বাহান্নর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন শুধুমাত্র বাংলাদেশই নয়, এই উপমহাদেশের গণ্ডি পেরিয়ে পৃথিবীর নানা প্রান্তে ছড়িয়ে থাকা কোটি কোটি বাঙালির গর্ব, অহংকার, আত্মমর্যাদা, স্বাধিকার ও চেতনাবোধকে জাগিয়ে আন্দোলিত করে। আবার শোষণ, অত্যাচার, বঞ্চনা ও অধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্তির সোপানে অগ্রসর হতেও মুক্তিকামী মানুষকে প্রাণিত করে। এই ভাষা আন্দোলন বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাবলির অন্যতম।
এই আন্দোলনের মধ্য দিয়েই সেখানকার মানুষের যে চেতনা ও জাতীয়তাবোধের যে উন্মেষ ঘটেছে,তা আজও সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রামের প্রেরণার উৎস হয়ে রয়েছে। বাংলাদেশের যেকোনো গণতান্ত্রিক আন্দোলন, দাবি আদায়ের সংগ্রাম ও শোষণ-নির্যাতনের বিরুদ্ধে লড়াইকে উজ্জীবিত করে ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন। বলা যায় বাঙালির ইতিহাসে ভাষা আন্দোলনের প্রভাব বিপুল এবং সুদূরপ্রসারী। এই ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের পথ বেয়েই পরবর্তী সময়ে পূর্ববঙ্গে সমস্ত আন্দোলন-সংগ্রাম বিস্তৃত ও বিকশিত হয়েছে। সেই প্রবাহেই এসেছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও গৌরবোজ্জ্বল মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীনতা অর্জন। স্বাধীন বাংলাদেশের দৃপ্ত উদ্ভাস।
মাতৃভাষার অধিকার ও মর্যাদা রক্ষার জন্য এমন আত্মত্যাগ ও রক্তস্নাত সংগ্রাম পৃথিবীর ইতিহাসে বিরল। যদিও ১৯৬১ সালের ১৯ মে আসামের বরাক উপত্যকার ভাষা আন্দোলনে এগারো জনের শহিদ হবার ঘটনাও ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে একটি আলোকোজ্জ্বল অধ্যায় হিসেবেই বিধৃত রয়েছে। ১৯৫২ সালের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের গুরুত্বকে মর্যাদা দিয়ে ইউনেস্কো ১৯৯৯ সালে 'একুশে ফেব্রুয়ারি' দিনটিকে "আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস" হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে।
ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট
একুশের ভাষা আন্দোলনের তাৎপর্য অনুধাবন করার জন্য আমাদের এর পটভূমিকার দিকে একবার দৃষ্টি ফেরানো প্রয়োজন। ইংরেজদের কূটকৌশলে ১৯৪৭ সালে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে এই উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তান - এই দুই দেশে বিভক্ত হলো। কংগ্রেস ও মুসলিম লিগের হাতে যথাক্রমে ভারত ও পাকিস্তানের ক্ষমতা তুলে দিয়ে ব্রিটিশ শাসক ভারত ত্যাগ করে, পিছনে রেখে যায় সাম্প্রদায়িকতার বীজ। লক্ষণীয় বিষয় হলো, দেশভাগের পর পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী ও মুসলিম লিগ বাংলার স্বার্থের কথা ভাবেনি। তখন বাঙালিরা জনসংখ্যার বিচারে বেশি হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসনে এবং পূর্ববঙ্গে প্রাধান্য ছিল অবাঙালিদেরই। এমনকী মুসলিম লিগের বাঙালি সদস্যরাও এই মনোভাব নিয়েই চলেছেন। হয়তো তাঁদের মধ্যে ক্ষমতা হারানোর আশংকা ছিল।
পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠন হবার কিছু আগে এবং পরে শীর্ষস্তরের মুসলিম লিগ নেতারা নানা উপলক্ষে বলতে থাকেন যে, 'উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা'। তখন সংগঠিতভাবে না হলেও এর প্রতিবাদও হতে থাকে। ওই সময়ে 'দৈনিক ইত্তেহাদে',' দৈনিক আজাদ',সাপ্তাহিক 'মিল্লাত',মাসিক 'কৃষ্টি', 'সওগাদ' প্রভৃতি পত্রপত্রিকায় লেখক-অধ্যাপক-সাংবাদিক সহ বিশিষ্ট ব্যক্তিরা বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা করার দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরেন। তবে একথাও সত্য, ওই সময়ে কিছু সংখ্যক বাঙালি কবি, লেখক, সাংবাদিক, শিক্ষক যেমন উর্দু ভাষার পক্ষে মত প্রকাশ করেছিলেন,তেমনি ক্ষমতাসীন মুসলিম লিগের শীর্ষ স্থানীয় কয়েকজন জোট বেঁধে পাকিস্তান গণপরিষদে রাষ্ট্রভাষা বাংলার প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভোট দিয়েছিলেন।
পাকিস্তানকে ঘিরে বাঙালি মুসলমানদের অনেক স্বপ্ন ছিল। কিন্তু পাকিস্তানি জমানার শুরুতেই রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে শাসকগোষ্ঠীর বৈষম্যমূলক নীতি ছাত্র-শিক্ষক-বুদ্ধিজীবী সহ অন্যান্য অংশের মানুষকেও ক্ষুব্ধ করে তোলে। এই ক্ষোভের প্রথম সংঘবদ্ধ প্রকাশ ঘটে সরকারি কর্মচারীদের একাংশের মধ্যে। তখন ১৯৪৭-এর নভেম্বর, সদ্য প্রকাশিত এনভেলাপ, পোস্টকার্ড, ডাকটিকিট ইত্যাদিতে শুধু ইংরেজি ও উর্দু লেখা, বাংলা লেখা নেই। এর প্রতিবাদে নীলখেত ব্যারাকের অনেক কর্মচারী সভা-মিছিল করে বাংলার পক্ষে তাদের প্রতিক্রিয়া জানান। ছাত্রদের অনেকে কর্মচারীদের ওই প্রতিবাদ মিছিলে যোগ দেয়। মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে: 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই','সব কিছুতে বাংলা চাই','উর্দুর সঙ্গে বিরোধ নাই' ইত্যাদি। স্বতঃস্ফূর্তভাবেই এই প্রতিবাদ কর্মসূচি সংগঠিত হয়।
এরপর করাচিতে অনুষ্ঠিত শিক্ষা সম্মেলনে (২৭ নভেম্বর,১৯৪৭) রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা করার সুপারিশের বিরুদ্ধে আরও সংঘবদ্ধ প্রতিবাদ প্রকাশ পায়। ৬ ডিসেম্বর (১৯৪৭) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ঢাকার বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রদের সমবেত প্রচেষ্টায় এক প্রতিবাদ সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভায় ছাত্রদের সঙ্গে অংশ নেন বেশ কয়েকজন শিক্ষক,বুদ্ধিজীবী এবং সরকারি কর্মচারী। কিন্তু এতেও সরকারের কোনো সংবিৎ ফেরেনি। তাই বাংলার দাবি জোরালো করে তুলতে ছাত্র, শিক্ষক, বুদ্ধিজীবীদের পাশাপাশি তমদ্দুন মজলিস, ছাত্রলিগ, গণতান্ত্রিক যুবলিগের নেতা-কর্মীদের উপস্থিতিতে গঠিত হয় 'রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'।
প্রথম রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ গঠনের পর শুরু হয় রাষ্ট্রভাষা বাংলার পক্ষে স্বাক্ষর সংগ্রহ, প্রচারপত্র বিলি প্রভৃতি বিভিন্ন ধরনের তৎপরতা। এরমধ্যে পাকিস্তান গণপরিষদের অধিবেশন শুরু হলে ২৩ ফেব্রুয়ারি(১৯৪৮) ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত গণপরিষদের ব্যবহারিক ভাষা হিসেবে ইংরেজি ও উর্দুর সঙ্গে বাংলাকেও অন্তর্ভুক্ত করার প্রস্তাব আনেন। কিন্তু মুসলিম লিগের বাঙালি-অবাঙালি সদস্যদের বিরোধিতায় সেই প্রস্তাব বাতিল হয়ে যায়। গণপরিষদের ওই অগণতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের খবরে ঢাকার ছাত্র সমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া দেখা দেয়।
১১ মার্চ পুলিশের বেপরোয়া লাঠিচার্জ, সরকারি গুন্ডা বাহিনীর আক্রমণ, নির্বিচারে গ্রেপ্তার সত্ত্বেও পূর্ববাংলা জুড়ে হরতাল, সমাবেশ, প্রতিবাদী মিছিল সংগঠিত হয়। ঢাকায় পিকেটিং-এ সরাসরি নেতৃত্ব দেন শামসুল হক, শেখ মুজিবুর রহমান, আলি আহাদ, মোহাম্মদ তোয়াহা, শওকত আলি, নইমুদ্দিন আহমদ, কাজি গোলাম মাহবুব প্রমুখ। এই অবস্থায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবার আশংকায় মুখ্যমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন সংগ্রাম পরিষদের কাছে শান্তি চুক্তির প্রস্তাব পাঠান। সেইমতো আন্দোলন মাঝপথে স্থগিত রাখা হয় এবং জেলের বাইরে থাকা সংগ্রাম পরিষদের নেতারা ১৫ মার্চ মুখ্যমন্ত্রীর সঙ্গে আট দফা চুক্তি করেন এবং জেলে আটক নেতারা মুক্তি পান।
এই পরিস্থিতির মধ্যে ১৯ মার্চ (১৯৪৮) পাকিস্তানের গভর্নর জেনারেল মোহাম্মদ আলি জিন্নাহ প্রথম সরকারি সফরে ঢাকা আসেন। ২১ মার্চ রমনা রেসকোর্সের এক সমাবেশে তিনি বলেন,পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে একমাত্র উর্দু। যারা এর বিরুদ্ধে কথা বলে তারা পাকিস্তানের দুশমন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনের জন্য তিনি কমিউনিস্ট ও বিদেশি চরদের দায়ী করে বলেন যে, এদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। এরপর ২৪ মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিশেষ সমাবর্তন অনুষ্ঠানেও বক্তব্য রাখতে গিয়ে তিনি বলেন, উর্দু, কেবল উর্দুই হবে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা। জিন্নাহর এই বক্তব্যের বিরুদ্ধে হল ভরতি ছাত্রদের মধ্যে আব্দুল মতিন (পরবর্তীকালে তিনি 'ভাষা মতিন' নামে পরিচিতি লাভ করেন) তাঁর কয়েকজন সহযাত্রীদের নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে 'নো-নো-নো' বলে দৃপ্ত কণ্ঠে প্রতিবাদ জানান। জিন্নাহ ঢাকা থেকে ফিরে যাবার আগে সরকারের সঙ্গে সংগ্রাম কমিটির চুক্তি বাতিল করে দিয়ে যান এবং রাষ্ট্রভাষার পক্ষে তাঁর অবস্থানে অনড় থাকেন।
১৯৪৯ সাল থেকে ১৯৫১ সালের সময়পর্বে বাংলা ভাষাকে নিয়ে নানা ষড়যন্ত্র চলে। ১৯৫০ সালের ১৮ এপ্রিল পূর্ব বাংলার বিভিন্ন জেলার ২০টি কেন্দ্রে আরবি হরফে বাংলা ভাষার মাধ্যমে প্রাপ্ত বয়স্কদের প্রাথমিক শিক্ষা দেবার কাজ শুরু হয়। এর বিরুদ্ধে পূর্ব বাংলার সর্বত্র প্রতিবাদের ঝড় উঠে। এর আগে রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে সুসংগঠিত এবং সঠিক দিশায় পরিচালনার জন্য ১১ মার্চ(১৯৫০) ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে ছাত্রদের একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়। এই সভা থেকে আব্দুল মতিনকে আহ্বায়ক করে ১১ সদস্য বিশিষ্ট 'বিশ্ববিদ্যালয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ' গড়ে ওঠে। ১৯৫০ থেকে ১৯৫২ এই তিন বছর আব্দুল মতিনের নেতৃত্বে সংগ্রাম পরিষদের নানা উদ্যোগে ভাষা আন্দোলনে নতুন আবহ সৃষ্টি হয়।
১৯৫২ সালের ২৭ জানুয়ারি (মতান্তরে ২৬ জানুয়ারি) পাকিস্তানের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী খাজা নাজিমুদ্দিন ঢাকার পল্টন ময়দানে বক্তৃতা দিতে গিয়ে বললেন, 'পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা উর্দুই হতে যাচ্ছে, আর পাকিস্তান হবে একটি ইসলামি রাষ্ট্র।' তাঁর এই বক্তব্যে যেন শুকনো বারুদে অগ্নিসংযোগ হয়। গোটা ছাত্র সমাজ এই বক্তব্যের প্রতিবাদে সোচ্চার হয়ে ওঠে। এই ঘটনার প্রতিবাদে ২৯ জানুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে প্রতিবাদ সভা এবং ৩০ জানুয়ারি সমস্ত শিক্ষায়তনে ধর্মঘট অনুষ্ঠিত হয়। এই ধর্মঘটকে কেন্দ্রকরে ছাত্রদের সুবিশাল মিছিল হয় এবং এতে সাধারণ মানুষও স্বতঃস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেন। মিছিল শেষে ৪ ফেব্রুয়ারি ঢাকা শহরে ধর্মঘটের আহ্বান জানানো হয়। ৩১ জানুয়ারি ঢাকার বার লাইব্রেরির হলে ছাত্রলিগ ও যুবলিগ সহ বিভিন্ন গণতান্ত্রিক ও প্রগতিশীল ছাত্র-যুবক এবং রাজনৈতিক সংগঠনের এক সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভায় সভাপতিত্ব করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামি মুসলিম লিগের সভাপতি মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। এই সভা থেকে গড়ে ওঠে 'সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ'। এর আহ্বায়ক নির্বাচিত হন কাজি গোলাম মাহবুব। প্রসঙ্গত, ওই সময় কমিউনিস্ট পার্টি কার্যত নিষিদ্ধ এবং নেতৃবৃন্দ আত্মগোপন অবস্থায় থাকায় যুবলিগই এর প্রতিনিধিত্ব করে।
পূর্বের সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৪ ফেব্রুয়ারি বেলা ১১ টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের ছাত্রছাত্রীদের এক বিশাল সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে প্রায় দশ হাজার ছাত্রছাত্রী মিছিল করে। মিছিল থেকে স্লোগান ওঠে 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'রাজবন্দিদের মুক্তি চাই', 'আরবি হরফে বাংলা লেখা চলবেনা' ইত্যাদি। এদিন বিকেলে সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের উদ্যোগে অনুষ্ঠিত জনসভা থেকে সিদ্ধান্ত হয় - বাংলা ভাষার দাবি প্রতিষ্ঠিত না হওয়া পর্যন্ত অবিরাম সংগ্রাম চলবে। সেইসঙ্গে অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলাকে মর্যাদা দানের ঘোষণা সহ একুশ দফা দাবি আদায়ের লক্ষ্যে ২১ ফেব্রুয়ারি পূর্ব বাংলা জুড়ে হরতাল, সভা-সমাবেশ ও প্রতিবাদী মিছিলের ডাক দেওয়া হয়।
এদিকে ছাত্রদের এই কর্মসূচিকে বানচাল করতে ২০ ফেব্রুয়ারি সরকার ১৪৪ ধারা জারি করে এক মাসের জন্য ঢাকা শহরে সভা-সমাবেশ নিষিদ্ধ ঘোষণা করে। এই ঘোষণায় ছাত্র সমাজের মধ্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া তৈরি হয়।স্বতঃস্ফূর্ত আবগে তারা ঘোষণা করে : '১৪৪ ধারা মানিনা,মানব না'। সরকারের জারি করা ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের বিষয় নিয়ে আলোচনার জন্য ২০ ফেব্রুয়ারি রাতে দেশের নেতৃস্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ ও ছাত্রনেতারা ঢাকার নবাবপুর রোডে আওয়ামি মুসলিম লিগের কার্যালয়ে এক সভায় মিলিত হন। সেখানে বহু যুক্তি-পালটা যুক্তি, তর্ক-বিতর্কের পর ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের বিষয়টি নিষ্পত্তির জন্য ভোট গ্রহণ করা হয়। ১৪৪ ধারা অমান্য করে একুশের কর্মসূচি পালনের পক্ষে ছিলেন মাত্র তিন জন - অলি আহাদ, আব্দুল মতিন এবং গোলাম মাওলা। অন্যদিকে ১৪৪ ধারা অমান্য করার বিপক্ষে ছিলেন ১১ জন। ১১/৩ ভোটে পরাজিত হয়েও ছাত্রনেতারা দাবি করেন, সাধারণ ছাত্ররা ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে। তাই তাঁরা এই ভোটের ফলাফল মানবে না। অনেক তর্ক-বিতর্কের পর শেষ পর্যন্ত সিদ্ধান্ত হয়, পরদিনের ছাত্র সভার সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হিসেবে বিবেচিত হবে।
একুশের সকালে আমতলায় ছাত্র সমাবেশ
১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি - সকাল থেকেই ছাত্র-ছাত্রীরা দু'একজন করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে আসতে থাকেন বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গেই অসংখ্য ছাত্রছাত্রী এসে সমবেত হন। আমতলায় শুরু হয় সভা। সর্বদলীয় পরিষদের পক্ষ থেকে অনেকেই ১৪৪ ধারা অমান্যের বিরুদ্ধে যুক্তি সাজিয়ে বক্তৃতা করেন। কিন্তু উত্তেজিত ছাত্রদের প্রতিবাদে তাঁদের বক্তব্য মাঝপথে শেষ করতে হয়। তখন সাধারণ ছাত্রছাত্রীদের পক্ষে বক্তৃতা করেন আব্দুল মতিন। তিনি দৃপ্ত কণ্ঠে উচ্চারণ করেন, ১৪৪ ধারা ভেঙে কর্মসূচি পালন করতে হবে। না হলে আর কখনো আন্দোলন সম্ভব হবেনা। উপস্থিত ছাত্রছাত্রীরা একবাক্যে তাঁকে সমর্থন জানায়। এরপর আরও দু'একজন ১৪৪ ধারা ভাঙার পক্ষে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। সিদ্ধান্ত হয় দশ জনের ছোটো ছোটো মিছিল করে পথে নামতে হবে, লক্ষ্য অ্যাসেম্বলি হল। এর পরই ১৪৪ ধারা ভাঙার সূচনা হয়। সঙ্গে সঙ্গেই স্লোগান ওঠে - 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই', 'চলো চলো অ্যাসেম্বলি চলো'।
সভার সিদ্ধান্ত অনুযায়ী দশজন করে ছাত্রদের কয়েকটি দল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ঐতিহাসিক আমতলা গেট থেকে ১৪৪ ধারা ভেঙে রাস্তায় বেরিয়ে আসে। প্রথম দলটি ছিল ছাত্রীদের। তাঁরা এবং পরবর্তী আরও কয়েকটি দলের ছাত্রছাত্রীদের গ্রেপ্তার করা হয়। এক সময় পুলিশ আকস্মিকভাবে লাঠি চার্জ ও কাঁদানে গ্যাস ছুড়তে থাকে। এতে মিছিলে অংশগ্রহণকারীরা উত্তেজিত হয়ে ওঠে। এরপর কোনোরূপ হুঁশিয়ারি না দিয়েই পুলিশ গুলি চালায়। প্রথম ঝাঁকের গুলিতেই শহিদ হন আব্দুল জব্বার এবং রফিক উদ্দিন আহমদ। এর পরের গুলিতে শহিদ হন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবুল বরকত। পুলিশের আক্রমণে আহত হন অনেকেই। অনেক ছাত্রকে গ্রেপ্তার করা হয়। এদিন পায়ে গুলিবিদ্ধ সরকারি কর্মচারী আবদুস সালামকে মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভরতি করা হয়। পরে (৭ এপ্রিল ১৯৫২) সেখানেই তাঁর মৃত্যু হয়।
পূর্ব বাংলা জুড়ে তীব্র প্রতিবাদ আন্দোলন
পুলিশের গুলিচালনায় শহিদ হবার ঘটনার প্রতিক্রিয়ায় কেবল ঢাকা শহরে নয়, গোটা প্রদেশে ব্যাপক প্রতিবাদ আন্দোলনের জন্ম দেয়। নানা স্থানে স্বতঃস্ফূর্তভাবে সভা- সমাবেশ-মিছিল ইত্যাদি সংগঠিত হতে থাকে। এদিকে সরকারের সমস্ত নিষেধাজ্ঞা ও ভয়ভীতি উপেক্ষা করে ঢাকায় পুলিশের গুলিতে নিহত শহিদদের অন্ত্যেষ্টি ও স্মরণ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। এই কর্মসূচি ঘোষণার ফলে সরকারের সচিবালয়ের কর্মচারী সহ হাজার হাজার মানুষ সকাল ১০ টার মধ্যে আগের দিনের ঘটনাস্থল মেডিকেল কলেজ হোস্টেল প্রাঙ্গণে উপস্থিত হন। ২১ ফেব্রুয়ারি রাতে সর্বদলীয় সভায় স্থির হয়েছিল হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহিদদের অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া শেষে তাঁদের লাশ নিয়ে মিছিল করা হবে। কিন্তু মধ্যরাতে পুলিশ হাসপাতাল থেকে লাশ তুলে নিয়ে যাওয়ায় তা আর সম্ভব হয়নি।
শহিদদের অন্ত্যেষ্টি ও স্মরণ অনুষ্ঠান শেষে বিশাল সংখ্যক ছাত্র-জনতা কার্জন হল পার হয়ে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে এগোতে থাকে। মিছিলের গতির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তার অবয়বও বাড়তে থাকে। পুলিশের নির্বিচারে লাঠিচার্জ ও কাঁদানে গ্যাসও তাদের দমাতে পারেনি। বাইশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা হয়ে ওঠে মিছিলের শহর, লাল-কালোয় প্রতিবাদ ও শোকের শহর। শহিদদের রক্তমাখা কাপড় বাঁধা বাঁশের লাঠি এবং লাল বর্ণমালায় লেখা ফেস্টুন উঁচিয়ে দিনভর প্রতিবাদী মিছিল শহরের পথে পথে পরিক্রমা করে। এদিন আক্ষরিক অর্থেই ঢাকা শহর হয়ে উঠেছিল হরতাল, মিছিল আর চাকা বনধ-এর শহর। সন্ধ্যা পর্যন্ত চলে এই গণ বিক্ষোভ। পরিস্থিতি এক গণ অভ্যুত্থানের রূপ নেয়। পরিস্থিতি সামাল দিতে ছাত্র-জনতার উপর ইপিআর বাহিনী নির্বিচারে গুলি চালায়। এর পরিণতিতে হাইকোর্টের কর্মচারী শফিউর রহমান, রিকশা চালক আবদুল আউয়াল, কিশোর ওহিউল্লাহ, তাঁতি বাজারের যুবক সিরাজ উদ্দিন সহ আরও কয়েকজন শহিদ হন। আহত হন অসংখ্য। সরকার এই আক্রমণ চালানোর পাশাপাশি মওলানা ভাসানী, আব্দুল মতিন সহ অনেকের নামে হুলিয়া জারি করে। তবু্ও আন্দোলনকারীরা এতটুকু না দমে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকেন।
২৩ ফেব্রুয়ারি কারফিউ থাকা সত্ত্বেও শহিদদের স্মৃতি অমর করে রাখার উদ্দেশ্যে সারারাত ধরে মেডিকেল কলেজ প্রাঙ্গণে তৈরি করা হয় শহিদ মিনার। ২৪ ফেব্রুয়ারি শহিদ মিনারের উদ্বোধন হয়। এই শহিদ স্মৃতি সৌধটি মানুষের আবেগ ও শ্রদ্ধার প্রতীক হয়ে ওঠে। এই স্মৃতিসোধটির নিচে একটি চাদর পেতে দেওয়া হলে মানুষ ফুল, টাকা-পয়সা এমনকী মহিলারা তাঁদের সোনার অলঙ্কার পর্যন্ত খুলে দেন। ছাত্রদের আবেগ ও সংগ্রামী দৃঢ়তায় রাতারাতি শহিদ মিনার নির্মাণ এবং এই আন্দোলনের রেশ পূর্ব বাংলার সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ায় পাকিস্তানি শাসকরা শঙ্কিত ও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। অবশেষে ২৬ ফেব্রুয়ারি সশস্ত্র পুলিশ বাহিনী শহিদ মিনারটি ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়। পরবর্তীকালে কেন্দ্রীয় শহিদ স্মৃতি সৌধ নির্মিত হয়, যা শ্রদ্ধা ও মর্যাদার প্রতীক হয়ে রয়েছে। ভাষা আন্দোলন সংগঠিত করা থেকে চূড়ান্ত পর্ব পর্যন্ত সমগ্র কর্মকাণ্ডে কমিউনিস্ট পার্টি নেপথ্যে থেকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করে।
পাকিস্তান সরকারের গ্রেপ্তার, নির্যাতন,দমন পীড়ন সত্ত্বেও রাষ্ট্রভাষা আন্দোলনকে পরাভূত করা যায়নি। ভাষা আন্দোলন এগোতে থাকে পরিণতির দিকে।
১৯৪৮ এ সীমাবদ্ধ পরিসরে যে আন্দোলনের সূচনা, তার প্রবহমানতায় ১৯৫২ সালে তার বিশাল ব্যাপ্তি ইতিহাস রচনা করে। একুশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন রাজনীতি ও সংস্কৃতি অঙ্গনে গভীর প্রভাব সঞ্চার করে। ১৯৫৩ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি থেকেই সীমাহীন আবেগে, শ্রদ্ধায় 'শহিদ দিবস' পালনের যে সূচনা হয়েছিল,তা স্বৈরশাসনেও ছেদ পড়েনি। বরং একুশে ফেব্রুয়ারি 'শহিদ দিবস' উদ্ যাপন প্রতি বছর ভাষার অধিকার ও গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের সংগ্রামে প্রেরণা সঞ্চার করেছে। তাই ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের সংবিধান প্রণয়ন উপলক্ষে শাসকশ্রেণি উর্দুর সঙ্গে বাংলাকে পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাধ্য হয়। একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন 'শহিদ দিবস' তেমনি গণতান্ত্রিক আন্দোলনেরও ঐতিহ্যের প্রতীক হয়ে ওঠে। এই ঐতিহাসিক আন্দোলন স্মরণে বাহান্ন সালেই তৎকালীন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আবদুল গাফফার চৌধুরী রচিত কবিতা,পরে যেটা আলতাফ মাহমুদের সুরারোপে জনচিত্তজয়ী গান হিসেবে মর্যাদা লাভ করে সেই -
"আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি
ছেলে হারা শত মায়ের অশ্রু গড়া এ ফেব্রুয়ারি
আমি কি ভুলিতে পারি"...
আজও সমগ্র বিশ্বে বাংলাভাষী মানুষ এবং মাতৃভাষার মর্যাদা রক্ষা ও গণতন্ত্রের জন্য লড়াইয়ে ব্রতী সংগ্রামীদের চেতনাদীপ্ত করছে। এছাড়াও রচিত হয়েছে আরও অসংখ্য গান ও কবিতা। মঞ্চস্থ হয়েছে নাটক, চলচ্চিত্রায়ন হয়েছে এবং চিত্রভাষায় উদ্ভাসিত হয়েছে একুশের চেতনা।
একুশের আন্দোলন ও আজকের প্রেক্ষিত
বাহান্নর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের মূল দাবি ছিল 'রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই'। অর্থাৎ তৎকালীন পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে উর্দুর পাশাপাশি বাংলাকে স্বীকৃতি দিতে হবে। এর পাশাপাশি আরও যে দাবিগুলি ছিল তা হলো -- 'সকল রাজবন্দির মুক্তি চাই', 'সর্বস্তরে বাংলা ভাষা চালু কর'। শেষের এই দাবিটিও ছিল খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাহান্নর এই ভাষা আন্দোলন পরবর্তী সমস্ত গণ আন্দোলনের বিকাশ এবং মুক্তিযুদ্ধের পথ নির্মাণ করেছিল। কিন্তু দেশ স্বাধীন হওয়া এবং নতুন রাষ্ট্র হিসেবে বাংলাদেশের উদ্ভব হলেও একুশের চেতনা ও ভাষা আন্দোলনের দাবিগুলির বাস্তবায়নের প্রত্যাশা পুরোপুরি পূরণ হয়নি। দেশ স্বাধীন হবার পর যে সংবিধান রচিত হয়েছিল, সেখানে ধর্ম নিরপেক্ষতার কথা স্পষ্টতই উল্লেখ ছিল। এছাড়াও উল্লেখিত ছিল প্রজাতন্ত্রের ভাষা হিসেবে সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু করতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্রীয় জীবন তথা জাতীয় জীবনে সমস্ত ক্ষেত্রে বাংলার ব্যবহার করতে হবে। কিন্তু দুঃখজনক হলেও সত্য, তা এখনো সম্পূর্ণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীন বাংলাদেশে আজও উচ্চশিক্ষা, বিজ্ঞান শিক্ষায় রয়েছে ইংরেজি শিক্ষার আধিপত্য। শুধু ভাষার ক্ষেত্রেই নয়, সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও বিদেশি সংস্কৃতির প্রাধান্য প্রকট। অন্য ভাষা বা সংস্কৃতির সঙ্গে বিরোধ নয়, কিন্তু মাতৃভাষা ও নিজস্ব সংস্কৃতির মর্যাদা ও গুরুত্বকে অবহেলা করা জাতি ও সমাজের পক্ষে মোটেও কল্যাণকর নয়।
এছাড়াও আরও একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক হলো, বাহান্নর ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন অসাম্প্রদায়িক চেতনা, গণতান্ত্রিক ভাবনা ও মানবিক মূল্যবোধকে জাগ্রত করেছিল। সাম্প্রদায়িক কলুষ-বিদ্বেষ ও নানা ষড়যন্ত্রের আবহের মধ্যেও প্রগতিশীল ও ধর্মনিরপেক্ষতার আদর্শকে সামনে তুলে ধরেছিল। কিন্তু দেখা গেল বাংলাদেশ স্বাধীন হবার অব্যবহিত পরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে এক জঘন্য সামরিক অভ্যুত্থানে হত্যা করে জিয়াউর রহমান সামরিক শাসক হিসেবে ক্ষমতাসীন হন। তিনি ১৯৭৭ সালে বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিটিকে অপসারিত করেন। আবার ১৯৮৮ সালে এইচ এম এরশাদ ক্ষমতায় এসে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম হিসেবে ঘোষণা করেন। এই দুই সামরিক শাসকের পদক্ষেপ বাংলাদেশের রাজনীতি ও সমাজনীতিতে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িক শক্তির তৎপরতাকে তরান্বিত করে।
পরবর্তীকালে সেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামি লিগ সরকারও নানাভাবে মৌলবাদের সঙ্গে আপসের রাস্তায় হেঁটেছে। এসবের ফলে বাংলাদেশের বুকে আজ অসাম্প্রদায়িক-ধর্মনিরক্ষতার চেতনা বাধাপ্রাপ্ত হচ্ছে, প্রগতিশীল ও মুক্তচিন্তার মানুষ হিংস্র মৌলবাদীদের দ্বারা আক্রান্ত হচ্ছেন, ইতিমধ্যে অনেকের প্রাণ গেছে। এছাড়া বিভিন্ন স্থানে সংখ্যালঘুরা যেমন আক্রমণের মুখে পড়ছেন,তেমনি তাদের ধর্মীয়স্থানগুলিতেও ভাঙচুর চালানো হচ্ছে। রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারির পথ বেয়ে অগণিত শহিদের জীবনের বিনিময়ে মহান মুক্তিসংগ্রামে বিজয়ের মধ্য দিয়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছিল,সেই বাংলাদেশে কি আজ ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের চেতনা ও মর্যাদা অটুট রয়েছে-- স্বাভাবিকভাবেই আজ এই প্রশ্ন জাগছে !
ভাষা-সংস্কৃতিতে আগ্রাসন
একুশের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি আলোচনার সূত্রে আমাদের দেশের পরিস্থিতিও সামনে চলে আসে। এখানে যে উগ্র সাম্প্রদায়িক ফ্যাসিস্ট ধর্মী সরকার চলছে তারাও হিন্দু রাষ্ট্র গড়ার পরিকল্পনায় অন্যান্য নানা ক্ষেত্রের মতো ভাষা-সংস্কৃতির উপরেও ভয়ঙ্কর আঘাত নামিয়ে এনেছে। বিজ্ঞানকে অন্ধকারে ঢেকে,ইতিহাসকে বিকৃত করে পুরাণ-অতিকথার মাধ্যমে মধ্যযুগীয় অবাস্তব ধ্যান ধারণাকে জন মানসে প্রতিষ্ঠিত করতে চাইছে। করপোরেট বান্ধব এই সরকার জাতীয় শিক্ষা নীতি ২০২০-তে ভাষা নিয়ে যে সুপারিশ করেছে,সেখানে বহু ভাষাভাষীর এই বৈচিত্র্যময় দেশে 'একজাতি-এক দেশ-এক ভাষা'র নামে হিন্দিকে চাপিয়ে দিতে চাইছে। কেন্দ্রের এই পদক্ষেপ শুধুমাত্র অন্য ভাষাগুলির নয়, হিন্দি ভাষারও যে নিজস্ব সম্পদ,তাকেও বিনষ্ট করবে। একইসঙ্গে তা দেশের ঐক্য ও সংহতির পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠবে।
ধারণ করতে হবে নতুন লড়াইয়ের চেতনা
বর্তমানে সাম্রাজ্যবাদ আর লগ্নিপুঁজির পৃষ্ঠপোষণায় সাম্প্রদায়িক ও মৌলবাদী শক্তি বাংলাদেশ, ভারত সহ গোটা উপ মহাদেশে মারাত্মক বিপদ হিসেবেই দেখা দিয়েছে। কাজেই একুশের চেতনাকে সার্বিকভাবে বাস্তবায়িত করতে হলে একুশের উদ্ যাপন কেবল আনুষ্ঠানিকতায় নয়,একুশের মাসে রঙিন বসন্তে নতুন লড়াইয়ের চেতনা ধারণ করাই হবে সময়ের দাবি।
প্রাসঙ্গিক তথ্য:
* ভাষা আন্দোলনের কথা -আহমদ রফিক, মাওলা ব্রাদার্স, ঢাকা।
* ভাষা আন্দোলনের স্মৃতি ও কিছু জিজ্ঞাসা - আহমদ রফিক, বাংলা একাডেমি,ঢাকা।
* ভাষা আন্দোলনের শহিদেরা - সম্পাদিত - বাংলা একাডেমি, ঢাকা।
* একুশ - বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি, ঢাকা।
* একুশে ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়,স্মরণিকা, ১৯৯১
*লেখক দেশহিতৈষী পত্রিকার সাংবাদিক
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন