বাংলাদেশে টানা তিন সপ্তাহ আন্দোলনের ফলে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ৫০ টাকা বৃদ্ধি করা হয়েছে। এর ফলে বর্তমান দৈনিক মজুরি ১২০ টাকা থেকে বেড়ে ১৭০ টাকা দাঁড়াবে। শনিবার (২৭ আগস্ট) বিকেলে গণভবনে চা বাগান মালিকদের সংগঠন - বাংলাদেশ টি অ্যাসোসিয়েশনের (বিটিএ) সঙ্গে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বৈঠকে চা-বাগানমালিকদের ১৩ সদস্যের একটি প্রতিনিধিদল অংশ নেয়। প্রায় আড়াই ঘণ্টার বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব আহমদ কায়কাউস সাংবাদিকদের কাছে মজুরি বৃদ্ধির সিদ্ধান্তের বিষয়টি তুলে ধরেন।
আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘চা–শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি ১৭০ টাকা নির্ধারণ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। মজুরি নির্ধারণের পাশাপাশি বার্ষিক ছুটি, বোনাস সহ উৎসব ছুটি আনুপাতিক হারে বাড়বে। অসুস্থতা ছুটি বাড়ানো হবে। চিকিৎসা ব্যয়ের চাঁদা মালিকপক্ষ বহন করবে। ভবিষ্যৎ তহবিলে নিয়োগকর্তার চাঁদা আনুপাতিক হারে বাড়বে।’
এছাড়াও বৈঠকে আরো বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গৃহিতী হয়েছে। সেগুলো হচ্ছে- ভর্তুকি মূল্যে রেশন সুবিধা বৃদ্ধি করা, চিকিৎসা সুবিধা, অবসরপ্রাপ্ত শ্রমিকদের পেনশন, চা–শ্রমিকদের পোষ্যদের শিক্ষা বাবদ ব্যয়, রক্ষণাবেক্ষণ, গোচারণভূমি বাবদ ব্যয়, বিনামূল্যে বসতবাড়ি ও রক্ষণাবেক্ষণ বাবদ শ্রমিককল্যাণ কর্মসূচি এবং বাসাবাড়িতে উৎপাদন বাড়ানো।
প্রধানমন্ত্রী এই সিদ্ধান্ত মেনে নিয়ে শ্রমিকদের কাজে ফিরতে বলেছেন বলে জানান মুখ্য সচিব। তিনি বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী বলেছিলেন চা-শ্রমিকদের পক্ষে কথা বলে মজুরি বাড়াবেন, সেটা উনি করেছেন। আগামীকাল থেকে চা–শ্রমিকদের কাজে যোগ দিতে বলেছেন তিনি। শীঘ্রই চা–শ্রমিকদের সঙ্গে ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন।’
এদিকে চা শ্রমিকদের দৈনিক মজুরি বৃদ্ধির এই সিদ্ধান্ত ঘিরে মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। চা বাগান মালিক ও চা শ্রমিক ইউনিয়নের পক্ষ থেকে সিদ্ধান্ত মেনে নেয়ার ঘোষণা দেয়া হলেও শ্রমিকদের মাঝে ক্ষোভ বিরাজ করছে। অসন্তোষ প্রকাশ করেও শ্রমিকরা জানান, নেতাদের আহ্বানে কাজে ফিরবেন তাঁরা।
প্রধানমন্ত্রীর এই সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানিয়েছে বাংলাদেশ চা শ্রমিক ইউনিয়ন। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নৃপেন পাল পিপলস রিপোর্টারকে বলেন, ‘আমাদের চা–শ্রমিকদের দাবি ছিল প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার। প্রধানমন্ত্রী মালিকপক্ষের সাথে আলোচনা করে ১৭০ টাকা নির্ধারণ করেছেন। আমরা তাঁর সিদ্ধান্ত মেনে নিয়েছি। তিনি আমাদের নেত্রী, দেশের নেত্রী। মাননীয়া প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তাঁর এই সিদ্ধান্তকে আমরা শ্রদ্ধা জানাই। আমাদের চা–শ্রমিকেরা কাজে যোগদান করবেন।’
তবে চা শ্রমিকদের অনেকই জানাচ্ছেন ভিন্ন কথা। এবিষয়ে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বেশ কয়েকজন চা শ্রমিকের সাথে কথা হয় পিপলস রিপোর্টারের প্রতিনিধির।
শ্রমিকরা জানান, তাঁরা প্রধানমন্ত্রীর সিদ্ধান্ত মেনে চা শ্রমিক নেতাদের কথা মতো কাজের ফিরে গেলেও বর্তমান বাজার মূল্যে ১৭০ টাকা দৈনিক মজুরি জুলুম। অনেকটা নিরুপায় হয়েই কাজে ফিরছেন তাঁরা।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে সিলেটের লাক্কাতুরা চা বাগানের এক শ্রমিক বলেন, ’আমরা নিজেদের কথা বলতে পারি না। পঞ্চায়েত প্রধান ও ইউনিয়নের নেতারা যা বলে সেটাই। আমরা দাসত্বকেই মেনে নিয়েছি। কিন্তু ১৭০ টাকা দিয়ে বর্তমান বাজারে কী হয়?’
চা শ্রমিকদের আন্দোলনের শুরু থেকেই চা শ্রমিক নেতাদের প্রতি মালিক পক্ষের হয়ে কাজ করার অভিযোগ শোনা যাচ্ছিল। এই বিষয়টি নিয়েও কথা হয় একাধিক চা শ্রমিক, চা শ্রমিক সন্তান ও আন্দোলকারী নেতাদের সাথে।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় চা শ্রমিকদের বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া সন্তানদের সংগঠন বিশ্ববিদ্যালয় চা ছাত্র সংসদের (ইউটিএসও) সাবেক সহ-সভাপতি মিখা পিরেগুয়ের সাথে। তিনি বলেন, ‘৫০ টাকা মজুরি বৃদ্ধি করে চা শ্রমিকদের আন্দোলনকে বাঞ্চাল করা হলো। এটা শ্রমিকদের সাথে তামাশা। বর্তমানে যারা চা শ্রমিক ইউনিয়নের নেতৃত্বে যারা আছেন তাঁরা সবাই ক্ষমতাসীন দলের লোকজন; মালিক পক্ষের হয়ে দালালি করেন। চা শ্রমিক ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের লেজুড় সংগঠনে পরিণত হয়েছে।’
মৌলভীবাজারের এক চা শ্রমিক নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘বর্তমানে অধিকাংশ চা ইউনিয়ন নেতা ও পঞ্চায়েত নেতারা দুর্নীতির সাথে জড়িত। তাঁরা সবাই স্থানীয় পর্যায়ে আওয়ামী লীগ ও তার বিভিন্ন অঙ্গসংগঠনের সাথে জড়িত। তাঁরা ক্ষমতাধর, তাদের সিদ্ধান্তের বাইরে শ্রমিকরা কিছু বলতে পারে না।’
এছাড়াও একাধিক চা শ্রমিক ও আন্দোলনের অংশগ্রহণকারী চা শ্রমিক সন্তান একই বিষয়ে অভিযোগ তুলেন।
এবিষয়ে খোঁজ নিয়ে জানা যায় তাঁদের অভিযোগ সত্যি। চা শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) নৃপেন পাল হবিগঞ্জ জেলার চুনারুঘাট উপজেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক পদে রয়েছেন। সংগঠনটির কেন্দ্রীয় কমিটির সাবেক সাধারণ সম্পাদক ও বর্তমান নির্বাহী উপদেষ্টা রাম ভজন কৈরী মৌলভীবাজার জেলা শ্রমিক লীগের সহ-সভাপতির দায়িত্বে রয়েছেন। এছাড়াও বর্তমান কেন্দ্রীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিজয় হাজরাও স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতির সাথে জড়িত এবং ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনও করেছেন।
এই প্রসঙ্গে জানতে চাইলে নৃপেন পাল বলেন, ’এখানে চা শ্রমিক ইউনিয়নের যারা দায়িত্বে আছেন, তাদের অনেকেই স্থানীয় রাজনীতির সাথে জড়িত আছে। তবে রাজনীতি করে না এমন লোকও আছে।’ তবে মালিক পক্ষ বা সরকারের হয়ে কাজ করার অভিযোগ অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এটা বিরোধী পক্ষের প্রচারণা। আমরা এমন কিছু করি না।’
এদিকে বেশ কয়েকজন শ্রমিক জানিয়েছেন চা শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান কমিটির মেয়াদোত্তীর্ণ হয়েছে অনেক আগেই। সামনে নতুন কমিটি হবে। তাই বর্তমানে যারা দায়িত্বে রয়েছেন মালিক পক্ষ ও সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার চেষ্টা করছেন।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চা শ্রমিক ইউনিয়নের বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হয়েছে এক বছর আগে। ২০২১ সালের ২১ জুন বর্তমান কমিটির মেয়াদ শেষ হলেও এখনো পর্যন্ত নতুন কমিটি হয়নি।
চা শ্রমিক ইউনিয়নের গঠনতন্ত্র অনুযায়ী কমিটির মেয়াদ শেষ হওয়ার তিন মাস আগে নতুন কমিটি করার জন্য শ্রম মন্ত্রণালয়ে আবেদন করতে হয়। মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন সাপেক্ষে নতুন কমিটি গঠন করা হয়।
কমিটির মেয়াদ সম্পর্কে নৃপেন পাল বলেন, ’আমাদের বর্তমান কমিটির মেয়াদ এক বছর আগেই শেষ হয়েছে। আমরা গঠনতন্ত্র অনুযায়ী নতুন কমিটি করার জন্য আবেদন করেছি।’
উল্লেখ্য, বর্তমানে বাংলাদেশে নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলিয়ে চা বাগান রয়েছে আড়াইশর কাছাকাছি। এর মধ্যে চা বোর্ডের নিবন্ধিত চা বাগান রয়েছে ১৬৭টি। মৌলভীবাজার, হবিগঞ্জ, সিলেট, চট্টগ্রাম, রাঙ্গামাটি, পঞ্চগড়, ঠাকুরগাঁও- এ সাত জেলার মোট ২,৭৯,৫০৬.৮৮ একর জমিতে গড়ে উঠেছে চা বাগানগুলো। এসব চা বাগানে শ্রমিকের সংখ্যা দেড় লাখেরও বেশি।
গত ৯ আগস্ট থেকে চুক্তি অনুয়ায়ী মজুরি বাড়ানোর দাবিতে দুই ঘণ্টা কর্মবিরতি শুরু করেন চা শ্রমিকরা। দাবি আদায় না হওয়ায় গত ১৩ আগস্ট থেকে সারাদেশের চা-বাগানগুলোয় অনির্দিষ্টকালের ধর্মঘট করেছিলেন শ্রমিকেরা। দাবি আদায়ে গত কয়েক দিন উত্তাল ছিল চা-বাগানগুলো। আন্দোলন সফল করতে শ্রমিকদের সড়ক, মহাসড়ক ও রেলপথ অবরোধ করতে দেখা গেছে।
গত ২০ আগস্ট সরকারের প্রতিনিধিদের সঙ্গে বৈঠকে বসে চা শ্রমিক ইউনিয়ন। বৈঠকে চা শ্রমিকদের মজুরি ১২০ থেকে ২৫ টাকা বাড়িয়ে ১৪৫ টাকা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু চা শ্রমিকরা এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে ৩০০ টাকা দৈনিক মজুরির দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে যেতে থাকে। এরই প্রেক্ষিতে আজ বিকেলে চা-বাগানমালিকদের সাথে বৈঠকে বসেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন