বাংলাদেশে মজুরি বাড়ানোর দাবিতে সিলেট ও চট্টগ্রামসহ সারাদেশের ১৬৭টি চা বাগানে চা শ্রমিক উনিয়নের ডাকে অনির্দিষ্টকালের জন্য ধর্মঘট পালন করছেন শ্রমিকরা। শনিবার ১৩ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে সারাদেশে একযোগে চা শ্রমিকদের ধর্মঘট চলছে।
বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সিলেট ভ্যালির সভাপতি রাজু গোয়ালা সংবাদমাধ্যমকে বলেন, ‘দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৩০০ টাকা করার দাবিতে গত ৮ আগস্ট থেকে আন্দোলন করে আসছি। বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের দাবি দাওয়া নিয়ে বৃহস্পতিবার ১১ আগস্ট চা বাগানগুলোর মালিকপক্ষ ও শ্রমিকদের নিয়ে সমঝোতা বৈঠক করে বিভাগীয় শ্রম অধিদফতর। মালিকপক্ষের কেউ বৈঠকে আসেননি। এতে কোনও সিদ্ধান্ত ছাড়াই বৈঠক শেষ হয়। ফলে শনিবার থেকে চা বাগানের শ্রমিকরা অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট শুরু করেন।’
বাংলাদেশে বর্তমানে চা শ্রমিকদের ১২০ টাকা মজুরি দেওয়া হয়। চা শ্রমিকরা এই মজুরি ৩০০ টাকা করার দাবি করে আসছে। দাবি আদায়ে বিভিন্ন সময়ে শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করেছেন শ্রমিকরা। চা বাগান মালিকদের প্রতিনিধিত্বকারী সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদের সঙ্গে আলোচনা, স্মারকলিপি পেশও করা হয়েছে। সর্বশেষ গত ৮ আগস্ট থেকে মানববন্ধন ও কর্মবিরতিসহ বিভিন্ন কর্মসূচি পালন করে আসছিলেন তারা।
জানা যায়, নতুন চুক্তি না হওয়ার কারণে শ্রমিকদের বেতনও বাড়ছে না। এ বছরের জুন মাসে চা শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ নেতাদের মধ্যে বৈঠক হয়। সেখানে শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৩০০ টাকা করার প্রস্তাব দেন শ্রমিক নেতারা। পরে চা সংসদ নেতারা মজুরি ১৪ টাকা বাড়িয়ে ১৩৪ টাকা করার প্রস্তাব দেন। তবে তা সন্তোষজনক না হওয়ায় সে প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেন শ্রমিক নেতারা।
এরপর এক মাস পেরিয়ে গেলেও মালিকপক্ষ থেকে কোনো সিদ্ধান্ত জানানো হয়নি। এতে গত ৮ আগস্ট থেকে ১২ আগস্ট পর্যন্ত টানা চার দিন প্রতিদিন দুই ঘণ্টা করে কর্মবিরতি পালন করেন শ্রমিকরা। এতেও মালিকপক্ষের সাড়া না পেয়ে শনিবার ১৩ আগস্ট সকাল থেকে সারাদেশে পূর্ণদিবস ধর্মঘট পালন শুরু হয়।
চা শ্রমিকদের আন্দোলনের বিষয়ে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নৃপেন পাল গণমাধ্যমকে জানান, প্রতিনিয়ত নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম বেড়ে চলেছে। অথচ বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা ১২০ টাকা মজুরিতে কাজ করছেন। দুই বছর পর পর শ্রমিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন ও বাগান মালিকদের সংগঠন বাংলাদেশ চা সংসদ নেতাদের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় চুক্তি হয়। গত চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়ে গেছে ২০২০ সালের ডিসেম্বরে। এরপর ১৯ মাস কেটে গেলেও মালিকপক্ষ শ্রমিকদের সঙ্গে নতুন চুক্তি করেননি।
শ্রমিকদের আন্দোলনের যেন কোনো হিংসা না হয় সে বিষয়ে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘আমরা কোনো অশান্তি চাই না। আমরা আমাদের অধিকার চাই। সব কিছুর দাম বাড়ার কারণে আমাদের শ্রমিকরা আর ঠিকে থাকতে পারছেন না। তাই যত দ্রুত সম্ভব শ্রমিকদের মজুরি ৩০০ টাকা করে তাদের কাজে ফিরিয়ে নিতে মালিকপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করছি।’
তবে চা শ্রমিকদের বর্তমান আন্দোলনকে বে-আইনি বলছেন মালিক পক্ষ। একই সাথে চুক্তির মেয়াদ নিয়েও ভিন্ন কথা বলছেন তারা।
এ বিষয়ে ফিনলে টি কোম্পানির ভাড়াউড়া (শ্রীমঙ্গল, মৌলভীবাজার, সিলেট) ডিভিশনের জেনারেল ম্যানেজার গোলাম মোস্তফা শিবলী জানান, চা বাগান মালিকপক্ষ ও চা শ্রমিক ইউনিয়ন নেতৃবৃন্দে মধ্যে আলাপ আলোচনা চলছে। চুক্তি অনুযায়ী মজুরি বৃদ্ধির সময়সীমা এখনও শেষ হয়নি। মজুরি বৃদ্ধির দাবিতে শ্রমিকরা যে কর্মবিরতি পালন করছে তা বে-আইনি।
বেতন বৈষম্যের শিকার বাংলাদেশের চা শ্রমিকরা:
বাংলাদেশের চা খাতে ১৬৭টি চা বাগানের প্রায় ২০ লাখ চা জনগোষ্ঠীর জড়িত। বিগত সময়ে বিভিন্ন খাতে অনেক পরিবর্তন হলেও জীবনমানের ক্ষেত্রে চা জনগোষ্ঠীর তেমন উন্নয়ন হয়নি। তাদের জীবিকার অন্যতম হচ্ছে চা বাগানে কাজ করা। যেখানে দেশের সব শ্রেণির শ্রমিকের মজুরি বা বেতন বাড়ছে সেখানে চা শ্রমিকদের মজুরী বাড়ছে না।
বাংলাদেশে বর্তমান বাজার মূল্যে সারাদেশের ন্যূনতম দৈনিক মজুরি ৩'শ টাকা। স্থান ও পেশা ভেদে কোথাও কোথাও ৩'শ থেকে ৮'শ টাকা পর্যন্ত দৈনিক মজুরি রয়েছে। অন্যদিকে কেবল চা শ্রমিকদের মজুরি হচ্ছে ১২০ টাকা।
বাংলাদেশে গত ১৫ বছরে চা শ্রমিকের দৈনিক মজুরী বেড়েছে মাত্র ৮৮ টাকা। বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকারের ১৪ বছরের শাসনামলে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি মাত্র ৭২ টাকা বাড়িয়ে ১২০ টাকা করা হয়েছে। বাগানের বাইরে যেখানে শ্রমিকের মজুরী ৩'শ থেকে প্রকারভেদে ৮'শ টাকা।
এ অবস্থায় দেশের ক্রমবর্ধমান উন্নয়নে চা শ্রমিকদের ভূমিকা রাখার কোন সুযোগ নেই। বরং একটি জনগোষ্ঠী পিছিযে থেকে দেশের উন্নয়ন তো কল্পনাই করা যায়না।
বাংলাদেশে চা শ্রমিকদের নানা আন্দোলনের পর ২০০৫ সালে প্রথম মজুরি ৩২ টাকা থেকে বেড়ে ৪৮ টাকা করা হয়। এরপর ২০১২ সালে বর্তমান সরকার তা বাড়িয়ে ৬৫ টাকা নির্ধারণ করে। ২০১৫ সালে এসে শ্রমিকদের মজুরি দাড়ায় ৭৯ টাকায়। আর ২০১৭ সালের জানুয়ারী থেকে শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে দাড়ায় ৮৫ টাকায়। ২০১৯ সালের জানুয়ারি থেকে শ্রমিকদের মজুরি বেড়ে দাড়ায় ১০২ টাকা। ২০২০ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ১২০ টাকা।
এদিকে চা শ্রমিকদের দীর্ঘদিনের আন্দোলন ও দাবির পরিপ্রেক্ষিতে বর্তমান সরকার তাদের দুটি বোনাস দিয়েছে। দূর্গাপুজা এবং দোল পূর্ণিমা (দুল প্রজা বা ফাগুয়া উৎসব) তাদের দুটি বোনাস হিসেবে দেওয়া হচ্ছে মাত্র ৪ হাজার ২শ ৫০ টাকা। তাও সঠিক ভাবে দেওয়া হচ্ছে না। বর্তমান ধর্মঘটে তারা এই বোনাসের পরিমাণ বাড়ানোরও দাবি করছে।
চা বাগান সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে চা শ্রমিকদের মজুরি ও বোনাসের বাইরে শ্রমিকদের আবাসন এবং মেডিকেল ফ্রি দেওয়া হচ্ছে। এছাড়া প্রত্যেক শ্রমিককে প্রতি সপ্তাহে ৩ কেজি ২শ ৭০ গ্রাম করে চাল কিংবা আটা দেওয়া হচ্ছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন