বাংলাদেশে এক দশক পর গত ১০ জুন (শনিবার) রাজধানী ঢাকার ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক সমাবেশ করেছে মুক্তিযুদ্ধের (১৯৭১) সময়ে মানবতা বিরোধী অপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি রোধ, দলের আমির শফিকুর রহমানসহ রাজনৈতিক নেতা ও আলেমদের মুক্তি এবং নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থার অধীনের আগামী দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে জামায়াতে ইসলামীর ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ শাখা এই সমাবেশ করেছে।
এই সমাবেশের মধ্যদিয়ে এক দশক পর প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কর্মসূচি পালন করলো দলটি। জামায়াতে ইসলামীর দলীয় সূত্রে জানা যায়, দলটি পুলিশের অনুমতি নিয়ে সর্বশেষ বিক্ষোভ মিছিল করেছিল ঢাকার মতিঝিলে ২০১৩ সালের ৪ ফেব্রুয়ারি। সে হিসাবে ১০ বছরের বেশি সময় পর ঢাকায় কর্মসূচি পালনের অনুমতি পেল জামায়াত।
এর আগে গত ৫ জুন রাজধানীর বায়তুল মোকাররম মসজিদের উত্তর গেটে বিক্ষোভ সমাবেশ ডেকেছিল জামায়াত। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কর্মসূচির অনুমতি দেয়নি। অনুমতি চাইতে গেলে দলের চার আইনজীবী নেতাকে আটক করা হয়। অনুমতি না দেওয়ার কারণ হিসেবে পুলিশ বলেছিল, সাপ্তাহিক কর্মদিবসে সমাবেশ করলে যানজট সহ জনদুর্ভোগের সৃষ্টি হবে।
পরে জামায়াত ১০ জুন (শনিবার) বায়তুল মোকাররমের উত্তর গেটে সমাবেশ করার জন্য আবেদন করে। পুলিশ ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে অনুমতি দেয়।
রাজনৈতিক দল হিসেবে জামায়াতে ইসলামীর নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন নেই। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে দলটিকে নিষিদ্ধেরও দাবি আছে বিভিন্ন মহলের। একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় দলটির শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের বিচার, দণ্ড কার্যকর করা সহ সার্বিক প্রেক্ষাপটে ২০১৩ সাল থেকে জামায়াতে ইসলামীর স্বাভাবিক কার্যক্রম দৃশ্যমান নয়। সারাদেশে দলটির কার্যালয়গুলো অঘোষিতভাবে বন্ধ রয়েছে। তবে বিভিন্ন সময়ে পুলিশের অনুমতি ছাড়াই জামায়াতে ইসলামী ও দলটির ছাত্র সংগঠন ইসলামী ছাত্র শিবিরকে বিক্ষোভ করতে দেখা গেছে।
কর্মসূচির বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী ঢাকা মহানগর দক্ষিণের সেক্রেটারি শফিকুল ইসলাম মাসুদ গণমাধ্যমকে বলেন, ‘রাজনৈতিক কর্মসূচি–বিক্ষোভ সাধারণত উন্মুক্ত স্থানেই হয়। এ মুহূর্তে আমরা জনগণের দাবিগুলোকেই প্রাধান্য দিচ্ছি। আশা করি, ভবিষ্যতে প্রশাসনিক কর্মকর্তারা বিষয়গুলো সমন্বয় করবেন।’
এই প্রসঙ্গে বিরোধী দলগুলোর প্রতিক্রিয়া:
এক দশক পর প্রকাশ্যে কর্মসূচি পালনের অনুমিত পাওয়া এবং কর্মী-সমর্থকদের ব্যাপক উপস্থিতির মধ্য দিয়ে কর্মসূচি পালন করায় দীর্ঘ সময় পর বাংলাদেশের রাজনৈতিক আলোচনার কেন্দ্রে চলে আসে জামায়াতে ইসলামী।
বিরোধী দল বিএনপি বলছে, বাংলাদেশে সুষ্ঠু নির্বাচনে বাধা দান ও রাজনৈতিক দলগুলোর সভা-সমাবেশের অধিকার নিশ্চিত করতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ পশ্চিমাদের চাপ মোকাবিলায় সরকার জামায়াতে ইসলামীকে মাঠে কর্মসূচি পালন করতে অনুমতি দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় বলেছেন, 'জামায়াতের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া নিয়ে নানা কথা-বার্তা আলোচনা হচ্ছে। আসলে যুক্তরাষ্ট্রের ভিসানীতির কারণে সরকার জামায়াতকে সমাবেশ করার অনুমতি দিতে বাধ্য হয়েছে।'
মুক্তিযুদ্ধে বিরোধিতাকারী দল বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীকে সমাবেশের অনুমতি দেওয়া নিয়ে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের প্রতি প্রশ্ন তুলেছে বিএনপির সরকার বিরোধী যুগপৎ আন্দোলনের অন্যতম শরিক রাজনৈতিক জোট গণতন্ত্র মঞ্চ।
বিষয়টিকে সরকারের দুরভিসন্ধিমূলক আখ্যা দিয়ে জোটের নেতারা বলছেন, সরকারের পদত্যাগ, নিরপেক্ষ নির্বাচনকালীন সরকার ও রাষ্ট্র সংস্কারের দাবিতে বিরোধী দলগুলোর করা চলমান আন্দোলনকে আবারও জামায়াতি ব্র্যান্ডিং চেষ্টা করে নিজেদের দেশি-বিদেশি পক্ষগুলোকে তুষ্ট করতে চাইছে আওয়ামী লীগ সরকার।
গণতন্ত্র মঞ্চের অন্যতম শরিক দল নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেছেন, 'জামায়াতের ব্যাপারটা বিস্ময়কর। সরকার এতটাই দ্বিধান্বিত যে, কী করবে বুঝতেই পারছে না। কারণ জামায়াতের লোকজন যখন অনুমতি চাইতে গেছে, তখন তাদের গ্রেপ্তার করা হলো। আবার দেড় ঘণ্টার মধ্যে ছেড়েও দিয়েছে। পরে সমাবেশের অনুমতিও দিয়েছে। এর চাইতে সরকারের অস্থিরতা বেশি কী দেখবেন? রাজনৈতিকভাবে তারা একটা সমস্যাও মোকাবিলা করতে পারেনি।'
জোটের আরেক শরিক দল গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেছেন, 'সভা-সমাবেশ করার অধিকার সবার আছে। কাউকে না করতে দেওয়া হচ্ছে সরকারের অগণতান্ত্রিক আচরণ। এখানে গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নটা হলো, গত ১৫ বছর ধরে আমরা সরকারের একটি রাজনৈতিক অবস্থান দেখছি পাচ্ছি। সেটি হলো জামায়াতকে তাদের শত্রু বলে চিহ্নিত করে আসছে। তারা যেকোনো আন্দোলনকে জামায়াতি নাম দিয়ে ব্র্যান্ডিং করেছে।'
শাসক দলের প্রতিক্রিয়া:
জামায়াতে ইসলামীর সমাবেশের পর আলাদা আলাদা অনুষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতা এবং সরকারের মন্ত্রীরাও বিষয়টি নিয়ে নানা মন্তব্য করেছেন।
রাজনৈতিক সিদ্ধান্তে’ জামায়াতকে ঢাকায় সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও বাংলাদেশ সরকারের কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক।
১১ জুন জার্মান দূতাবাসের চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স ফার্ডিনান্ড ফন ভেইহের সঙ্গে এক বৈঠকের পরে কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাককে সাংবাদিকরা এ বিষয়ে প্রশ্ন করেন। তিনি বলেন, 'এটা রাজনৈতিক ব্যাপার। এটা একটা পলিটিক্যাল ডিসিশন, এটি সময়ই আমাদের বলে দেবে। তারা (জামায়াত) রাজনৈতিক দল, হাই কোর্টের রায় ছিল সংবিধানের সঙ্গে তাদের গঠনতন্ত্র সাংঘর্ষিক, গ্রহণযোগ্য নয়। এ পরিপ্রেক্ষিতেও তাদের তো অনেক জনগণের সমর্থন আছে। এ পরিস্থিতির আলোকে সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে।'
বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও সম্প্রচার মন্ত্রী এবং আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ড. হাছান মাহমুদ বলেছেন, 'জামায়াত এখনও যেহেতু নিষিদ্ধ হয়নি, রাজনৈতিক দল হিসাবে আবেদন করেছে, সে জন্য তাদের সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়েছে।'
তথ্যমন্ত্রীর মতো একই ধরনের মন্তব্য করেছেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক। তিনি বলেছেন, চূড়ান্ত রায় না হওয়া পর্যন্ত জামায়াতকে দোষী বলা যাবে না। বিচার করার পর যতক্ষণ পর্যন্ত রায় না হয়, দোষী সাব্যস্ত না হয়, ততক্ষণ পর্যন্ত তিনি বলতে পারবেন না, জামায়াত নিষিদ্ধ। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে এ অনুমতি দেওয়া হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানের মতে, 'সমাবেশের অনুমতি দিলেও জামায়াতে ইসলামীর বিষয়ে আওয়ামী লীগের নীতির কোনো পরিবর্তন হয়নি। জামায়াত একটি অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল। দেশের অনেক অনিবন্ধিত দলই বিভিন্ন প্রোগ্রামের আয়োজন করে। অনিবন্ধিত রাজনৈতিক দল তাদের সভা-সমাবেশ ইনডোরে করতেই পারে। তারা ইনডোরে সমাবেশ করতে চেয়েছিল, পুলিশ সেটা যাচাই করে অনুমতি দিয়েছেন।'
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন