"মানুষকে মানুষ বলে দেখতে না পারার মতো এতবড়ো সর্বনেশে অন্ধতা আর নেই। এই বন্ধন এই অন্ধতা নিয়ে কোনো মুক্তিই আমরা পাব না।" (কালান্তর - নবযুগ)
জীবনের অনন্ত অভিজ্ঞতায় এই উপলব্ধি অর্জন করেছেলেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ। কবি হিসেবে তিনি কল্পলোকের বাসিন্দা ছিলেন না। নগর ও পল্লিজীবনে তিনি মানুষের সংলগ্নতায় সব সময় মাটির কাছাকাছি থেকেই এই অনুপম উপলব্ধির অধিকারী হয়েছিলেন। রবীন্দ্রনাথ বিপুল সৃষ্টিকর্মের পাশাপাশি উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত জমিদারি পরিচালনা করেছেন এবং তাঁর মানসভূমি শান্তিনিকেতন প্রতিষ্ঠা করেছেন। কবির অফুরান সৃষ্টি ও জীবনভর বিপুল কর্মকাণ্ডের মধ্যে একটি উজ্জ্বল অধ্যায় হলো তাঁর অসীম মানবপ্রেম, বিশেষ করে গ্রামের গরিব-অন্ত্যজ-নিরক্ষর মানুষদের কল্যাণে তাঁর যে সুগভীর চিন্তা ও বহুমুখী কর্মকাণ্ড তার নজির মেলা ভার। বিশেষত রবীন্দ্রনাথ যখন জমিদারির কাজে বিভিন্ন সময়ে পল্লিজননীর কোলে আশ্রয় নিয়েছেন তখন এই অবহেলিত, বঞ্চিত ও জাতপাত-ধর্মের দোহাই দিয়ে দূরে ঠেলে রাখা মানুষদের নিদারুণ দুঃখ কষ্ট ও জীবন যন্ত্রণা লক্ষ করে যন্ত্রণাকাতর হয়েছেন। ১৩৪৬ সালে শ্রীনিকেতনের ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে তাঁর জমিদারি পরিচালনা ও তৎকালীন পল্লিসমাজের বর্ণনা করে তিনি লিখেছেন:
"যতদিন পল্লীগ্রামে ছিলেম,ততদিন তন্নতন্ন করে জানবার চেষ্টা আমার মনে ছিল। কাজের উপলক্ষে এক গ্রাম থেকে আর-এক দূর গ্রামে যেতে হয়েছে,শিলাইদা থেকে পতিসর,নদী-নালা বিলের মধ্য দিয়ে -তখন গ্রামের বিচিত্র দৃশ্য দেখেছি।...ক্রমে এই পল্লীর দুঃখ-দৈন্য আমার কাছে সুস্পষ্ট হয়ে উঠল, তার জন্যে কিছু করব এই আকাঙ্ক্ষায় আমার মন ছটফট করে উঠেছিল। তখন আমি যে জমিদারি-ব্যবসায় করি, নিজের আয়-ব্যয় নিয়ে ব্যস্ত, কেবল বণিকবৃত্তি করে কাটাই, এটা নিতান্তই লজ্জার বিষয় মনে হয়েছিল। তারপর থেকে চেষ্টা করতুম - কী করলে এদের মনের উদ্ বোধন হয়, আপনাদের দায়িত্ব এরা আপনি নিতে পারে।"
তবে রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিজ্ঞতা থেকে বুঝেছিলেন, উপকার করতে চাইলেই করা যায়না। তিনি প্রজাদের কল্যাণে কাজ করতে গিয়ে পদে পদে বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। তিনি যেমন আমলা-গোমস্তা-মহাজনদের কাছ থেকে বাধা পেয়েছেন, তেমনি সেই সময়ে জাতপাত-ধর্মের অনুশাসনে আবদ্ধ সামাজিক নানা প্রতিবন্ধকতার প্রাচীর ভেঙেই তাঁকে অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছুতে হয়েছে।
জমিদারি পরিচালনা: লক্ষ্য প্রজাকল্যাণ
ঠাকুর পরিবারের জমিদারি ছিল অবিভক্ত বাংলার নদীয়া, পাবনা ও রাজশাহী জেলায়। নদীয়া জেলার বিরাহিম পরগনার সদর কাছারি শিলাইদহ, পাবনা জেলার ইউসুফশাহি পরগনার ডিহি সাজাদপুরের সদর সাজাদপুর এবং রাজশাহী জেলার কালীগ্রাম পরগনার সদর ছিল পতিসর গ্রামে। এই তিনটি জমিদারির ভার রবীন্দ্রনাথের হাতে অর্পণ করেছিলেন পিতা মহর্ষি দেবেন্দ্রনাথ। এই জমিদারি পরিচালনা করতে গিয়ে কায়েমি স্বার্থের যেসমস্ত জায়গায় তিনি আঘাত হেনে ছিলেন, তার সব ক'টিরই রক্ষক ছিলেন হিন্দু গোমস্তা, না হয় হিন্দু মহাজন বা জোতদার। তাই স্বাভাবিক কারণেই রবীন্দ্রনাথ তাদের বাধার সম্মুখীন হয়েছেন।
এমনকী কিছু স্বার্থান্বেষী গ্রামের সাধারণ গরিব মানুষের স্বার্থের কথা ভুলে গিয়ে সাম্প্রদায়িক বিভেদের রাজনীতিকেও টেনে এনেছিলেন জমিদারিতে। ঠাকুরদের জমিদারির অধিকাংশ প্রজাই ছিলেন দরিদ্র মুসলমান, তাই রবীন্দ্রনাথের সমস্ত কল্যাণকর্মে সবচেয়ে উপকৃত হয়েছিলেন তারাই। সেই সময়ে এমন প্রচারও হয়েছে যে, রবীন্দ্রনাথ ব্রাহ্ম, তাই তাঁর এত মুসলমান-প্রীতি! এছাড়া কিছু স্বার্থান্বেষী লোক তাঁকে প্রজা-পীড়ক হিসেবে সর্বৈব মিথা প্রচারেও মত্ত হয়েছিলেন। কিন্তু এসমস্ত কলুষ রবীন্দ্রনাথের মতো মহিরুহকে বিন্দুমাত্র স্পর্শ করতে পারেনি। তিনি তাঁর লক্ষ্যে স্থির থেকে নিজের সীমাবদ্ধ গণ্ডিতে প্রজাকল্যাণে অভূতপূর্ব নজির সৃষ্টি করেছেন।
ভেদ প্রথার অবসান
জাতপাত, অস্পৃশ্যতা, ধর্ম-সম্প্রদায়গত বিভেদকে রবীন্দ্রনাথ সমূলে উচ্ছেদ করতে চেয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি একজন মানবতাবাদী হিসেবে শ্রেষ্ঠ স্থানে অধিষ্ঠিত। তাঁর জন্ম হয়েছিল বর্ণশ্রেষ্ঠ ব্রাহ্মণ পরিবারে। পিতা দেবেন্দ্রনাথ ছিলেন কিছুটা হলেও বর্ণাশ্রমে বিশ্বাসী এবং আদি ব্রাহ্ম সমাজের পুরোধা। এর প্রভাব প্রথম জীবনে রবীন্দ্রনাথের উপর থাকলেও সমাজ ও কালের বিবর্তনে তাঁরও দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন ঘটেছে। বিশেষ করে ১৮৯০-৯১ সালে পারিবারিক জমিদারি পরিদর্শন সূত্রে নিম্নবর্গের হিন্দু ও মুসলমান সম্প্রদায়ের জীবনযাত্রা প্রত্যক্ষ করার সুযোগ হয় তাঁর। এর মধ্য দিয়েই তিনি উপলব্ধি করেছিলেন, পেশাগত দিক থেকে তো নয়ই, কোনো দিক থেকেই এরা অপমানিত হতে পারেন না। ১৮৮৪ সালে 'ধর্ম' সম্পর্কে একটি আলোচনায় তিনি উল্লেখ করেছিলেন:
"জগৎ কাহাকেও একঘরে করেনা, ধোপা-নাপিত বন্ধ করেনা। চন্দ্র-সূর্য-রোদ-বৃষ্টি জগতের সমস্ত শক্তি সমগ্রের এবং প্রত্যেক অংশ সমগ্রের দাসত্ব করিতেছে। তাহার কারণ এই জগতের মধ্যে যে কেহ বাস করে কেহই জগতের বিরোধী নহে।"
আগেই বলা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথের জমিদারি আমলে নদীয়া,পাবনা ও রাজশাহী জেলায় মুসলমান প্রজাদেরই সংখ্যাধিক্য ছিল। তাদের অধিকাংশই ছিলেন কৃষিজীবী। হিন্দুদের মধ্যে স্বল্প সংখ্যক (মাত্র ১০ শতাংশ) ছিলেন উচ্চবর্ণের, বাকি বিপুল সংখ্যক ছিলেন নিম্নবর্ণের অর্থাৎ অন্ত্যজ শ্রেণির। জমিদারি তদারকি করতে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ নিবিড়ভাবে জনসমাজের পরস্পরের মধ্যে সামাজিক ও ব্যবহারিক সম্পর্কের চরম অবনতি প্রত্যক্ষ করেন। এ প্রসঙ্গে তিনি উল্লেখ করেছেন:
"আমি যখন প্রথম আমার জমিদারির কাজে প্রবৃত্ত হয়েছিলুম তখন দেখেছিলুম, কাছারিতে মুসলমান প্রজাকে বসতে দিতে হলে জাজিমের একপ্রান্ত তুলে দিয়ে সেই স্থানে তাকে স্থান দেওয়া হত।" (হিন্দু-মুসলমান, কালান্তর)
প্রসঙ্গক্রমে এখানে বিষয়টি সংক্ষেপে তুলে ধরা যেতে পারে। রবীন্দ্রনাথ জমিদারির দায়িত্ব পাবার পর ১৮৯১ সালে প্রথম শিলাইদহে এলেন পুণ্যাহ উৎসবে যোগ দিতে। এসে প্রথমেই যে প্রায় বৈপ্লবিক কাজটি করলেন তা হলো আসন বিন্যাসের ক্ষেত্রে যে জাতি ও বর্ণভেদ ব্যবস্থা ছিল তা তুলে দিলেন। ঠাকুর্দা প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুরের আমল থেকেই পুণ্যাহ অনুষ্ঠানে সম্ভ্রম-মর্যাদা ও জাতি-বর্ণ অনুযায়ী ভিন্ন ভিন্ন আসনের ব্যবস্থা ছিল। প্রথাগত নিয়ম অনুসারে হিন্দুরা বসতেন চাদর ঢাকা শতরঞ্চির উপর এক পাশে, তার মধ্যে আবার ব্রাহ্মণদের জন্য ছিল আলাদা আসন। আর মুসলমান প্রজারা বসতেন চাদর ছাড়া শতরঞ্চির উপর অন্যধারে। সদর ও অন্য কাছারির কর্মচারীরাও নিজ নিজ পদমর্যাদা অনুযায়ী আলাদা আলাদা আসনে বসতেন। জমিদার অর্থাৎ বাবুমশাইয়ের জন্য ছিল ভেলভেট মোড়া সিংহাসন।
রবীন্দ্রনাথ অনুষ্ঠানে এসে এই ব্যবস্থা মানতে অস্বীকার করলেন। তিনি জাত-বর্ণ অনুসারে আসনের এই বিভাজন প্রথা তুলে দিতে বললেন। এ নিয়ে নায়েব-গোমস্তা-কর্মচারীদের সঙ্গে তাঁর প্রচণ্ড মতবিরোধ হলো। এমনকী তাঁরা একযোগে পদত্যাগেরও হুমকি দিলেন। তাদের বক্তব্য, চিরাচরিত প্রথা ভাঙা চলবে না। রবীন্দ্রনাথ তাঁর অবস্থানে অবিচল রইলেন। তিনি বললেন, মিলন উৎসবে পরস্পরে ভেদ সৃষ্টি করে মধুর সম্পর্ক নষ্ট করে দেওয়া চলবে না। তিনি প্রজাদের নির্দেশ দিলেন পৃথক আসন, পৃথক ব্যবস্থা সব সরিয়ে দিয়ে সবাইকে একসঙ্গে বসতে। তাঁর আহ্বান অনুযায়ী হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সব প্রজা আসনের ভেদাভেদ তুলে দিয়ে ঢালা ফরাসের উপর বসে পড়লেন। আর সিংহাসনের পরিবর্তে সবার মাঝখানে বসলেন তাঁদের 'বাবুমশাই' - রবীন্দ্রনাথ। দলে দলে এলেন আরও লোক। সেদিন থেকেই ঠাকুরদের জমিদারিতে পুণ্যাহ উৎসবে শ্রেণিভেদ প্রথা উঠে গেল।
প্রজাহিতৈষী রবীন্দ্রনাথ
জমিদারি পরিচালনার কাজে এসে পল্লি অঞ্চল ঘুরে দুঃখকষ্ট-পীড়িত প্রজাদের দেখে তাঁর যে অনুভূতি হয়েছিল তা তিনি প্রথমে এসেই ইন্দিরা দেবীকে এক চিঠিতে লিখলেন:
"আমার এই দরিদ্র চাষী প্রজাগুলোকে দেখলে ভারি মায়া করে। এরা যেন বিধাতার শিশু সন্তানের মতো---নিরুপায়। তিনি এদের মুখে নিজের হাতে কিছু তুলে না দিলে এদের আর গতি নেই। পৃথিবীর স্তন যখন শুকিয়ে যায় তখন এরা কেবল কাঁদতে জানে, কোনোমতে একটুখানি খিদে ভাঙলেই আবার তখনই সমস্ত ভুলে যায়।"
জমিদারির দায়িত্ব নিয়েও রবীন্দ্রনাথ কিন্তু জমিদার হিসেবে যাননি, গিয়েছিলেন তাঁদের পরম হিতৈষী একজন কর্মী ও অভিভাবকরূপে। এসেই তিনি প্রজাদের সঙ্গে নিবিড় আত্মিক সম্পর্ক গড়লেন,অন্যদিকে আমলা-গোমস্তা- মহাজনদের দিকে সুতীব্র নজর রাখলেন যাতে প্রজাদের কোনো অনিষ্ট বা সমস্যা না হয়।
প্রজাকল্যাণে বহুমুখী উদ্যোগ
জমিদারির গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব গ্রহণের পর থেকেই রবীন্দ্রনাথের লক্ষ্য ছিল তাঁর গরিব প্রজাদের সার্বিক কল্যাণ,পল্লির উন্নয়ন। তাই তিনি গ্রামের মানুষদের জীবন নির্বাহের প্রধান সমস্যাগুলি সমাধান অর্থাৎ খাদ্য, পানীয়, রোগমুক্তি ইত্যাদি বিভিন্ন বিষয়ে ভাবনা এবং সেসব বাস্তবায়নে ব্রতী হয়েছেন। এসবের পাশাপাশি কৃষি, জলসেচ, সমবায়, শিক্ষা এবং হিন্দু-মুসলমান সম্প্রীতি অটুট রাখার মতো গুরুত্বপূর্ণ দিকে তাঁর আন্তরিক কর্মপ্রচেষ্টা ও উদ্যোগ শুরু হয়। সেইসঙ্গে পুরনো আমলের জমিদারির নিয়মকানুন সংস্কার করে প্রচলন করলেন স্থানীয় স্বায়ত্তশাসনমূলক পদ্ধতি মণ্ডলীপ্রথা। আজকের পরিভাষায় যা হলো কেন্দ্রীয় ক্ষমতার আঞ্চলিক বিকেন্দ্রীকরণ।
গ্রামগুলি যাতে নিজেদের সমস্ত প্রয়োজন নিজেরাই মেটাতে পারে সেই উদ্দেশ্যেই এই প্রথার প্রবর্তন। এই প্রথা চালু করতে গিয়ে তিনি বাধার সম্মুখীনও হয়েছিলেন। এছাড়াও তিনি 'হিতৈষী বৃত্তি' ও 'কল্যাণ বৃত্তি' নামে দু'টি করের প্রচলন করেছিলেন। এই বাবদ সংগৃহীত সব টাকাই ব্যয় হতো প্রজাকল্যাণে। এই টাকা তিনি রাস্তাঘাট নির্মাণ, স্কুল-মাদ্রাসা স্থাপন, মন্দির-মসজিদ সংস্কার এবং গ্রামের গরির দুস্থ মানুষ ও চাষিদের নানা সমস্যা-সংকট নিরসনে ব্যয় করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ জমিদারির তদারকিতে শিলাইদহে থাকার সময়েই উপলব্ধি করেছিলেন চাষিদের শুধুমাত্র হাল-বলদ নিয়ে চাষ করলেই হবে না, কৃষি ব্যবস্থার পরিবর্তন ও সংস্কার করা প্রয়োজন। তাই তিনি হাতে কলমে কাজের উদ্যোগ নিলেন। একদল তরুণকে তিনি শিলাইদহের কুঠিবাড়ি সংলগ্ন জমিতে নানা ধরনের ফুল, ফল ও সবজি চাষের কাজে লাগালেন। নানা রকম ফসল ও রেশম চাষের পরীক্ষানিরীক্ষা শুরু করলেন। কুটিরশিল্প, তাঁত ও বয়ন শিল্প এবং পটারির কাজও শুরু হয়েছিল এই সময়ে।
রবীন্দ্রনাথ তাঁর অভিজ্ঞতা ও দূরদৃষ্টিতে অনুভব করেছিলেন চাষের কাজে জ্ঞান-বিজ্ঞান-প্রযুক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। এই ভাবনাকে বাস্তবায়িত করার লক্ষ্যেই ১৯০৬ সালে পুত্র রথীন্দ্রনাথ ও বন্ধুপুত্র সন্তোষচন্দ্র মজুমদারকে পাঠিয়েছিলেন আমেরিকার ইলিনয় বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিদ্যা ও প্রাণীপালন বিদ্যার পাঠ নিতে। পরের বছর জামাতা নগেন্দ্রনাথকেও পাঠান একই উদ্দেশ্যে। তাঁরা শিক্ষা শেষে ফিরে এসে গ্রামসংগঠন ও পল্লিসেবায় আত্মনিয়োগ করেছিলেন। এদের পাশাপাশি কালীমোহন ঘোষ সহ বেশ কয়েকজন উৎসাহী যুবককেও এসব কাজে পেয়েছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ গ্রামের গরিব প্রজাদের চিকিৎসার জন্য শিলাইদহ সহ অন্যান্য জমিদারিতে চিকিৎসাকেন্দ্র স্থাপন করেছিলেন। তিনি নিজে হোমিওপ্যাথি ও বায়োকেমিক চিকিৎসা করে অনেককে সুস্থ করে তুলেছেন।
দারিদ্র্য-লাঞ্ছিত প্রজাদের অর্থকষ্ট ও দুর্দশা দূর করতে শুরু থেকেই চিন্তা করে এসেছেন রবীন্দ্রনাথ । তাই তিনি তাঁর প্রজাদের বড়ো বড়ো মহাজনদের ভয়াবহ ঋণের করাল গ্রাস থেকে মুক্ত করতে ১৯০৫ সালে পতিসরে সমবায় পদ্ধতিতে কৃষিব্যাঙ্ক স্থাপন করেন। চাষিদের অল্পসুদে টাকা ধার দিতে নিজের প্রচেষ্টার পাশাপাশি বন্ধুবান্ধবদের কাছ থেকে টাকা ধার করে এই ব্যাঙ্কের সূচনা করেন। ১৯১৩ সালে নোবেল প্রাইজ পাবার পর প্রাপ্ত ১ লক্ষ ২০ হাজার টাকা এই ব্যাঙ্কে জমা রাখেন। এর ফলে গরিব প্রজারা যেমন উপকৃত হন,তেমনি মহাজনেরা সেখান থেকে ব্যবসা গুটিয়ে নিতে বাধ্য হয়।
কৃষিব্যাঙ্কের মতো ধর্মগোলা স্থাপনও কবি-জমিদার রবীন্দ্রনাথের সচেতন পল্লিসেবার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর মধ্য দিয়ে খরা, বন্যা প্রভৃতি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ও আকস্মিক সংকটে গ্রামের মানুষেরা সাহায্য পেতেন। রবীন্দ্রনাথ জমিদারির কাজে অগ্রসর হয়ে প্রজাকল্যাণের নানা উদ্যোগের পাশাপাশি প্রজাদের কথা ভেবেই নিজস্ব বিচার ব্যবস্থা হিসেবে সালিশী প্রথা চালু করেন। এরফলে প্রজাদের যেমন আর্থিক খরচ করতে হতো না,তেমনি দীর্ঘদিন ধরে মামলা চালোনোর দুর্ভোগ থেকেও তাদের রেহাই মিলেছিল।
রবীন্দ্রনাথ প্রজাদের দুঃখ দুর্দশা প্রত্যক্ষ করতে নিজে পায়ে হেঁটে গ্রামের পথে বেরোতেন। তখন বরকন্দাজরা তাঁর পিছু নিলে তিনি তাদের সরিয়ে দিতেন। প্রজারা অকপটে তাঁর কাছে এসে নিজেদের সমস্যার কথা জানাতে পারতেন। ফসলহানি ও নানা সংকটে প্রজাদের খাজনা মকুব করতেও তিনি কুণ্ঠিত হতেন না।
ঐক্য-সম্প্রীতির লক্ষ্যে
রবীন্দ্রনাথ প্রজানুরঞ্জনের লক্ষ্যে সমস্ত কল্যাণকর কাজে যেমন মগ্ন থেকেছেন, একইসঙ্গে তাঁর জমিদারিতে হিন্দু-মুসলমান দুই সম্প্রদায়ের মধ্যে বিবাদবিসংবাদ দূর করে সম্প্রীতি ও ঐক্যের বন্ধন সুদৃঢ় করতেও সচেষ্ট থেকেছেনে। তেমনই একটি ঘটনায় জানা যায়, রবীন্দ্রনাথের সাজাদপুরে অবস্থানকালে একবার মুসলমান যুবক আকুল সরকারের সঙ্গে হিন্দু যুবতী লতার প্রণয় ও তাঁদের উভয়ের সম্মতিতে বিয়েকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধার উপক্রম হয়েছিল। কবি তখন সিরাজগঞ্জের তরুণ ইংরেজ ম্যাজিস্ট্রেট এফ ও বেল-এর সাহায্যে তা মেটাতে সক্ষম হন। তিনি মনে করতেন--" দল বেঁধে থাকা,দল বেঁধে কাজ করা মানুষের ধর্ম বলেই সেই ধর্ম সম্পূর্ণভাবে পালন করাতেই মানুষের কল্যাণ, তাঁর উন্নতি।" তিনি আরও বলেছেন,..." ধর্মের দোহাই বা গায়ের জোরের দোহাই এই দুয়ের কোনোটাই মানবসমাজের দারিদ্র্য মোচনের পন্থা নয়।"
গরিব-অন্ত্যজ মানুষদের প্রতি নিঃস্বার্থ ভালোবাসা,মমত্ববোধে ও উন্নত মানবিক আদর্শে সঞ্জীবিত হয়েই রবীন্দ্রনাথ জমিদার হয়েও মানুষের কল্যাণ ও উন্নতির চিন্তায় সব সময় মগ্ন থেকেছেন। তিনি তাঁর ম্যানেজার জানকী রায়কে একটি চিঠিতে (২৯ চৈত্র, ১৩১৫) লিখেছেন:
"আমি জমিদারিকে কেবল লাভ-লোকসানের দিক হইতে দেখিতে পারিনা। অনেকগুলি লোকের মঙ্গল আমাদের প্রতি নির্ভর করে। ইহাদের প্রতি কর্তব্য পালনের ধর্মরক্ষা করিতে হইবে।... তোমাদের চরিত্রে ব্যবহারে ও কর্মপ্রণালীতে আমাদের জমিদারি যেন সকল দিক হইতে ধর্মরাজ্য হইয়া উঠে। আমাদের লাভই কেবল দেখিবে না,সকলের মঙ্গল দেখিবে।"
রবীন্দ্রনাথের এই সমাজভাবনা ও মানবিকতার আদর্শ তাঁর সমগ্র জীবনচর্যায়- কর্মকাণ্ডে ও সৃষ্টিতে উদ্ভাসিত হয়েছে। তাই 'সেঁজুতি' কাব্যের 'পরিচয়' কবিতায় মাটির মানুষের সাথে কবি তাঁর আত্মিক সম্পর্ক ব্যক্ত করেছেন প্রাণের আর্তিতে -
"সেতারেতে বাঁধিলাম তার,
গাহিলাম আরবার,
'মোর নাম এই বলে খ্যাত হোক,
আমি তোমাদেরই লোক,
আর কিছু নয় -
এই হোক শেষ পরিচয়।' "
তথ্যসূত্র:
১) রবীন্দ্র রচনাবলী : ত্রয়োদশ খণ্ড, পৃষ্ঠা-৭৪৬-৭৪৭,পশ্চিমবঙ্গ সরকার,নভেম্বর ১৯৯০।
২) সঞ্চয়িতা: রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, পৃষ্ঠা -৭৮২, বিশ্বভারতী, আশ্বিন ১৩৭০।
৩) জমিদার রবীন্দ্রনাথ : অমিতাভ চৌধুরী, বিশ্বভারতী, জ্যৈষ্ঠ ১৪১৯।
৪) রবিজীবনী: প্রশান্তকুমার পাল, তৃতীয় খণ্ড, পৃষ্ঠা ১৩৭-১৩৮, আনন্দ পাবলিশার্স, কলকাতা-৯।
৫) রবীন্দ্রভুবনে পতিসর: আহমদ রফিক, কথা, কলকাতা-৪৭।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন