জুন মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ থেকে ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের আইনসভার নির্বাচনের ভোট গণনা শুরু হয়েছে। ইউনিয়নের প্রধান সদস্য দেশগুলিতে ফলাফলও ঘোষণা হয়ে গেছে। কয়েকটি ছোট দেশে (এস্তোনিয়া, স্লোভেনিয়া) অন্তিম ফলাফল এখনও প্রকাশিত হয়নি, তবে মোটামুটি কোন দল কতগুলি আসন পেয়েছে তা ঘোষিত হয়েছে। এই সামগ্রিক ফলাফল থেকে ইউরোপীয় রাজনীতির যে সামগ্রিক চিত্র উঠে এসেছে তা যাঁরা প্রগতিশীল রাজনীতিতে আস্থা রাখেন, তাঁদের জন্য খুব একটা আশাপ্রদ নয়।
ইউরোপের রাজনীতিতে অতি-দক্ষিণপন্থীদের উত্থান অব্যহত। তাঁরা ইউরোপীয় ইউনিয়নের প্রধান সদস্য দেশগুলিতে বেশ ভালো ফলাফল করেছেন। ফ্রান্সে অতি-দক্ষিণপন্থীরা ৮১-টি আসনের মধ্যে ৩৫-টি, ইতালিতে ৭৬-টি আসনের মধ্যে ৩২-টি এবং জার্মানিতে ৯৬-টি আসনের মধ্যে ১৫-টি আসন লাভ করেছে। ইউনিয়নের সবথেকে প্রভাবশালী চারটি রাষ্ট্রের মধ্যে একমাত্র স্পেনে অতি দক্ষিণপন্থীরা তেমন ভালো ফল করতে পারেনি।
ভোট শতাংশের নিরিখে এই সাফল্যর গুরুত্ব আরও বেশি। ফ্রান্সে অতি-দক্ষিণপন্থীদের মধ্যে প্রধান দল ন্যাশনাল র্যালি (Rassemblement National) ৩১.৩৭% ভোট পেয়ে প্রথম স্থানে উঠে এসেছেন, ইতালিতে দুটি অতি-দক্ষিণপন্থী দল মিলিত ভাবে প্রায় ৩৭.৮% ভোট পেয়েছে – এখানেও অতি-দক্ষিণপন্থীরা প্রথম স্থানে, আর চমকপ্রদ ভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এই প্রথমবার জার্মানিতে অতি-দক্ষিণপন্থীরা প্রায় ১৫.৮% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থান অধিকার করেছে।
জার্মানির অতি-দক্ষিণপন্থী দল AfD-এর নেতা ম্যাক্সিমিলিয়ান ক্রাহ্ এক সাক্ষাৎকারে প্রকাশ্যে নাৎসি এস-এস বাহিনীর পক্ষে সাফাই দেওয়ায় যে প্রবল বিতর্ক সৃষ্টি হয়েছিল, তাতে অনেকেই ভেবেছিলেন ভোট বাক্সে তার নেতিবাচক প্রভাব দেখা যাবে। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল সেই ভাবনাকে ভুল প্রমাণিত করেছে।
ইউরোপিয়ান নির্বাচনে, তুলনামূলক ভাবে, র্যাডিক্যাল বামপন্থীদের শক্তিক্ষয় না হলেও তারা তেমন ভালো ফলও করতে পারেননি। বিচ্ছিন্ন ভাবে তারা কোথাও কোথাও ফলাফল ভালো করেছেন, যেমন - প্রত্যাশিত ভাবে বেলজিয়াম, গ্রিস ও ফিনল্যান্ডে। অপ্রত্যাশিতভাবে চেক প্রজাতন্ত্রে। বিশেষ করে ফ্রান্স, যা ইউরোপের র্যাডিক্যাল বামপন্থার অন্যতম কেন্দ্র, তাতে ফলাফল একেবারেই আশানুরূপ হয়নি।
জঁ-লুক মেলশোঁ-এর নেতৃত্বে পরিচালিত বামজোট ‘Nouvelle Union populaire écologique et sociale’ (‘নয়া পরিবেশ ও সামাজিক গণ ইউনিয়ন’) বা সংক্ষেপে NUPES ২০২২ সালের জুন মাসের জাতীয় আইনসভার নির্বাচনে ফ্রান্সের প্রধান বিরোধী শক্তি এবং প্রধান বামপন্থী বিকল্প হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেছিল। এইবারে ইউরোপীয় নির্বাচনে মেলশোঁ-র দল একক ভাবে শক্তি বৃদ্ধি করেছে ঠিকই, কিন্তু সমস্ত বামপন্থী শক্তি এক ছাতার তলায় জোট করে না লড়ায় রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁর বিরুদ্ধে প্রধান বিরোধী শক্তির জায়গাটা নিয়ে নিয়েছেন অতি-দক্ষিণপন্থী মারিন ল্য পেন ও তাঁর দল, ন্যাশনাল র্যালি (Rassemblement National)।
রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁ-এর সমর্থক জোট ‘অঁসম্বলঁ’ বা ‘Ensemble’ এইবারের ইউরোপীয় নির্বাচলে প্রবল ভাবে ধাক্কা খেয়েছেন। ইউরোপীয় আইনসভায় তাঁদের আসন ২৩ থেকে ১০-এ নেমে গেছে। এই প্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁ নির্বাচনের ফল প্রকাশের পরই দ্রুততার সঙ্গে সময়ের আগেই ফরাসী জাতীয় আইনসভার নির্বাচনের আহ্বান করেছেন। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের মতে তিনি আশা করেছিলেন, চটজলদি নির্বাচন আহ্বান করার ফলে একদিকে বিরোধীদের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় থাকবে না আর অন্যদিকে বাম দলগুলির অনৈক্যের সুযোগ নিয়ে তাঁদের অতি-দক্ষিণপন্থা বিরোধী নির্বাচকদের একাংশের সমর্থন তিনি কিছুটা নিজের দিকে টানতে পারবেন।
মাক্রোঁর এই হিসেবে তেমন ভ্রান্তি ছিল না। কিন্তু নির্বাচনের ফলাফল থেকে শিক্ষা নিয়ে ফরাসী বাম দলগুলি অভাবনীয় ক্ষিপ্রতার সঙ্গে ঐক্যবদ্ধ হয়ে যাওয়ার ঘটনায় মাক্রোঁর এই পরিকল্পনার জাহাজের অকাল সলিল সমাধি হয়েছে। সাধারণতঃ প্রবল কলহপ্রিয় ফরাসী বামেরা, যাঁদের এক ছাতার তলায় আনা অত্যন্ত কঠিন কাজ, তাঁরা নির্বাচনে অতি-দক্ষিণপন্থার সাফল্যের বিপদ উপলব্ধি করে যুদ্ধকালীন তৎপরতায় নতুন একটি নির্বাচনী জোট তৈরি করেছেন। এই জোটের নাম ‘Nouveau Front Populaire’ বা নিউ পপুলার ফ্রন্ট।
১৯৩০-এর দশকে ফ্রান্সে প্রথম পপুলার ফ্রন্ট তৈরি হয়েছিল ফ্যাসিবাদী শক্তির প্রতিরোধে। ১৯৩৬ সালে এই ফ্রন্ট ফ্রান্সের প্রথম সমাজতন্ত্রী সরকার গঠন করে, ফ্রান্সের প্রধানমন্ত্রী হন লিওঁ ব্লুম, যদিও এক বছরের অধিক এই সরকার ক্ষমতায় থাকেনি, কিন্তু নানা সীমাবদ্ধতা সত্ত্বেও ফ্রান্সে ফ্যাসিবাদের উত্থান রোধে এই ফ্রন্ট সফল হয়েছিল।
নতুন পপুলার ফ্রন্ট, যেখানে মেলশোঁ-এর La France Insoumise (বিদ্রোহী ফ্রান্স) বা LFI, ফ্রান্সের কমিউনিস্ট পার্টি বা Parti Communiste Français, ফরাসী সমাজতন্ত্রী দল বা Parti Socialiste এবং পরিবেশবাদী গ্রিন পার্টি, যার পোশাকি নাম ‘Europe Écologie Les Verts’ সহ মধ্য-বাম থেকে বাম ফ্রান্সের প্রায় সকল অতি-দক্ষিণপন্থা বিরোধী শক্তি একত্রিত হয়েছে। তারা প্রথম পপুলার ফ্রন্টের পদাঙ্ক অনুসরণ করে ল্য পেন এবং যাঁর অপদার্থতার জন্য তাঁর উত্থান সম্ভব হয়েছে সেই মাক্রোঁ - দুজনের বিরুদ্ধেই লড়াই করতে আগ্রহী বলে জানিয়েছে। আগামী আইনসভার নির্বাচনে প্রত্যেকটি আসনে পপুলার ফ্রন্ট সমর্থিত এক জনই প্রার্থী থাকবেন এবং সেই প্রার্থীকেই সকল দল সমর্থন করবে বলবে ইতিমধ্যেই সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। ইউরোপিয়ান ইউনিয়নের নির্বাচনে আলাদা আলাদা ভাবে লড়া যে একটা ভুল ছিল, এ কথাও স্বীকার করে নিয়েছেন পপুলার ফ্রন্টের নেতৃত্ব।
নতুন এই পপুলার ফ্রন্ট গঠন স্পষ্টতই ফ্রান্সের নির্বাচনী সমীকরণ পাল্টে দিয়েছে বলে পর্যবেক্ষকদের মত। সাম্প্রতিকতম জনমত সমীক্ষা অনুসারে আসন্ন নির্বাচনে পপুলার ফ্রন্ট পেতে পারে ১৮০ থেকে ২১০-টি আসন, অতি-দক্ষিণপন্থী ন্যাশনাল র্যালি (Rassemblement National) পেতে পারে ২০০ থেকে ২৪০-টি আসন। তুলনায় রাষ্ট্রপতি মাক্রোঁ-র সমর্থক দলের জোট ‘অঁসম্বলঁ’ বা ‘Ensemble’ পেতে পারে মাত্র ৮০ থেকে ১১০-টি আসন।
ভোট শতাংশ কোন জোট কত পেতে পারে, সমীক্ষায় তার ফলাফল দেখলে চিত্রটি আরও চমকপ্রদ ঠেকবে। সমীক্ষায় প্রকাশ, ন্যাশনাল র্যালি ৩৫% ভোট পেয়ে প্রথম স্থানে থাকতে পারে। খুব স্বাভাবিক এই চিত্রটি। কিন্তু ইউরোপীয় আইনসভার ভোট চিত্র সম্পূর্ণ উল্টে দিয়ে জনমত সমীক্ষায় প্রকাশ পপুলার ফ্রন্ট উঠে আসতে পারে ২৯% ভোট পেয়ে দ্বিতীয় স্থানে। তুলনায় সমীক্ষকরা অঁসম্বলঁ-এর ভোট শতাংশ ২১%-এর বেশি হবে না বলে মনে করছেন।
একাধিক জনমত সমীক্ষায় যে ঝোঁক উঠে আসছে, তা যদি সঠিক হয়, তাহলে প্রশ্ন উঠতে পারে, নতুন পপুলার ফ্রন্ট এত দ্রুত এত সমর্থন আদায় করল কিভাবে ? কিছুটা কৃতিত্ব অবশ্যই তার কর্মসূচীর, যা মাক্রোঁর নব্য-উদারবাদ ও ল্য-পেনের অতি-দক্ষিণপন্থার একটা বিকল্প নির্বাচকমন্ডলীর কাছে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছে। তবে আরও গুরুত্বপূর্ণ সম্ভবতঃ ফ্রন্টে রাজনৈতিক দলের পাশাপশি সরাসরি ফ্রান্সের পাঁচটি প্রধান ট্রেড ইউনিয়ন, ছ’টি বৃহৎ ও অনেকগুলি ক্ষুদ্র নাগরিক সংগঠনের অংশগ্রহণ (এর মধ্যে পেনশন প্রাপকদের সংগঠন ও ফ্যাসিবাদ বিরোধী নাগরিক সংগঠন খুবই প্রভাবশালী)। এই সংগঠনগুলির বিশাল নাগরিক ভিত্তি, যা সাধারণতঃ নির্বাচনের সময় সরাসরি কোনও রাজনৈতিক জোটের হয়ে এইভাবে সক্রিয় হয় না, তার এইবারের অংশগ্রহণেই দ্রুত পাশা উল্টে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে।
ফ্রান্সের প্রথম পপুলার ফ্রন্ট ব্যর্থ হয়েছিল তার সদস্য দলগুলির পারস্পরিক দ্বন্দ্ব-বিরোধের ফলে। অনেক সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও এক বছরের মাথায় ব্লুমের পপুলার ফ্রন্ট সরকারের পতন ফরাসী বামপন্থার দেশকে বিকল্প দিকে চালনা করার একটি ঐতিহাসিক সুযোগের অপমৃত্যু বলে মনে করা হয়। সেই ব্যর্থতার ভূত এখনও ফরাসী বামপন্থীদের তাড়া করে।
নতুন পপুলার ফ্রন্ট ইতিহাস থেকে শিক্ষা নিয়ে সেই আত্ম-কলহের ভ্রান্তি এড়িয়ে ফ্রান্সকে একই সঙ্গে অতি-দক্ষিণপন্থার বিপদ ও নব্য-উদারবাদের ব্যর্থতার জাল থেকে বের করতে পারবে কিনা, তা সময় বলবে। আপাতত শুধু এইটুকুই বলা যেতে পারে, দেশের জনতার একটা বড় অংশ নতুন পপুলার ফ্রন্টের উপর ভরসা রাখছে। ফ্রন্টের নেতৃত্বের ঐতিহাসিক দায়িত্ব সেই ভরসার যোগ্য হয়ে ওঠা।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন