যুদ্ধ নয়, পৃথিবীতে নেমে আসুক শান্তি। তাতে অবগাহন করে সবার মধ্যে ছড়িয়ে পড়ুক সম্প্রীতি - এমন কামনা নিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের গানের কলি ‘বরিষ ধরা মাঝে শান্তির বারি’-কে প্রতিপাদ্য নির্ধারণ করে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০ বরণে বাংলাদেশের ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মঙ্গল শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়েছে।
শুক্রবার (১৪ এপ্রিল) সকাল নয়টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের করা হয়৷ শোভাযাত্রাটি শাহবাগ মোড় হয়ে পুনরায় ক্যাম্পাসে গিয়ে শেষ হয়৷
গত শতকের আশির দশকে সামরিক শাসনের অন্ধকার ঘোচানোর আহ্বানে পহেলা বৈশাখ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা অনুষদ থেকে একটি আনন্দ শোভাযাত্রা বের হয়েছিল। এটিই পরে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নাম ধারণ করে। তিন দশক ধরে প্রতিবছরই পয়লা বৈশাখে চারুকলার শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের উদ্যোগে মঙ্গল শোভাযাত্রা বের হচ্ছে। ২০১৬ সালে ইউনেসকোর সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের স্বীকৃতি পায় এই শোভাযাত্রা। মঙ্গল শোভাযাত্রাকে বাঙালির হাজার বছরের অসাম্প্রদায়িক ঐতিহ্যের মেলবন্ধন হিসেবে দেখা হয়ে থাকে।
শোভাযাত্রা উপলক্ষে সকাল থেকে চারুকলা অনুষদ এলাকায় জড়ো হন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ৷ শোভাযাত্রার নিরাপত্তার দায়িত্বে ছিল আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী৷ বিভিন্ন বাহিনীর বিপুলসংখ্যক সদস্য অবস্থান করেন বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায়৷ শোভাযাত্রায় অংশ নিতে আসা নারীদের পরনে ছিল শাড়ি। অনেকের মাথায় ছিল নানা রঙের ফুল। পুরুষদের পরনে ছিল পাঞ্জাবি।
বাংলার আবহমান ঐতিহ্যের আলোকে মুখোশ, ট্যাপাপুতুল, মাছ, পাখির প্রতিকৃতিসহ লোকসংস্কৃতির নানা উপাদান ছিল এবারের শোভাযাত্রায়। বাঁশ ও কাগজ দিয়ে নির্মিত ময়ূর, নীলগাই, ভেড়া, বাঘ, হাতি ও ট্যাপাপুতুলের (মা ও শিশু) কাঠামোও ছিল এতে।
এবারের মঙ্গল শোভাযাত্রার আয়োজনের সঙ্গে যুক্ত থাকা চারুকলার ভাস্কর্য বিভাগের ছাত্র শিমুল কুম্ভকার সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘যুদ্ধবিগ্রহের পরিবর্তে শান্তিময় বিশ্ব নির্মাণের বার্তা দিতে এবারের শোভাযাত্রার প্রতিপাদ্য ঠিক করা হয়েছে ‘বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি’। প্রতিপাদ্যের সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে শোভাযাত্রার জন্য বিভিন্ন কাঠামো নির্মাণ করা হয়েছে।’
শোভাযাত্রায় অংশ নিয়ে বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কে এম খালিদ বলেন, প্রত্যাশা ও সফলতার বার্তা নিয়ে হাজির হয়েছে বাংলা নববর্ষ ১৪৩০। মঙ্গল শোভাযাত্রা আমাদের সাংষ্কৃতিক ঐতিহ্য। এটি ইউনেস্কোর ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত হয়েছে। সাংস্কৃতিক আন্দোলনের মধ্য দিয়ে আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা হয়েছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মো. আখতারুজ্জামান বলেন, 'মঙ্গল শোভাযাত্রা আবহমান বাংলার সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য। এখন এটি ওয়ার্ল্ড মেমোরি অব হেরিটেজের অন্তর্ভুক্ত। ফলে এই সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যটি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের। বিশ্বের প্রতিটি জনগোষ্ঠীর এটি অসাধারণ সম্পদ। সেটির রক্ষণাবেক্ষণ, সেটি সংরক্ষণ ও সকলের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া এখন সকলের সম্মিলিত দায়িত্ব। এটির মাধ্যমে একটি অসাম্প্রদায়িক ও মানবিক বাংলাদেশ গড়ার বার্তা সময়ে সবসময়ই দেওয়া হয়ে থাকে। যে আতঙ্ক ছিল সেটির প্রতিবাদে সকল মানুষ স্বতস্ফূর্তভাবে অংশগ্রহণ করেছে। সকল ধরনের উগ্রবাদ, সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এটি একটি মানবিক ও অসাম্প্রদায়িক আহ্বান।'
গত ১৯ মার্চ শিল্পী রফিকুন নবী মাছরাঙা পাখি এঁকে উদ্বোধন করেন শোভাযাত্রা প্রস্তুতি পর্বের। এরপরই দীর্ঘমাস জুড়ে শিক্ষার্থীরা বিভিন্ন মুখোশ, সরা, আর ছবি আঁকেন। জয়নুল গ্যালারির পাশেই এ সব শিল্পকর্ম বিক্রি করা হয়। আয়োজনে সরকারের পক্ষ থেকে সম্পৃক্ততা থাকলেও শিক্ষার্থীরা চান নিজেদের মতো শিল্পকর্ম তৈরি করে সেসব বিক্রির মাধ্যমে আয়োজন করতে। এসব শিল্পকর্ম বিক্রি করে শোভাযাত্রার খরচ বহন করা হয়। এবারে শোভাযাত্রার নেতৃত্ব দিচ্ছেন চারুকলার ২৪ ব্যাচের শিক্ষার্থীরা।
শোভাযাত্রায় বাম ছাত্র সংগঠনগুলোর সাংস্কৃতিক প্রতিবাদ:
মঙ্গল শোভাযাত্রায় বাংলার আবহমান ঐতিহ্যের ট্যাপাপুতুল, মাছ, পাখির প্রতিকৃতির পাশে এবার অংশগ্রহণকারীদের হাতে ছিল বাংলাদেশের বিদ্যামন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবি, বাজারে উর্ধ্বগতির দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের দাবি, গণতন্ত্র ও বাক-স্বাধীনতা নিশ্চিত, বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বন্ধসহ বিভিন্ন দাবি সম্বলিত প্ল্যাকার্ড।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বামপন্থী ছাত্র সংগঠনগুলোর মোর্চা গণতান্ত্রিক বাম ছাত্র জোটের নেতাকর্মীরা এমন ব্যতিক্রমী আয়োজন করে। শোভাযাত্রায় অংশগ্রহণকারী ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা প্রথমে আয়োজনে বাধা দেয়। এক পর্যায়ে হাতাহাতিতে গড়ায় এবং কিছু প্ল্যাকার্ড ভেঙেও ফেলে তারা।
এ বিষয়ে বামপন্থী ছাত্র সংগঠন ও ছাত্র জোটের অন্যতম শরিক দল গণতান্ত্রিক ছাত্র কাউন্সিলের সাধারণ সম্পাদক ফাহিম আহমেদ চৌধুরী বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা শুরু হয়েছিল সাবেক স্বৈরশাসক এরশাদের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের অংশ হিসেবে। স্বৈরাচার এরশাদ সরকারের পতন হয়েছে গত ৩০ বছর আগে। কিন্তু এখনো দেশ স্বৈরশাসন থেকে মুক্তি পায়নি। নতুন করে ফ্যাসিবাদী শাসন আমাদের ঘাড়ে চেপে বসেছে। আমরা মঙ্গল শোভাযাত্রা থেকে বর্তমানে ফ্যাসিবাদী শাসনের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক প্রতিবাদের অংশ হিসেবেই জনগণের অধিকারের কথাগুলো তুলে ধরেছি।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সময় বেলা ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাজু ভাস্কর্যের সামনে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন বাতিলের দাবিতে গণস্বাক্ষর সংগ্রহ কর্মসূচিও পালন করে তারা। সে সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টোরিয়াল টিম কর্তৃক কর্মসূচিতে বাধা দেয়ার ঘটনা ঘটেছে।
এসব ঘটনায় তীব্র নিন্দা জানিয়ে সংবাদ বিবৃতি দিয়েছে গণতান্ত্রিক ছাত্র জোট। বিবৃতিতে ছাত্র জোটের নেতৃবৃন্দরা বলেন, বাংলা বর্ষবরণের দিনে দেশ ও জনগণের মঙ্গল কামনা করে অনুষ্ঠিত হয়ে আসা শোভাযাত্রায় অমঙ্গলকর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন (DSA) বাতিল, বিচার বহির্ভুত হত্যাকান্ড বন্ধ এবং দাম কমাও জান বাঁচাও লেখাসহ গণমানুষের কথা সম্বলিত মোটিফ নিয়ে অংশগ্রহণ করলে শোভাযাত্রা চলা অবস্থায় আয়োজক সংশ্লিষ্ট কয়েকজন সরকারি তাবেদারের বাধার মুখে পড়েন গণতান্ত্রিক ছাত্র জোটের নেতাকর্মীরা। মোটিফ কেড়ে নেয়ার চেষ্টা, ভেঙ্গে দেয়া এবং জোটের কর্মীদের লাঞ্চিত করার ঘটনা ঘটেছে।
তারা বলেন, মঙ্গল শোভাযাত্রা বাঙ্গালির জাতীয় জীবনে প্রতিবাদের সংস্কৃতি হিসাবে এসেছিল। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের উত্তাল সময়ে এদেশের ছাত্র জনতা বর্ষবরণকে স্বৈরাচার মৌলবাদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদের হাতিয়ার হিসাবে গ্রহণ করেছিল৷ কিন্তু আওয়ামী ফ্যাসিস্ট আমলে নববর্ষ, শোভাযাত্রাকে তার মূল চেতনা থেকে সরিয়ে স্রেফ আয়োজন সর্বস্ব করে তোলার ষড়যন্ত্র চলছে৷ এরই ধারাবাহিকতায় মঙ্গল শোভাযাত্রায় স্বতস্ফূর্ত অংশগ্রহণে বাধা প্রদানের মত নেক্কারজনক ঘটনায় প্রতিয়মান হয় সকল ভিন্নমত দমনের ভয়াবহ ফ্যাসিস্ট সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ এই সার্বজনীন উৎসবের মধ্যেও ঘটছে৷ সরকার দলীয় নেতাকর্মী ও শোভাযাত্রার আয়োজকদের মধ্যে আওয়ামী সমর্থকরা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরোধীতা, দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির সমালোচনা, বিচারবহির্ভূত হত্যা বন্ধের দাবি পর্যন্ত সহ্য করতে পারছে না। এটা স্পষ্টতই মঙ্গল শোভাযাত্রার গণতান্ত্রিক সংস্কৃতির সাথেও সাংঘর্ষিক৷
জোট নেতৃবৃন্দ বলেন, ফ্যাসিস্ট আওয়ামী সরকারের দীর্ঘ শাসনামলে একদিকে দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনজীবনে দুর্ভোগ নেমে এসেছে; অন্যদিকে মানুষ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকারের কথা বলতে গিয়ে, মত প্রকাশ করতে গিয়ে Digital Security Act(DSA) এর মতো নিপীড়নমূলক আইনে দমন-পীড়নের শিকার হচ্ছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন