প্রাণঘাতী করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে দুই বছর পর সবরকম অনুষ্ঠান বন্ধ ছিল। তাই এবার বাংলা বর্ষবরণে হাজারো মানুষের মিলনমেলায় বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত হলো মঙ্গল শোভাযাত্রা। মহামারীর গ্লানি ভুলে সুসময়ের বার্তা নিয়ে এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রা।
আজ বৃহস্পতিবার (১৪ এপ্রিল) সকাল ৯টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) শিক্ষক ছাত্র কেন্দ্রের (টিএসসি) সামনে থেকে বের হয় শোভাযাত্রাটি। ‘নির্মল করো, মঙ্গল করে মলিন মর্ম মুছায়ে’ প্রতিপাদ্যে বের হওয়া শোভাযাত্রার গন্তব্য ছিল ঢাবি ভিসির বাসভবন। ভিসির বাসভবনের সামনে স্মৃতি চিরন্তন ঘুরে শোভাযাত্রাটি আবার টিএসসিতে ফিরে যায়।
এছাড়াও সারাদেশের বিভিন্ন স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় সহ বিভাগী, জেলা ও উপজেলা পর্যায়েও পহেলা বৈশাখ উপলক্ষে মঙ্গল শোভাযাত্রাসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালিত হচ্ছে। এসব শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীদের কণ্ঠে উচ্চারিত হয়েছে খুন, ধর্ষণ, যৌন নিপীড়ন, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে জেগে ওঠার প্রত্যয়। অতীতের গ্লানি মুছে দিয়ে অনাগত সুদিনের পাশাপাশি স্বাভাবিক জীবনে ফেরার তাড়না ছিল শোভাযাত্রার শিল্পকাঠামোয়।
ঢাকঢোলের বাদ্যি আর তালে তালে সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের ছন্দোবদ্ধ নৃত্যে আনন্দ-উৎসবমুখর হয়ে ওঠে শোভাযাত্রা। বাংলাদেশে কাজ করেন এমন অনেক বিদেশিও বর্ণিল পোশাকে শোভাযাত্রায় অংশ নেন। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারীরা জানান, দুই বছর পর প্রাণের উৎসবে ফিরতে পেরে তাঁরা উচ্ছসিত।
প্রতিবারের মতো মঙ্গল শোভাযাত্রায় নিরাপত্তার কড়াকড়ি থাকলেও তারুণ্যের উচ্ছ্বাসের কমতি দেখা যায়নি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শোভাযাত্রায়। ক্যাম্পাসের প্রতিটি প্রবেশ মুখে ছিল পুলিশের চেকপোস্ট। এছাড়া পুরো বিশ্ববিদ্যালয় জুড়ে ছিল পুলিশ, RAB, সোয়াতসহ বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর টহল। একইভাবে সারাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও জেলা-উপজেলা পর্যায়েও নিশ্চিত করা হয়েছে কড়া নিরাপত্তা।
ঢাবি ভিসি মোহাম্মদ আখতারুজ্জামান বলেন, দুই বছর পর মঙ্গল শোভাযাত্রা করতে পেরে আমরা আনন্দিত। দুই বছর পর এবার পহেলা বৈশাখ প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে পেয়েছে। মানুষের প্রাণের উচ্ছ্বাসে জায়গা পহেলা বৈশাখের। এটি সকল শ্রেণি-পেশার মানুষের অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রাণের একটা উৎসব।
তিনি বলেন, সব সম্প্রদায়ের মানুষ মঙ্গল শোভাযাত্রায় অংশ নিতে পারে বলেই এই উৎসবটি অসম্প্রদায়িক মানবিক চেতনা জাগ্রত করে। ধর্ম যার যার, কিন্তু উৎসব সকলের। মানুষের মধ্যে ধর্মীয় সম্প্রতি, মানবিক কল্যাণ সুদৃঢ় হোক সেটা প্রত্যাশা করি।
উল্লেখ্য, গত শতকের ৮০ এর দশকে বাংলাদেশে সামরিক শাসনের শেকল ভাঙার আহ্বানে বৈশাখ মাসের প্রথম দিনে ঢাবির চারুকলা থেকে শোভাযাত্রা বের হয়। পরে তা মঙ্গল শোভাযাত্রা নাম ধারণ করে। ২০১৬ সালে ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতিও পায় এই কর্মসূচি।
মহামারি হানা দেওয়ার পর ২০২০ সালে বর্ষবরণের আয়োজন ছিল সংক্ষিপ্ত, সে বছর মঙ্গল শোভাযাত্রাও হয়নি। ২০২১ সালে মঙ্গল শোভাযাত্রা হলেও তা ছিল প্রতীকী, সেখানে সবার অংশগ্রহণের সুযোগও ছিল না।
রমনার বটমূলে সুরের মূর্ছনা
একদিকে করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে গেলো দুই বছর ঐতিহাসিক রমনার বটমূলে পহেলা বৈশাখের আয়োজন বন্ধ থাকলে এবার ফিরেছে নতুন রূপে। বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে নেওয়া হয়েছে নানা উদ্যোগ। রমনা বটমূলে ছায়ানটের আয়োজনে সুরের মূর্ছনায় মুগ্ধ সাধারণ মানুষ।
আজ (১৪ এপ্রিল) সকাল ৬টার পর বেহালা, সেতার, বাঁশি ও এসরাজসহ বিভিন্ন বাদ্যযন্ত্রের শব্দ দিয়ে শুরু হয় বর্ষবরণ উৎসব। এরপর সম্মিলিত কণ্ঠে ছায়ানটের শিল্পীরা রবীন্দ্রসংগীত ‘মন, জাগ মঙ্গললোকে’ গানের মধ্য দিয়ে নতুন বঙ্গাব্দ ১৪২৯–কে স্বাগত জানান।
এবারের মূল প্রতিপাদ্য- ‘নব আনন্দে জাগো’। এর ওপর ভিত্তি করে পুরো অনুষ্ঠানটি সাজানো হয়েছে। ছায়ানটের ৮৫ জন শিল্পী বর্ষবরণ উৎসবে অংশ নেন। ২০১৯ সালে সর্বশেষ তাঁরা রমনার বটমূলে বসেছিলেন। দুই বছরের বিরতির পর আবারও চেনা জায়গায় ফিরল সংগঠনটি। মঞ্চের সামনে বসে বহু দর্শককে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান উপভোগ করতে দেখা গেছে। তাদের অনেকেই সুর ধরেছেন গানের তালে তালে।
আয়োজনে রয়েছে মোট ৩৭টি গান-কবিতা। প্রতিপাদ্যের ওপর ভিত্তি করে একক, সম্মেলক গান, অন্যান্য গান ও কবিতা সাজানো। শতাধিক শিল্পীর অংশগ্রহণে দুই ঘণ্টার এই আয়োজন সাজানো হয়েছে, যা ভোর সোয়া ৬টায় শুরু হয়ে শেষ হয়েছে সকাল সাড়ে ৮টায়। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, অতুলপ্রসাদ সেন, দ্বিজেন্দ্রলাল রায়, রজনীকান্ত সেন, লালন শাহ্, মুকুন্দ দাস, অজয় ভট্টাচার্য, শাহ্ আবদুল করিম, কুটি মনসুর, সলিল চৌধুরীর রচনা থেকে পুরো আয়োজনটি সাজানো। যার শেষে ছিল জাতীয় সংগীত। অনুষ্ঠানের সমাপ্তি হয়েছে ছায়ানট-সভাপতি সন্জীদা খাতুনের শুভেচ্ছা কথন দিয়ে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন