেপির ভোট কমেছে লক্ষাধিক। ৩৬ টি আসনে বিজেপির ভোট কমেছে ৫০ হাজার থেকে ১ লক্ষের মধ্যে।
তাৎপর্যপূর্ণভাবে বিগত লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে মোট ভোট পড়েছিল ৮.৬ কোটি। যার মধ্যে বিজেপি পেয়েছিল ৪.৩ কোটি ভোট (৪,২৮,৫৮,১৭১)। এর মধ্যে থেকে বিজেপির গত বারের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করা বিজনৌর, বাগপত এবং ঘোষি কেন্দ্র বাদ দেওয়া যেতে পারে। কারণ এবার এই তিন কেন্দ্রে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেনি বিজেপি। সেক্ষেত্রে বিজেপির প্রাপ্ত ভোট ছিল ৪.১ কোটি। এবারের নির্বাচনে ৮.৮ কোটি ভোট পড়লেও বিজেপি ভোট পেয়েছে ৩.৬ কোটি (৩,৬২,৬৭,০৭২)।
৭১ থেকে ৬২ হয়ে ৩৩। শেষ তিন লোকসভা নির্বাচনে উত্তরপ্রদেশে এভাবেই আসন সংখ্যা কমেছে বিজেপির। এবারের নির্বাচনে বিজেপির ভোট প্রাপ্তির হার ২০১৪-র থেকেও (৪২.৬৩%) কমে গেছে। যদিও ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনের অনুপাতে (৪১.২৯%) ভোটের হার সামান্য বেড়েছে। বিধানসভা ভিত্তিক ফলাফল সামনে এলে এই বিধানসভা নির্বাচনে ঠিক কতগুলো আসনে বিজেপি পরাজিত হয়েছে তা আরও স্পষ্ট হবে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন