অমর একুশে বাঙালি: ভাষা আন্দোলনের দিনলিপি

তিন খণ্ডে, দু'টুকরো হল ভারতবর্ষ। বাতিল হয়ে গেল আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর অখন্ড বাংলার আবেদন। নানা ভাষা, নানা মত, আর নানা পরিধানে মিলনকে মেনে নিয়ে ভারত স্বাধীন হল। পুবে পাকিস্তান, পশ্চিমেও পাকিস্তান।
ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীফাইল ছবি, ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত
Published on

ভাষা ইতিহাসে লড়াইয়ের কথা, সংগ্রামের কথা, বাঙালি জীবনের সেই পূর্বকথা, না বললেই নয়। ইংরেজ অধীন ভারতীয় উপমহাদেশে তখন সুচতুর শাসননীতির ব্যথা, অনভিপ্রেত অনুভূতির সে-এক ভয়ের সাম্রাজ্য। “ভাগ করো, এবং শাসন করো।” – এই ভাবনার রাজনৈতিক প্রকাশে, সম্প্রদায়ে লেগেছে তখন স্বার্থপরতার গন্ধ।

হিন্দু-মুসলমানের ধর্মীয় ভিন্নতায়, জাতীয় কংগ্রেস আর মুসলিম লীগের সংগঠন ব্যবধানে, ভ্রাতৃত্বের পরম্পরা যখন বৈর অবস্থানে দীর্ণ, কূট নেতাদের ক্ষমতালোভের কৌশলী ফাটলে তখন চেপে বসে সাম্রাজ্যবাদী তীক্ষ্ণতা।

সেই ক্ষণে, তিন খণ্ডে, দুই টুকরো হল ভারতবর্ষ। বাতিল হয়ে গেল আবুল হাশিম ও শরৎচন্দ্র বসুর অখন্ড বাংলার আবেদন।

নানা ভাষা, নানা মত, আর নানা পরিধানে মিলনকে মেনে নিয়ে ভারত স্বাধীন হল। 

তার পুবে রইলো পাকিস্তান, পশ্চিমেও রইলো পাকিস্তান।

পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে উর্দু। ভাবের ভাষা বাংলা যাবে চুরি। পুবের বাঙালি ঘোর উদ্বিগ্ন।

চৌধুরী খালিকুজ্জামান, লীগের নেতা, বাংলার মাটিতে দাঁড়িয়ে সেই উর্দুর পক্ষেই বিবৃতি দিলেন।

জিয়াউদ্দিন আহমদ, আব্দুল হক, কামরুদ্দীন আহমদ, তাজউদ্দীন আহমদ, মহম্মদ তোয়াহার এই ভাষা আগ্রাসনের বিরোধিতা করলেন। তাঁরা বলে বসলেন –

“বাংলা ভাষায় সার্বভৌম রাষ্ট্র চাই।”

আতাউর রহমান, আখলাকুর রহমান, শহীদুল্লা কায়সার, গণতন্ত্র ও প্রগতির পরিচয়ে, সামাজিক-রাজনৈতিক-সাংস্কৃতিক স্বাধীনতায়, গণচেতনা গড়ে তোলার ডাক দিলেন।

তাদের কমিউনিস্ট বলে হেঁকে দেওয়া হল।

দেশবিরোধী পরিচয়ে ধর্মবিরোধী অবস্থানে চিহ্নিত করা হল। কাফের হলেন তাঁরা।

সরকারিভাবে সত্য হয়ে বাঙালির জীবনে হাজির হল উর্দু আর ইংরাজি। বাংলা থাকলো অনুপস্থিত।

১৯৪৭ এর ২৭ নভেম্বর করাচির শিক্ষা সম্মেলনে বাংলার সেই না-থাকায় শিলমোহর পড়লে ছাত্রসমাজ গর্জে ওঠে। শিক্ষায় উর্দুর এই সুপারিশ তারা মানেন না। তারা রাষ্ট্রকাঠামোর মেরামতি চান।

মাতৃভাষার প্রতি আবেগ বাঙালির পরিচয় গঠন করে।

নূরুল হক ভুঁইয়া, কল্যাণ দাশগুপ্ত, আবুল কাশেম, ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, মুনীর চৌধুরী, এ কে এম আহসান, সামসুল আলম বাঙালিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক করে রাখার আধিপত্যবাদের বিরোধিতা করেন।

ঢাকার শিক্ষাঙ্গনে দাবি ওঠে –  

“সবকিছুতে বাংলা চাই, উর্দুর সঙ্গে বিরোধ নাই।”

বেচারাম দেউরিতে আগুন জ্বলে।

নুরুল আমিন কাফের তকমা পান।

খাজা নাজিমুদ্দিনের খাজা কথা ডাহা মিথ্যে প্রতিপন্ন হয়।

ছাত্র বিক্ষোভের সংগঠিত মিছিলের শ্লোগানে মুখরিত হয় আকাশ-বাতাস –

“রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।”

 * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *

চৌত্রিশ-বাইস-চৌত্রিশ, শরীরের মাপটা তো খাসা!

হাতে থাকা রোশানারা চৌধুরীর ছবিটায় চোখ বুলিয়েই কথাটা বললেন, ব্রিগেডিয়ার ওসমান। চোখ তার চিকচিক করে ওঠে। সেই চোখের ইশারাতেই বসতে বলেন সামনে দাঁড়িয়ে থাকা জুনিয়র অফিসার আতাউর রহমানকে।

দেশভাগের ফলে সামান্য লেফটেন্যান্ট থেকে গুপ্তচর বিভাগের প্রধান হয়ে পাঞ্জাব থেকে এই বাংলায় সদ্য এসেছেন ব্রিগেডিয়ার ওসমান। যে ক’জন দক্ষ অফিসারকে তিনি বেছে নিয়েছেন তার মধ্যে অন্যতম আতাউর রহমান। রহমান ঢাকা শহরটাকে হাতের তালুর মতো চেনেন। মানুষজনের খবর রাখেন। যদিও তার সব পদোন্নতি আটকে রাখা আছে ছেলের দোষে।  

স্বগতোক্তির ঢঙে বলা কথার মাঝে সামান্য হেসে উঠলেন ব্রিগেডিয়ার ওসমান। শ্লেষভরা স্বরে বললেন –

যে মেয়েরা কয়েক বছর আগেও বোরখার বাইরে আসতে সংকোচ বোধ করতো তারাই কি এখন বিদ্রোহে নেতৃত্বের আসন দখল করেছে মিস্টার রহমান? মেয়েটার তো আমেরিকার মিয়ামী বিচে বিশ্ব-সুন্দরী প্রতিযোগিতায় নামা উচিত। এমন উত্তেজক শরীর নিয়ে সে নির্ঘাৎ বিজয়িনী হতে পারবে। তাতে পাকিস্তানের নাম রোশান হবে।

ক্ষিপ্রতায় ছবিটা অফিসার আতাউর রহমানের দিকে মেলে ধরে জিজ্ঞাসা করলেন –

খুবসুরৎ এই মেয়েটিকে চেনেন?

আতাউর রহমান এই ফুটফুটে, প্রাণোচ্ছল, ন্যায়বাগীশ ছাত্রনেত্রীটিকে বিলক্ষণ চেনেন। দীর্ঘ বছর ধরে ব্যারিস্টার আফাক চৌধুরীর পরিবারকে চেনার সুবাদেই তিনি রোশানারা চৌধুরীকে চেনেন। ব্যারিস্টার আফাক চৌধুরীর একমাত্র কন্যা রোশানারা চৌধুরী।

গয়াশপুরের জমি নিয়ে দাঙ্গা বাঁধলে আতাউর রহমান যখন গুলি করে বিলের ধারে তিনটে লাশ ফেলে দিয়েছিলেন, সেই কেসের মামলা লড়েছিলেন আফাক সাহেব। আফাক সাহেবের চেষ্টায় বছরখানেক পরে আতাউর বেকসুর খালাস পান। তার পরের বছরই সৈন্য বিভাগে চাকরিতে তার যোগদান। আতাউর রহমানের কাছে আফাক চৌধুরীর পরিবারের কোন ইতিহাসই অজানা নয়। আতাউর রহমান জানেন যে রোশানারার একমাত্র ভাই সেলিম টিটেনাসে মারা যায়। ভালো ফুটবল খেলতো ছেলেটা। খেলার মাঠেই তার পা কাটে। পরে সেটা বিষিয়ে যায়। ইঞ্জেকশন দিলে ফল খারাপ হয়। রোশানারার থেকে বছর ছয়েকের ছোট ছিল সে।

কী ভাবছেন মিস্টার রহমান? হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন ব্রিগেডিয়ার।

আতাউরের চোখেমুখে স্মিত হাসি। বললেন –

রোশানারা চৌধুরীকে চেনে না এমন মানুষ ঢাকা শহরে নেই বলেই আমার ধারণা স্যার।

দ্যাটস্ গুড অফিসার।

রোশানারার ফাইলটাকে খোলার জন্য বাকি তিনটে ফাইলকে সরালেন ব্রিগেডিয়ার।

আতাউর রহমান দেখলেন ফাইলগুলোকে একে অপরের ওপর রাখা হলো। ফাইলের ওপরে লেখা নাম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী, তোফাজ্জ্বল হোসেন, মুজিবর রহমান।

 * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  

প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের জন্য দরকষাকষি করতে গিয়েছেন মওলানা ভাসানী। মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে তিনি ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের প্রতিনিধি।

সেই রাজনৈতিক সওদায় মওলানা সাহেবের ঝুলিতে তখন শুধুই ব্যর্থতা। ব্যর্থতায় ভরা ঝুলি নিয়ে ফেরার পথে তাঁকে লাঞ্ছিত হতে হয়। তিনি হুংকার দেন –

“যদি স্বায়ত্তশাসন না দেওয়া হয় তবে দেশে রক্ত নদী বইয়ে ছাড়বেন।”

চীন সফরের পরে তিনি লাঞ্ছনার থেকে গঞ্জনার বেশী মুখোমুখি হয়েছিলেন। বন্ধুবিচ্ছেদ ঘটেছিল।

তবু তিন মহাদেশের সদ্যোত্থিত জনগণের মুক্তিতীর্থ চীন দর্শনে মওলানা নতুন জীবনবোধের প্রত্যয়ী আলোকে তাঁর আশি বছরের বিশৃঙ্খল জীবনকে দেখেছিলেন।

আজ জীবনের সায়াহ্নে তিনি তাঁর গফুরকে সামনে দেখছেন।

যে গফুরকে তিনি বাহান্নর উতল হাওয়ায় খুঁজে পেয়েছিলেন।

যে গফুর ক্ষেতের মানুষ।

মাঠের ধারে ছোট্ট কুঁড়েতে তার বাস।

রাত গভীর হলে যখন গোটা গ্রাম ঘুমিয়ে কাদা হয়ে যায়, প্রদীপের আলোয় তখন গফুর তার আদরের আসিয়াকে সুর করে পড়ে শোনায় ছহি বড় সোনাভানের পুঁথি।

আসিয়াকে সে সুখে রাখাতে চায়।

সেই স্বপ্নেই মাতোয়ারা তার জীবন।

সোনার ফসল হাওয়ায় দুলে উঠলে, সে আসিয়ার জন্যই গান গায়। সুর ভাজে।

নদীর সঙ্গে কথা বলে। ফড়িঙের দলে নেচে ফেরে।

বুড়ি গঙ্গার ওপর দিয়ে খেয়া পেরিয়ে আসিয়ার জন্যে লাল টুকটুকে শাড়ি কিনতেই কাল তার শহরে আসা।

আজ হরতাল।

আজ একুশে ফেব্রুয়ারি।

সন উনিশ’শ বাহান্ন।

শহরের সমস্ত দোকানপাট বন্ধ।

গাড়িঘোড়া চলে না।

জনশূন্য রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে হরতালের চেহারাটা নির্ণয় করতে চায় গফুর।

আসিয়ার জন্য তার বুকটা কেঁদে ওঠে। লাল কাপড় না কিনে কি তাকে ফিরে যেতে হবে? সদরের ফেরিঘাট হয়তো এখন হয়েছে বন্ধ!

কিসের যেন কোলাহল শোনা যায়।

দাবি মানার আওয়াজ।

গফুর দেখে চিৎকার করে কতগুলো মুখ।

মিছিলের মুখ।

শপথের কঠিনতায় ভাস্বর সেই সব মুখ।

তারা সদর্পে ঘোষণা দিচ্ছেন –

রাষ্ট্রভাষা বাংলা  চাই।

আমরা আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে দেবো না।

একশো চুয়াল্লিশ ধারা মানি না।

সহসা উল্টো দিকে রাইফেল হাতে কতগুলো মুখ।

বর্বরতার মুখ।

শাসনের, শোষণের, ক্ষমতার, দম্ভের বিকৃতি-ভরা সেই মুখ।

মুখোমুখি দুই পক্ষ।

সহসা বিকট শব্দে আগুন ঠিকরে বেরোয়। 

গফুরের আর কিছু তার মনে নেই।

এক ঘটি জল তার দিকে এগিয়ে দেন মওলানা। গফুরের নিবাস জানতে চান।

মুন্সিগঞ্জ।

কিন্তু সেটা এখন গফুরের কাছে বড় বিষয় নয়, বড় হয় আসিয়ার কাছে ফিরে যাওয়ার রাস্তা। সাহস করে অনেক কথাই সেদিন বলেছিল গফুর। বলেছিল –

হরতাল করে কী হবে? হরতাল কিসের ফসল তোলে?

মওলানা তাকে বুঝিয়েছিলেন।

গফুর জেনেছিল। আসিয়াকে বলেছিল –

যে সরকার গণআন্দোলন বানচাল করার জন্য আইন বানায় তাদের কথায় মাথা নিচু করার অর্থই হচ্ছে স্বৈরতন্ত্রের কাছে আত্মসমর্পণ।

ক্ষোভের ভাষা হল হরতাল।

অধিকারের ভাষা হল হরতাল।

* * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * * 

কিসের হরতাল?

আমি হরতাল মানি না।

কাল আমি রিক্সা নিয়ে রাস্তায় থাকবো।

রিক্সা না চললে তিনটে পেট আমার চলবে কীভাবে? ভাবের ভাষা দিয়ে কি ভাত হয়? উর্দুর সঙ্গে আমার কোন বিরোধ নেই।

আনোয়ারের প্রশ্নে শফিউর কিছুক্ষণ চুপ করেই ছিল।

নিজের কাছেই সে জানতে চায়, মানুষ কি আজ দাসত্বেই স্বাধীনতা অনুভব করে? কেন কিছু মানুষ সমাজকে সুদূর প্রসারী ভাবনায় বিচার করেন না?

শফিউরের উত্তরের অপেক্ষা করেনি আনোয়ার। সে বলেছিল -

কিসের জন্য তোমরা বাংলা বাংলা বলে চিৎকার জুড়েছো? বাংলা কি মুসলমানের ভাষা? ওটাতো হিন্দুদের ভাষা। হিন্দুরা দেশটাকে জাহান্নামে নেবে।

চিবিয়ে চিবিয়ে বলা আনোয়ারের কথাগুলো শফিউরের ভালো লাগেনি।

তুমি কেমন নিষ্ঠুর মানুষ! তুমি কি জানো না খানদানি ভাষাও ভাত দেয় না।

মাতৃভাষার মিষ্টি স্বাদ কি তুমি পাওনা? ভাষা হারালে সংস্কৃতির শেকড় যে আলগা হয়, তাও কি তুমি মানো না?

আমরা বাঙালি।

ভাষা হারালে আমরা যে পরিচিতিহীন হয়ে পড়ি।

কথা এগোয় না।

এরই মাঝে সেখানে হাজির হন রোশানারা চৌধুরী, সুলতান চৌধুরী, অভিজিৎ রায়, লাইলি ইসলাম, হারুন সহ কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের একঝাঁক তরুণ-তরুণী। কালকের জমায়েতকে সফল করাটাই তাদের লক্ষ্য। স্বায়ত্বশাসন প্রতিষ্ঠার জন্যেই তাদের সেটা করতে হবে।

আনোয়ার জানতে চায় তারা এখন কোথায় যাবে?

জিন্নৎ মহল। লাইলি উত্তর দেয়।

রিকশাটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে ওদের পিছু পিছু চলে আনোয়ার।

শীতের সন্ধ্যে দ্রুত নামছে।

পাখিরা ঘরে ফিরছে।

নও-জোয়ানের দল তখন চলেছে ভাষা বিদ্রোহের আগুন জ্বালাতে।

আনোয়ার এসে হাজির হল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অদূরে টিনের একটা ছোট্ট চায়ের দোকানে। এটা হল সামাদ মিয়ার রেস্তোরাঁ। সে বুঝলো এটাকেই ছেলেমেয়েগুলো জিন্নৎ মহল বলে।

আগে থেকেই সেখানে হাজির আবদুল মতিন, জহির রায়হান, গাজিউল হক, শহীদুল্লাহ কায়সার প্রমুখ।

সালামকে সেখানে দেখে আনোয়ার চমকে যায়।

সালাম তার মতো রিকশা টানে। রাজপথ থেকে গলিপথে তার বিচরণ।

চমক ভাঙে জহির সাহেবের কথায়। তিনি বলেন –  

রাস্তায় মিছিল করা বে-আইনি ঘোষিত হয়েছে।

সভা-সমিতি ভেঙে দেওয়া হচ্ছে।

মোহাজের নেতা-মন্ত্রীরা ছোটাছুটি জুড়েছেন।

আমলারা সন্ত্রস্ত।

পাড়ায় মাতব্বরদের ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে।

আদ্যপ্রান্ত দুর্নীতিতে মোড়া একটা সরকার চাইছে যে-কোনো মূল্যে আমাদের এই হরতাল ভাঙতে।

একটা জাতিকে মাতৃদুগ্ধহীন করে তুলতেই এই সকল কৌশলী প্রয়াস।

রাষ্ট্র সেটা নিচ্ছে।

একে আমারা মানি না। প্রতিবাদের অধিকার আমাদের বজায় রাখতে হবে।

রোশানারা বলে উঠলেন –

জনবিরোধী রাষ্ট্রীয় চক্রান্ত আমরা ছিঁড়ে ফেলবোই। ঠিক যেভাবে ইস্ট এণ্ড মেডিকেল স্টোর্সের ঘটনায় মালিক ইয়াকুব খাঁর বিচার আমরা গণআদালতে করেছিলাম। সহস্র জনতা তাকে শত টুকরো করেছিল। কী ছিল তার অপরাধ?

সরকার জানতো যে জনগণের চোখে ইয়াকুব খাঁ ছিলেন অপরাধী। ক্ষুধা পীড়িত এই বাংলায় তিনি যে বিপুল অর্থের সম্পত্তি গড়ে তুলেছিলেন, তা ছিল গণআদালতে বিচারাধীন। সেই আদালতের রায়ে তামাম বাংলা বেইমানি, ঘুষখোর, ধোঁকাবাজদের নিশ্চিহ্নকরণে যখন নামে, আমরাই ছিলাম তার সৈনিক। মনুষ্যত্ব, বিবেক, আর হৃদয়ের তোয়াক্কা না করা ইয়াকুব খাঁ জাল ওষুধের ব্যবসা করতেন। পাকিস্তানিরা সেটা জেনেও চুপ ছিল। আমার ভাই সেলিম মরেছিল ঐ ওষুধে ভেজাল থাকার কারণে। সেলিমের মৃত্যু এসেছে বেইমানী আর লোভের পথ বেয়ে। তাকে খুন করা হয়েছে। ঠিক যেভাবে পাকিস্তানিদের হাতে প্রতিদিন খুন হয়ে যাচ্ছেন শত বাঙালি ভাই। লুঠ হচ্ছে মা-বোনের ইজ্জত।

ধ্বনি উঠল –

আমরা নতুন বাংলা গড়বো।

মাতৃভাষার বাংলা গড়বো।

সম্প্রীতির বাংলা গড়বো।

আনোয়ার মাথা নোয়ালেন।

নামাজের সেজদা দেওয়ার মতো।

* * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  

রাতে ঘুম আসে না আতাউর রহমানের।

সারারাত বিছানায় এপাশ-ওপাশ করার পর ভোররাতে তিনি উঠে পড়েন।

পুলিশের পোশাক পরে পিস্তলটা কোমরে এঁটে নেন।

টুপিটা ঠিক করতে করতে কিছুটা ধমকের সুরই বিলকিসকে তিনি বলেন –

আমি উর্দু-বাংলা কিছু বুঝি না। আমার সোজা কথা, তোমার ছেলেকে সাবধান করে দিও। ব্রিগেডিয়ার ওসমান খ্যাপা সিংহের থেকেও ভয়ংকর। কলমের এক খোঁচায় চাকরিটা গেলে পথে বসবো সবাই।

রাগে কাঁপতে থাকেন আবুলের পুলিশ-বাপ।

আব্বার চিৎকারে ছেলেও তখন উঠে পড়েছে।

অনাগত ভবিষ্যৎ-অনিশ্চয়তার কথা শুনে মা-ও শিউরে উঠলেন।

বিলকিস বানু আবুলকে বোঝানোর চেষ্টা করলেন।

আমাদের মুখের দিকে তাকিয়ে তুই চুপ করে যেতে পারিস না। কি হবে এই সব করে? তোর আব্বার চাকরিটা গেলে আমরা খাবো কী?

আবুল চুপ করে থাকতে পারে না। পুলিশ বাবার মুখোমুখি হয় সে। আব্বার হাতটা পিস্তলের ওপর চেপে ধরে বলে –

গুলি চালাতেই যখন যাচ্ছ, তখন আমার মাথায় গুলি করে সেটা শুরু করতে পারো। করো গুলি। চালাও।

আতাউর থমকে যান।

বাপ-ছেলের কাণ্ডে বিলকিস বাকরুদ্ধ হন। দুই চোখ দিয়ে তার পানি বয়।

আবুলের উদ্ধত চোখ ক্ষিপ্র নেকড়ের চেয়েও তখন ভয়ঙ্কর। ছেলের এই চোখ আতাউর কখনো দেখেননি।

কি হলো থামলে কেন? চালাও গুলি। আমাকে মারলে তোমার চাকরি বাঁচবে। প্রমোশন হবে। সুখে থাকবে তোমার পরিবার। চালাও গুলি। স্বাধীনতা হীনতায় আমার যে আর বেঁচে থাকতে ইচ্ছা করে না। মৃত্যুকে প্রতিনিয়ত আমি প্রত্যক্ষ করি। আব্বা তোমরা হলে হুকুমের ক্রীতদাস।

নীরব দৃষ্টিতে বিছানায় বসে পড়ে আতাউর। মেরুদণ্ডহীন কাপুরুষ মনে হয় নিজেকে। সেই অনুভূতিতে সরকারী পোশাকটা খুলে ছুঁড়ে ফেলে দেন ঘরের কোণায়।

ছেলেটা ততক্ষণে ঘরের পোশাকেই আন্দোলনের পথে পা বাড়িয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে ইউক্যালিপ্টাস গাছগুলোর নিচে পুলিশের গাড়িগুলো তখন সার বেঁধে দাঁড়াচ্ছে।

পুলিশের কর্তারা রাস্তা জুড়ে পায়চারি করছেন। 

ভারী বুটের কাঁপন ধরা নিনাদ ভাসে বাতাসে।

প্রতিবাদের তপ্ত হাওয়া সরকারের সকাশে।

১৪৪ ধারা মানি না, মানবো না।

জান দিতে মোরা ডরাই না।  

 * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *

আমরা কমিউনিস্ট কী কমিউনিস্ট নয়, সেটা পরে বিচার্য। কিন্তু কমিউনিস্টরা মা-কে মা বলে বলে, আমরা মা বলতে পারবো না, সেটা হতে পারে না। আমরা গণতন্ত্রের জন্য লড়াকু ছেলেমেয়েদের কুর্ণিশ জানাই। সালাম জানাই।  

পুলিশের চোখে চোখ রেখে কথাটা বললেন প্রফেসর জে বি।

অধ্যাপক জয়ন্ত বোস।

মেডিকেল কলেজের দক্ষিণের লোহার গেটটা বোধহয় কেউ খোলেনি।

সম্ভবত পুলিশ সেটা ভেঙেই ঢোকে।

ক্যাম্পাসে পুলিশ।

স্বৈরশাসকের দলদাস পুলিশ।

দুর্নীতিগ্রস্তদের রক্ষাকারী পুলিশ।

প্রতিবাদীর ভিড় বাড়তে থাকে। প্রতিবাদে মুখরিত স্লোগান চওড়া হয়।

চিৎকার আর স্লোগানে পুলিশি তৎপরতা বাড়ে।

অস্ত্র আর বুলেটের ঝলকানি আমরা পরোয়া করি না। পুলিশের জুলুম চলবে না। ১৪৪ ধারা মানি না।

পুলিশ তুমি হায়! হায়! রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই।

পুলিশকেই বেড়ির মত ঘিরে ধরে বাংলাভাষা। স্লোগান চলতে থাকে।

শব্দ-পাগল পুলিশ গুলি চালায়।

টিয়ার গ্যাসের সেল ফাটে।

ছাত্রাবাস লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি চলে।

কৃষ্ণচূড়া গাছটা থেকে সদ্য ফোটা লাল ফুলগুলো ঝরে পড়ে।

পাঁচ ইঞ্চি দেওয়াল ভেদ করে পড়ার টেবিল, শোয়ার খাটিয়া বুলেট বিদ্ধ হয়।

এলোপাতাড়ি গুলিতে সকলেরই আঘাত হাঁটুর ওপরে।

এগারো, তিন ও সাত নম্বর মেডিকেল ছাত্রাবাসে নিহতের সংখ্যা বেশি।

এখানে মুসলিম ছাত্রলীগের একজন সদস্যও নেই।

আছে মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষার লড়াকু বাঙালির লাশ।

প্রথম রাউন্ডের গুলিতেই নিহত হন আবুল বরকত।

রেডিও খবর শোনায় –

পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষে বৃহস্পতি ও শুক্রবারে মোট ৯ জন নিহত হয়েছেন।

রফিকউদ্দিন আহমদ, শফিউর রহমান, আবদুস সালাম, আবদুল জব্বার, আবদুল আউয়াল, কিশোর অহিউল্লাহ, সিরাজুদ্দিন সহ ২৬ জন নিহতের খবর দেয় সূত্র। চারশোর বেশি প্রতিবাদী আহত হন।

শহীদের তাজা রক্তে ঢাকার রাজপথ লাল হয়ে যায়।

একুশ অমর হয়।

সংখ্যাগরিষ্ঠ মানুষের ভাষা স্বীকৃতির লড়াই জোরালো ভাবে চলে অর্ধসপ্তাহকাল।

চব্বিশের পর আন্দোলন স্থিমিত হয়।

মায়ের চোখের পানিতে, রমনার পথ যায় ভিজে।

জাগরণের দিগন্ত-বিসারী প্লাবন সেজে

শহীদের রক্ত, দেশপ্রেমের ডাক দিয়ে যায়।

 * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *

ভাষাকেন্দ্রিক কর্তৃত্বকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলাই ছিল পাকিস্তানি শাসকদের অন্যতম লক্ষ্য। পাকিস্তানি শাসকদের ধারণা ছিল বাংলা ভাষার জন্য যারা লড়াই করছে তাদের কোনোভাবেই মাথা তুলতে দিলে হবে না।

১০ই এপ্রিল ১৯৫২, মাতৃভাষার স্বীকৃতি দেওয়ার প্রশ্নে ভোটাভুটি হয়।

৪১-১২ ভোটে বাংলা হেরে যায়।

এই ১২ জনের মধ্যে আবার দু’জন ছিলেন পাঞ্জাবি সদস্য। তারা বাংলা ভাষার পক্ষে ভোট দিয়েছিলেন।

অথচ নূর আহমদ, যিনি বাংলা ভাষার স্বীকৃতি প্রস্তাব এনেছিলেন, স্বয়ং তিনি ভোটাভুটির সময় বাংলা ভাষার বিপক্ষে ভোট দিলেন।

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন বাঙালি জীবনের এক বৈচিত্র্যময় উজ্জ্বল অধ্যায়।

একুশ হল শাসকের বিরুদ্ধাচরণের সংগ্রামী বার্তা।

স্বাধীনতার সলতে।

বাহান্নর ভাষা আন্দোলন রাজনৈতিক দাসত্বের শেকল ভাঙার শপথ।

শুধু এদেশের রাজনীতির ক্ষেত্রে নয়, শিল্প-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এক নতুন চেতনার জন্ম দেয়। জাতীয়তাবাদী চেতনা।

সেই চেতনা অসাম্প্রদায়িক, গণতান্ত্রিক এবং সামাজিক মূল্যবোধসঞ্জাত।

বাঙালির শিল্প-সাহিত্যে তার প্রতিফলন আমরা লক্ষ্য করি।

আপাত বিচারে একুশের আন্দোলনকে মাতৃভাষার স্ব-শাসনাধিকার প্রতিষ্ঠার এক সাংস্কৃতিক অভিঘাত বলে মনে হলেও ব্যাপকতর বিচারে এই আন্দোলন বাঙালি জাতিকে ইতিহাসশ্রয়ী করে তুলেছিল।

এমন এক নতুন মানসিকতার জন্ম হয়, যা ইসলামী সংকীর্ণতা মুক্ত গণসচেতনতায় ঋদ্ধ,

যা এক নতুন সিদ্ধান্তে উপনীত হতে শেখায়,

যেখানে মুসলমান একটি ধর্মীয় সম্প্রদায় মাত্র।

সেটি কোনো জাতি নয়।

বাঙালি হয় জাতি পরিচয়।

ধর্মীয় সম্প্রদায়ের ভিত্তিতে নয়,

সার্বভৌম রাষ্ট্রের দাবি হয়ে ওঠে বাঙালির নিজস্ব নির্ণয়।

হুমায়ূন আজাদের কথায় –

বাংলা ভাষা

তোমার দীর্ঘশ্বাসের নাম চন্ডীদাস

শতাব্দী কাঁপানো উল্লাসের নাম মধুসূদন

তোমার থরোথরো প্রেমের নাম রবীন্দ্রনাথ

বিজন অশ্রুবিন্দুর নাম জীবনানন্দ

তোমার বিদ্রোহের নাম নজরুল ইসলাম। 

 * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *  * * * * * * * * * *

গণবিদ্রোহের

গৌরবমণ্ডিত ক্রান্তিকাল

একুশে ফেব্রুয়ারি তোমাকে সালাম!

* লেখক, ফারাক্কা এস এন এইচ কলেজের সমাজবিদ্যার অধ্যাপক

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in