বাংলাদেশ পুলিশের এলিট ফোর্স বাহিনী র্যাপিড অ্যাকশন ব্যাটালিয়ান (র্যাব) এবং এর ৭ জন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিরুদ্ধে 'গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘনমূলক কাজে জড়িত থাকার’ অভিযোগে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। গত ১০ ডিসেম্বর আন্তর্জাতিক মানবাধিকার দিবসে মার্কিন ট্রেজারারি বিভাগ এই নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে।
এর ফলে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা যুক্তরাষ্ট্রের ভিসা পাবেন না এবং দেশটিতে প্রবেশের জন্য অযোগ্য বলেও বিবেচিত হবেন। এই নিষেধাজ্ঞার আওতায় প্রতিষ্ঠান হিসেবে র্যাব যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের কাছ থেকে যেসব সহযোগিতা পাচ্ছিলো সেগুলো বাতিল হতে পারে।
অর্থ দপ্তরের বিজ্ঞপ্তি অনুযায়ী, ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে’ র্যাবকেই নিষেধাজ্ঞার আওতায় আনা হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের মাদকবিরোধী যুদ্ধের সময় সংস্থাটি মানবাধিকার লঙ্ঘন করেছে বলে অভিযোগ তোলা হয়। তাদের এই কাজ বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, মৌলিক স্বাধীনতা, মানবাধিকারের প্রতি সম্মান ও আইনের শাসনকে অবমূল্যায়ন করছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার জন্যও হুমকির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
যুক্তরাষ্ট্রের অর্থ দপ্তর বলেছে, এনজিওগুলি অভিযোগ করছে, র্যাব ও অন্যান্য আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ২০০৯ সাল থেকে গুমের ঘটনাতেও দায়ী।
বিজ্ঞপ্তিতে উল্লিখিত ছয় জন কর্মকর্তা হচ্ছেন - র্যাবের বর্তমান মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন, র্যাবের সাবেক মহাপরিচালক ও বর্তমান বাংলাদেশ পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজির আহমেদ (তিনি জানুয়ারি ২০১৫ থেকে এপ্রিল ২০২০ পর্যন্ত র্যাবের মহাপরিচালক ছিলেন), র্যাবের বর্তমান অতিরিক্ত মহাপরিচালক (অপারেশন্স) খান মোহাম্মদ আজাদ, তোফায়েল মুস্তাফা সরওয়ার (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক-অপারেশন্স, জুন ২০১৯-মার্চ ২০২১), মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, অপারেশন্স, সেপ্টেম্বর ২০১৮-জুন২০১৯) এবং মোহাম্মদ আনোয়ার লতিফ খান (সাবেক অতিরিক্ত মহাপরিচালক, অপারেশন্স, এপ্রিল-২০১৬-সেপ্টেম্বর ২০১৮)।
গুরুতর মানবাধিকার লংঘনে জড়িত থাকার জন্য বেনজির আহমেদের ওপর ভিসা বিধিনিষেধ আরোপ করার কথা ঘোষণা করেছে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর। যার ফলে তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশের অযোগ্য হবেন। একইসঙ্গে নিষেধাজ্ঞাপ্রাপ্ত বেনজির আহমেদ ও র্যাবের মহাপরিচালক চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুন সহ র্যাবের আরও চারজন বর্তমান ও সাবেক কর্মকর্তার বিদেশে সম্পদ থাকলে সেগুলো বাজেয়াপ্ত হতে পারে।
যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দপ্তর গতকাল পৃথকভাবে ‘মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগ’ তুলে বেনজীর আহমেদ ও র্যাব-৭ এর সাবেক কমান্ডিং অফিসার লেফটেন্যান্ট কর্নেল মিফতাহ উদ্দিন আহমেদের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে নিষেধাজ্ঞাও দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিংকেন বলেছেন, মিফতাহ উদ্দিন আহমেদ কক্সবাজারের সাবেক কাউন্সিলর ইকরামুল হককে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যায়’ জড়িত ছিলেন।
র্যাবের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে গত বছর অক্টোবর মাসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রশাসনকে ১০ জন মার্কিন সিনেটর চিঠি দিয়েছিলেন। গত আগস্ট মাসে যুক্তরাজ্যের ‘গুয়ের্নিকা ৩৭ চেম্বার’ র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তরে আবেদন জানায়।
এদিকে নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে তলব করে ব্যাখ্যা চাওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। শনিবার (১১ ডিসেম্বর) দুপুরে ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে অনুষ্ঠিত বিসিএস (পররাষ্ট্র বিষয়ক) অ্যাসোসিয়েশনের (এওএফএ) এক অনুষ্ঠানে তিনি এসব কথা বলেন। আব্দুল মোমেন বলেন, ‘মার্কিন নিষেধাজ্ঞা দুঃখজনক। র্যাবের কারণে জঙ্গি ও সন্ত্রাসমুক্ত হয়েছে বাংলাদেশ। ঢাকার মার্কিন রাষ্ট্রদূতের সঙ্গে এ বিষয়ে আলোচনা হয়েছে।’
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, ‘পররাষ্ট্র সচিব মাসুদ বিন মোমেন রবার্ট আর্ল মিলারকে তলব করেন। তিনি মার্কিন রাষ্ট্রদূতকে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে আলোচনা না করেই যুক্তরাষ্ট্র এই সিদ্ধান্তটি নিয়েছে। এটি দুঃখজনক।’
এদিকে রাজধানীতে আলাদা এক অনুষ্ঠানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দাবি নাকচ করে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল বলেছেন, অনেক সময় মাদক কারবারিরা নিজেদের রক্ষা করার জন্য আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে। আত্মরক্ষার জন্য প্রশিক্ষিত আইনশৃঙ্খলা বাহিনী পাল্টা গুলি চালালে কখনো কখনো হতাহতের ঘটনা ঘটে। তবে প্রতিটি ঘটনাই ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে তদন্ত করা হয়।
বাংলাদেশে গুমের সংখ্যা
মানবাধিকার সংস্থা আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) ৩০ আগস্ট প্রকাশিত হিসাব অনুয়ায়ী গত ১৫ বছরে ৬১৪ জন মানুষ গুমের শিকার হয়েছেন। এর মধ্যে ৭৮ জনের লাশ উদ্ধার হয়েছে৷ ৮৯ জনকে গ্রেফতার দেখানো হয়েছে এবং ৫৭ জন কোনো না কোনোভাবে ফিরে এসেছেন৷ অন্যরা কোথায় আছেন, কেমন আছেন তার কোনো তথ্য নাই পরিবারের কাছে৷ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীও কোনো তথ্য দিতে পারছে না৷
আসক বলছে, র্যাব, ডিবি, পুলিশ ও গোয়েন্দা বিভাগের পরিচয়ে সাদা পোশাকে বিভিন্ন সময়ে ওইসব ব্যক্তিদের তুলে নিয়ে যাওয়া হয়েছে৷ অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সংশ্লিষ্ট বাহিনী তাদের গ্রেফতার বা আটকের বিষয়টি অস্বীকার করেছে৷ পরিচিত কিংবা প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ অথবা আলোচনা বা আলোড়ন সৃষ্টি না হলে খুব কমই উদ্ধারের তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়৷
কিছু কিছু ক্ষেত্রে গুম হওয়ার কিছুদিন পর হঠাৎ করেই তাদের কোনো মামলায় গ্রেপ্তার দেখানো হয় বা ‘ক্রসফায়ারে’ তাদের মৃত্যুর সংবাদ পাওয়া যায়৷ যারা ফিরে আসতে পেরেছেন তাদের ক্ষেত্রে নিখোঁজ থাকার সময় কী ঘটেছে তাও জানা যায় না৷
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন