সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে এবং নারীদিবস...

সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে এবং নারীদিবস...
ছবি প্রতীকী সংগৃহীত
Published on

ঘর সংসারের ছোট গণ্ডিটা মেয়েদের আর বাইরের বিস্তৃত পৃথিবী পুরুষের কর্মক্ষেত্র – এমন একটা শ্রমবিভাজন কেন তৈরি হয়েছিলো ফ্রেডরিক এঙ্গেলস তার একটা স্পষ্ট ব্যাখ্যা দিয়েছেন। কিন্তু যেটা লক্ষণীয় বিষয় তা হল, যতই সময় গেছে ততই এই বিভাজনকে মহিমান্বিত করে গেছে পিতৃতান্ত্রিক সমাজ।

বসার ঘরের যে দেয়ালটা সবচেয়ে আগে চোখে পড়ে, সেখানে ঝোলানো আছে সোনালী-কালো ফ্রেমে বাঁধানো অপূর্ব এমব্রয়ডারি। বাগানের লাল টুকটুকে গোলাপ আর ঘন সাজে পাতার নক্সা এড়িয়েও চোখ চলে যায় উজ্জ্বল লেখাটির দিকে। বিদ্যাসাগরের বর্ণপরিচয় থেকে যেন অক্ষর ছেঁকে নিয়ে বসিয়ে লেখা হয়েছে – 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে'। বাড়ির প্রতিটি মেয়ের শ্বশুরবাড়ির লোকজন জানে, এ তাঁদের বাড়ি আগত রমণী শ্রেষ্ঠের সুনিপুণ হাতের কাজ। কেন না প্রত্যেকের বিবাহপূর্ব দেখাশোনার সময় তাঁদের জানানো হয়েছে এই কথাটি। কথা সেটা নয়, হয়তো এঁদের মধ্যেই কেউ এই অসামান্য শিল্পকর্মটি করেছেন বা অন্য কেউ। আসলে তো এই মন্ত্রই মেয়ের আত্মায় ভরে দেবার ছক ছিলো এই পিতৃতান্ত্রিক সমাজের। 'সংসার সুখের হয় রমণীর গুনে'র উল্টোপিঠের যে বাক্যবন্ধটা থাকার কথা এবং যেটা ঘটেছেও, সেটা হল, রমণী ধ্বংস হয় সংসারের দোষে। মেয়ের গৃহ সামলানোর দায়, সন্তান পালনের দায়, রন্ধন পরিবেশনের দায়, স্বামীর মনোরঞ্জনের দায়। রতি বিষয়টিও তো উভয়ের সুখের ছিলোনা সবসময়। ক্লান্ত শরীর, মরে যাওয়া মন আর স্বামীর সঙ্গে শরীরী সম্পর্কের মধ্যেই আঁতুড়ঘরে যাবার প্রবল সম্ভাবনা এবং পুত্রসন্তান বিয়োবার প্রত্যক্ষ চাপ কী আর কোনো সুখের জন্ম দিতে পারে! অতএব সুখ সংসারের বটে, সুখ রমণীর ছিলোনা।

উল্টোদিকে সংসারের দায়ভারমুক্ত হতে পেরেই মেয়েরা যেটুকু পেরেছে নিজেদের দিকে তাকানোর ফুরসৎ পেয়েছে। বাঙলা সাহিত্যের প্রথম মেয়ে কবির কথাই বলি। চন্দ্রাবতী। জয়ানন্দর সঙ্গে বন্ধুত্ব, পরবর্তীতে প্রেম মেয়েটিকে সংসারজীবনে ব্যস্ত রেখেছিলো অন্য সবার মত করেই। নিজের দিকে তাকায়নি। চেয়েছিলো মুগ্ধ চোখে তাঁর মনের মানুষটির দিকে। সেও তো কবি। চন্দ্রাবতীর পিতা দ্বিজ বংশীদাসের লেখা মনসামঙ্গলে জয়ানন্দের বেশ কিছু পদ রয়েছে। চন্দ্রাবতীও কবি স্বভাবের মেয়ে। তাঁর মুগ্ধতা জয়ানন্দকে ঘিরেই। কিন্তু জয়ানন্দের কাব্যলোক তো রসাপ্লুত হয় রমণীর স্পর্শে।

বাণী বসু'র 'পঞ্চমপুরুষ'-এর এষা খান কবি অরিত্রকে একদিন জিজ্ঞাসা করেছিলো, কবিতার জন্য কত নারী লাগে অরিত্র? অরিত্রদের নীলম যোশীকে দেখলে কবিহৃদয় উদ্বেলিত হয়। বাস্তবেও তাইতো ঘটলো। আশৈশব খেলার সঙ্গিনী, যৌবনের কাব্যচর্চার সঙ্গিনী চন্দ্রাবতীর সঙ্গে বিবাহের দিনেই জয়ানন্দ তাঁর নতুন খেলার কনে আশমাণী, রূপসী আশমাণীকে বিয়ে করে ফেললো। প্রতারিত চন্দ্রাবতী। ভাগ্যিস প্রতারিত হলো। তাই বাঙলা সাহিত্য প্রথম মেয়ে কবিকে পেলো। চন্দ্রাবতী যদি জয়ানন্দের সঙ্গে সংসার করতে যেতো, তাহলে তো তাঁর প্রতিভার অপমৃত্যু ঘটা অনিবার্য ছিলো। যেমনটা ঘটেছে সবসময়। চন্দ্রাবতী নেহাত জয়ানন্দের প্রতারণায় দিশেহারা হয়ে গেলেন, তাই পিতা বংশীদাসের কাছে অনুমতি চাইলেন,

"চন্দ্রাবতী বলে পিতা মম বাক্যধর।
জন্মে না করিব বিয়া রইব আইবর।।"

নিরুপায় পিতাও দেখলেন, কন্যার সঙ্গে এতবড় অন্যায় ঘটেই গেছে, তখন, "শিবপূজা কর আর লেখ রামায়ণে।" অতএব চন্দ্রাবতী রামায়ণ লিখলেন। লিখলেন, কেননা সংসার করবার সুযোগ হয়নি তাঁর।

বাবরের কন্যা গুলবদন। বিয়ে হয়নি তাঁরও। হয়তো বাদশা পরিবারের নানা জটিলতার কারণেই। তিনিও জীবনের আনন্দ খুঁজে নিলেন পাঠচর্চার মধ্যেই। গুলবদনের মত এক মেয়ে যখন কবিতা লেখেন -
"হর পরী কেউ বা আশিক-ই-খুদ ইয়ার নীস্ত।
তু ইয়াকীন মীদান কি হেচ অজ উমর – বর-খুরদার নীস্ত।"

যার অর্থ, নিজের প্রেমিকের প্রতি বিমুখ প্রত্যেক পরী। কেউই জীবনের সবটুকু স্বাদ পায়না আবার জীবনও তো খুব ছোট, নশ্বর। অতএব, যতটুকু সুখ ভোগ করে নেওয়া যায়, ততটুকুই পরম লাভ।

আরেকজনের কথা বলবো। জাহান–আরা। শাহজাহান বাদশা আর মুমতাজের কন্যা। ঐশ্বর্য ছিলো, রূপ ছিলো, বিয়ে করেননি। অথবা বিয়ে হয়নি। রাজকার্যে সকলেই এত ব্যস্ত, অন্দরমহলের অন্ধকারে জাহান-আরা মেয়েটির যে বিয়েই হলোনা, কারো সেকথা মনে পড়েনি। যাই হোক, জাহান-আরা কিন্তু নিজের মত একটা জীবন বেছে নিলেন। সুফী সাধকদের সঙ্গে ধর্মতত্ত্বের জটিল আলোচনায় খুব সহজভাবে অংশগ্রহণ করেছেন। 'মূনিস–উল–আরওয়া'র মত সংকলন গ্রন্থে নিজেও লিখেছেন, অন্যদের লেখাও সংগ্রহ করে রেখেছেন।

আওরঙ্গজেবের বড়ো মেয়ে জেব-উন্নিসা। তিনিও বিবাহ করেননি। ভাগ্যিস। সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে। আর সংসারের পেষণযন্ত্রে পিষ্ট হয় রমণীর যাবতীয় আত্মশক্তি। রমণীর মন, মেধা। চন্দ্রাবতী, জাহান-আরা, জেব-উন্নিসাদের বিবাহ হয়না বলেই জেব-উন্নিসা লিখে ফেলেন –

"জেনে রাখ বন্দী তুই, শেষ দিন না আসিলে আর,
নাই নাই, আশা নাই খুলিবে এ লৌহ কারাদ্বার।"

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in