“আমরা হিন্দু নই। আদিবাসী পরিবারের মহিলারা সিঁদুর পরবেন না। মঙ্গলসূত্র পরবেন না। আদিবাসী সমাজের মহিলা ও কিশোরীরা শিক্ষায় নজর দিন। এখন থেকে সমস্ত রকম উপবাস করা বন্ধ করুন।” আদিবাসী সমাজের এক সমাবেশে একথা বলার জন্য চাকরি থেকে সাসপেন্ড হলেন রাজস্থানের এক স্কুল শিক্ষিকা।
গত ১৯ জুলাই বাঁশওয়াড়ার মনগড় ধাম অঞ্চলে আদিবাসীদের এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। এই সমাবেশে বক্তব্য রাখতে উঠে আদিবাসী পরিবার সংস্থার প্রতিষ্ঠাতা ও স্কুল শিক্ষিকা মানেকা দামোর বলেন, পন্ডিতরা যা বলছেন তা অনুসরণ করবেন না। শিক্ষিকার এই বক্তব্যে প্রতিবাদ জানান বেশ কিছু আদিবাসী মহিলা।
এই ঘটনার পরেই রাজস্থান স্কুল শিক্ষা দপ্তরের পক্ষ থেকে মানেকা দামোরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয় এবং তাঁকে চাকরি থেকে সাসপেন্ড করা হয়। বর্তমানে তিনি সাদা-র সরকারি উচ্চ মাধ্যমিক স্কুলের শিক্ষিকা ছিলেন। মানেকা দামোরের সাসপেনশন সম্পর্কে প্রশাসনিক সূত্র থেকে জানানো হয়েছে, তিনি রাজস্থান শিক্ষাদপ্তরের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন এবং শিক্ষা দপ্তরের আচরণবিধি লঙ্ঘন করেছেন।
১৯ তারিখের ওই সমাবেশে রাজস্থান ছাড়াও পার্শ্ববর্তী মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট, মহারাষ্ট্র থেকে বহু আদিবাসী জনজাতির মানুষ এসেছিলেন। নতুন ‘ভিল প্রদেশ’ রাজ্য গঠনের দাবিতে আয়োজিত ওই সমাবেশে মানেকা ডোমার একথা বলেন।
বেশ কিছুদিন ধরেই ভীল প্রদেশ গঠনের দাবিতে উত্তাল রাজস্থান। রাজ্যের ১২টি জেলা ছাড়াও মহারাষ্ট্র, গুজরাট এবং মধ্যপ্রদেশ থেকে আরও ২৭ টি জেলাকে নিয়ে নতুন ভীল প্রদেশের দাবিতে আন্দোলন চলছে। আলাদা জনজাতি হিসেবে ভীল প্রদেশের দাবি নিয়ে সরব এই অঞ্চলে বসবাসকারী ভীলরা।
সদ্যসমাপ্ত লোকসভা নির্বাচনে রাজস্থানের বাঁশওয়াড়া কেন্দ্র থেকে বিজেপি প্রার্থীকে প্রায় আড়াই লক্ষ ভোটে পরাজিত করে জয়ী হয়েছেন ভারতীয় আদিবাসী পার্টির রাজকুমার রোট। তাঁর জয়ের পরেই ভীল আন্দোলন ফের দানা বেঁধেছে।
ভীল প্রদেশ কী? কেনই বা ভীল প্রদেশের দাবি?
রাজস্থান, মধ্যপ্রদেশ, গুজরাট এবং মহারাষ্ট্রের মোট ৪৯টি জেলাকে নিয়ে পৃথক ভীল প্রদেশ গঠনের দাবি নতুন নয়। ২০১৭ সালে গুজরাটে মূলত এই দাবি নিয়েই ভারতীয় ট্রাইবাল পার্টি গঠিত হয়। যদিও ২০২৩ সালে রাজস্থান বিধানসভা নির্বাচনের আগে বিটিপি ভেঙে তৈরি হয় ভারতীয় আদিবাসী পার্টি। বর্তমানে রাজস্থান বিধানসভায় বিএপি-র ৩ বিধায়ক আছে। অন্যদিকে বিটিপি-র বিধায়ক সংখ্যা ২।
১৯১৩ সালের ১৭ নভেম্বর ব্রিটিশদের হাতে হাজারের বেশি ভীল জনগোষ্ঠীর মানুষ নিহত হন। রাজস্থান গুজরাট সীমানা অঞ্চলের মানগড়ে এই ঘটনা ঘটে। এই ঘটনা প্রসঙ্গে এলাকার সাংসদ রাজকুমার রোট জানিয়েছেন, ১৯১৩ সালের সেই আন্দোলন শুধুমাত্র ভক্তি মুভমেন্ট-এর অংশ ছিলোনা, তখন থেকেই আলাদা ভীল প্রদেশের দাবি ছিল।
উল্লেখ্য, স্বাধীনতার পরেও একাধিকবার পৃথক ভীল প্রদেশের দাবি তোলা হয়েছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের একাধিক সাংসদ এই দাবি জানিয়েছেন। যাদের মধ্যে আছেন দাহোদের কংগ্রেস সাংসদ সোমজীভাই দামোর, রতলামের সাংসদ দিলীপ সিং ভুরিয়া এবং রাজস্থান বিধানসভার সিপিআই বিধায়ক মেঘরাজ তাওয়ার।
এই আন্দোলন প্রসঙ্গে বিটিপি রাজস্থান সভাপতি ডঃ ভেলারাম ঘোগরা জানিয়েছেন, অতীতে এই অঞ্চল একটি অংশের অন্তর্গত ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার সময় রাজনৈতিক নেতৃত্ব এই অঞ্চলকে বিভিন্ন ভাগে বিভক্ত করেছে। যে কারণে আদিবাসীদের পক্ষে ঐক্যবদ্ধ হওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
বিএপি নেতারা হিন্দুধর্ম এবং রাষ্ট্রীয় স্বয়ংসেবক সংঘের (আরএসএস) প্রভাবের বিরোধিতায় একটি স্বতন্ত্র উপজাতীয় সংস্কৃতিরও জোর দিয়েছেন। রোট এর আগে এক সাক্ষাত্কারে সংবাদমাধ্যমে বলেছিলেন, “আমাদের নিজস্ব প্রথাগত আইন রয়েছে। এমনকি সুপ্রিম কোর্ট তার কিছু রায়ে জানিয়েছে যে আদিবাসীরা হিন্দু নয়। আমরা ধর্মের আগে এসেছি।
প্রসঙ্গত, ২০১১-র জনগণনা অনুসারে রাজস্থানের মোট জনসংখ্যার ১৪ শতাংশ আদিবাসী। যারা অধিকাংশই বাগাদ অঞ্চল এবং উদয়পুর জেলার কিছু অঞ্চল, প্রতাপগড়, বাঁশওয়াড়া, দুঙ্গারপুর অঞ্চলের বাসিন্দা।
পৃথক ভীল প্রদেশ সম্পর্কে কী বলছে রাজস্থান সরকার?
রাজস্থান সরকারের আদিবাসী উন্নয়ন মন্ত্রী বাবুলাল খারাডি এই আন্দোলন প্রসঙ্গে জানিয়েছেন, গণতন্ত্রে যে কেউ তাঁর দাবি পেশ করতে পারেন। প্রতিটি মানুষই দাবি জানাতে পারেন। কিন্তু শুধুমাত্র জাতির ওপর ভিত্তি করে কোনও রাজ্য গঠিত হতে পারেনা। কারণ আজ আদিবাসীদের জন্য পৃথক রাজ্য গঠিত হবার নজির তৈরি হলে আগামীদিনে অন্য গোষ্ঠীর পক্ষ থেকেও একই দাবি উঠতে পারে। যা সমাজ এবং দেশের জন্য সঠিক নয়।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন