আজ থেকে প্রায় ৩০০ বছর আগে রাজস্থানের মারওয়ার অঞ্চলে বনাঞ্চল রক্ষার জন্য বিষ্ণোই আন্দোলন গড়ে ওঠে। অমৃতা দেবী সহ খেজারলি এবং তাঁর আশেপাশের গ্রামের বিষ্ণোই গ্রামবাসীরা এই আন্দোলন গড়ে তোলেন। একটি নতুন প্রাসাদের জন্য রাজার সৈন্যদের দ্বারা কাটা পড়ার হাত থেকে পবিত্র গাছগুলিকে বাঁচানোই ছিল এই আন্দোলনের প্রধান লক্ষ্য। পরিবেশ আন্দোলনের ধারায় এটি ভারতের মাটিতে ঘটা প্রথম ঘটনা।
প্রসঙ্গত, রাজস্থানের পশ্চিমাঞ্চল অর্থাৎ থর মরুভূমি অঞ্চল, এবং সেই সঙ্গে হরিয়ানা এবং পাঞ্জাবের কিছু অঞ্চল জুড়ে বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষের বাস। মরুভূমি অঞ্চলে বসবাস করার কারণে অতীত থেকেই তারা বৃষ্টির জল সংরক্ষণকে এবং বনাঞ্চলকে জীবনের অংশ করে তোলে। সহজ কৃষি কৌশল ব্যবহার করে তারা মরুঅঞ্চলে ফসল ফলাতে দক্ষ হয়। দৈনন্দিন জীবনে তাদের কর্মধারা মরুভূমির পরিবেশগত অবস্থাকে সুস্থায়ী করতে সাহায্য করে।
এমন চরমভাবে নিবেদিত পরিবেশ রক্ষাকারী পরিচিতির বিষ্ণোই সম্প্রদায়, ধর্মীয় রীতিতে পুরোপুরি হিন্দু নয়। মৃতদেহ পোড়ানোর মৌলিক হিন্দু আচার তারা পরিত্যাগ করেছিলেন। কাঠ ও গাছ বাঁচাতে তারা মৃতদের দাফন করেন। আবার বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের মানুষ গুরু মহারাজ জাম্বাজীর শিক্ষা দ্বারা চালিত হন। গুরু মহারাজ জাম্বাজী ১৪৮৫ সালে বিষ্ণোই বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করেছিলেন এবং গাছ ও প্রাণীর ক্ষতি নিষিদ্ধ করার নীতিগুলি তৈরি করেছিলেন। সেইগুলি ছিল প্রাকৃতিক পরিবেশ এবং মানব সম্প্রদায়কে একাত্ম করে তোলার নীতি।
বিষ্ণোই ঐতিহ্যের এই জীবনাচার পশ্চিম রাজস্থানের মারওয়ারের রাজপুত প্রধান মহারাজ জাম্বাজীকে গুরু জাম্বেশ্বরের আসনে বসায়। তিনি যে ২৯টি নীতির আদেশ প্রণয়ন করেছিলেন, যা একজন বিষ্ণোই মৃত্যুর আগে পর্যন্ত অনুসরণ করবেন বলে আশা করা হয়। এর মধ্যে ছয়টি অসাধারণ। সেই ছয়টি আদেশনীতি দৈনন্দিন জীবনাচারে পরিবেশগত সুরক্ষা এবং সমস্ত জীবন্ত প্রাণীর প্রতি সমবেদনাকে জীবনাভ্যাসে পরিণত করে। একজন বিষ্ণোই পরিত্যক্ত প্রাণীদের আশ্রয় দেওয়ার নির্দেশ কঠোরভাবে পালন করে। শুধু গাছ কাটা নিষিদ্ধ করা হয় না, তারা তাদের চারপাশের সকল বন্যপ্রাণীদের সঙ্গে প্রকৃতির সকল সম্পদকে ভাগাভাগি করার একটি সুস্থায়ী ব্যবস্থাকে পাকাপাকিভাবে গড়ে তোলার যৌথ উদ্যোগ সম্প্রদায়গত রীতিতে অনুসরণ করেন।
এই জীবনধারায় বিপত্তি ঘটে ১৭৩৭ সালে। যখন যোধপুরের মহারাজা নতুন প্রাসাদের জন্য খেজরি গাছের খোঁজ করেন এবং কর্মকর্তাদের কাছ থেকে জানতে পারেন যে খেজেরলি গ্রামে প্রচুর বড়ো বড়ো গাছ আছে, যেগুলির বয়সেও শতবর্ষ প্রাচীন। তিনি তখন সেই গাছ কাটার নির্দেশ দেন।
কর্মকর্তারা সৈন্য বাহিনী নিয়ে সেই গাছ কাটতে গ্রামের ধারে এলে প্রতিরোধের মুখোমুখি হন। গ্রামবাসীরা তাদের বিষ্ণোই বিশ্বাস থেকে এই অঞ্চলের পবিত্র গাছগুলির হত্যা মেনে নিতে পারে না। একজন বিষ্ণোই বয়স্কা অমৃতা দেবী তাঁর সম্প্রদায়ের সকল মহিলা ও শিশুদের সমবেত করে গাছগুলিকে আলিঙ্গন করে থাকেন যাতে রাজার লোকেরা গাছ কাটার আগে তাঁদেরকে কাটতে বাধ্য হন। তারা গাছগুলোকে জড়িয়ে ধরেন। এই প্রতিরোধের ধারা জোরালো আকার নিলে “রাজার আদেশের দোহাই” দিয়ে মানুষ সহ গাছ কাটার কাজে নামেন রাজার সেনারা। কুড়ালের আঘাতে বিষ্ণোই নারী ও শিশুর দেহ টুকরো হওয়ার পরেই গাছগুলিকে টুকরো করা হয়।
এই আন্দোলনে ৩৬৩ জন বিষ্ণোই গ্রামবাসী নিহত হন। গাছের শহীদরা পরিবেশ বিরোধী সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়ায় প্রাণ হারান। রাজা যখন এই ঘটনাগুলি সম্পর্কে জানতে পারেন, তিনি গ্রামে ছুটে আসেন এবং মানুষের কাছে ক্ষমা চান। সৈন্যদের তিনি গাছ কাটার কাজ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। গুরু মহারাজ জাম্বেশ্বরের অহিংস নীতি মেনে শীঘ্রই তিনি বিষ্ণোই রাজ্যকে একটি সংরক্ষিত এলাকা হিসেবে মনোনীত করেন। গাছ এবং প্রাণীর ক্ষতি করে এমন কাজগুলিকে তিনি নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। সেই আইন আজও এই অঞ্চলে বিদ্যমান।
পরিবেশ আন্দোলনের ইতিহাসে আজ লেখা হয় - তিন শতাধিক বছর আগে রাজস্থানের বিষ্ণোই সম্প্রদায়ের এই সদস্যরা, অমৃতা দেবী নামক এক মহিলার নেতৃত্বে, তাদের পবিত্র খেজরি গাছগুলিকে আঁকড়ে ধরে তাদের জীবন বিসর্জন দিয়েছিলেন।
পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ের সেই সকল শহীদকে পরিবেশ দিবসে স্মরণ করেই আগামীর অঙ্গীকার গ্রহণ করতে হয়।
বিষ্ণোই আন্দোলন প্রসঙ্গে যে তথ্যসূত্রের আশ্রয় নেওয়া যেতে পারে -
K.S. Sankhala, and P. Jackson, (1985). “People, trees and antelopes in the Indian desert”, in J.A. McNeely and D. Pitt (ed.), Culture and Conservation: The Human Dimensions in Environmental Planning. London: Croom Helm. Pp. 205-210.
Madheva Gadgil, and Ramachandra Guha, (1992). This Fissured Land: An Ecological History of India. New Delhi: Oxford University Press. P. 108.
Vandana Bishnoi and N.R. Bishnoi, (2000). “Bishnoism: An Eco-friendly Religion”, in Kishna Ram Bishnoi and Narsi Ram Bishnoi (eds.), Religion and Environment. New Delhi: Commonwealth Publishers. P. 247.
Lindsay Jones, (2005). Encyclopedia of Religion. Volume 4. Detroit: Macmillan Reference USA. P. 2622.
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন