এক সময় হাসিনা সরকার যাঁঁকে 'গরিবের রক্তচোষা' বলে অভিহিত করেছিল, যাঁঁকে কারাবাসের সাজাও শোনানো হয়েছিল, আজ সেই নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ মুহাম্মদ ইউনূস হতে চলেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান। আন্দোলনকারী ছাত্রদের দাবী মেনেই এমন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। কেমন ছিল ডঃ ইউনূসের লড়াই? জানা যায়, মুক্তিযোদ্ধা শেখ মুজিবর রহমানের অনুরাগী ছিলেন তিনি। তাঁর মৃত্যুর পর হাসিনার সঙ্গে বহু দিন সুসম্পর্কও ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে সেই সম্পর্ক বিষময় হয়ে ওঠে।
জুলাই মাস থেকে চলতে থাকা বাংলাদেশের ছাত্র আন্দোলনের জেরে মৃত্যু হয়েছে চারশোরও বেশি মানুষের। রবিবার থেকে আন্দোলন বাড়তে থাকায় সোমবার প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে ইস্তফা দিয়ে দেশ ছাড়েন শেখ হাসিনা। এরপর সেনা প্রধানের পক্ষ থেকে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনের ঘোষণা করা হয়। সেই সরকারের প্রধান করার জন্য মুহাম্মদ ইউনুসের নাম প্রস্তাব দেয় বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মঞ্চ। বাংলাদেশের দৈনিক প্রথম আলো সূত্রে খবর, ইউনুস সেই আবেদন মেনে নিয়েছেন। বর্তমানে তিনি প্যারিসে আছেন। এক-দু'দিনের মধ্যে তিনি দেশে ফিরে দায়িত্ব নেবেন।
১৯৪০ সালে চট্টগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন মুহাম্মদ ইউনুস। ভ্যান্ডারবিল্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি পড়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে যাওয়ার আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। পিএইচডি শেষ করার পর ইউনূস বাংলাদেশে ফিরে আসার আগে মিডল টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটিতে সহকারী অধ্যাপক হতে যান। ১৯৭৪ সালে বাংলাদেশে ফিরে তিনি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি বিভাগে যোগ দেন। সেই সময়কালে গ্রামের অলিগলি ঘুরে দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি দেখার চেষ্টা করতেন। প্রথমে এক নারীকে ঋণ দিয়ে কাজ শুরু করেন। পরে ৪২ জন নারীর একটি দলকে টাকা ধার দেন। সেই পদক্ষেপ থেকে একটি ‘মাইক্রোক্রেডিট’ গবেষণা প্রকল্প তৈরি করেন। আর ১৯৮৩ সালে গড়ে ওঠে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক।
বিশ্বের সবচেয়ে দরিদ্র মানুষদের ক্ষুদ্র ব্যবসায়িক ঋণ প্রদানের জন্য সবচেয়ে বেশি পরিচিত তিনি - এই কারণে তাঁকে 'গরিবের ব্যাঙ্কার' বলা হত। গোটা বিশ্ব জুড়ে প্রশংসা শুরু হয় তাঁর। এরপর ২০০৬ সালে নোবেল পুরস্কার পান মুহাম্মদ ইউনূস। গত এক দশকে, ইউনূস দরিদ্র বাংলাদেশীদের বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবা, বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ এবং ফোন পরিষেবা প্রদান সহ কয়েক ডজন সামাজিক কাজ করে আসছেন।
হাসিনা সরকারের আমলে ইউনূস এবং তাঁর টেলিকমিউনিকেশন কোম্পানি গ্রামীণ টেলিকমের আরও তিন কর্তাকে বাংলাদেশের শ্রম আইন লঙ্ঘনের দায়ে ছ’মাসের কারাদণ্ড দেওয়া হয়। জামিন পেয়ে যাওয়ায় জেলে যেতে না-হলেও জালিয়াতি, অর্থ নয়ছয়ের অভিযোগে ২০০টিরও বেশি মামলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে। ইউনুসের বয়স হয়েছে বলে গ্রামীণ ব্যাঙ্ক থেকে জোর করেই বার করে দিয়েছিল হাসিনার সরকার। এমনকি, বাংলাদেশের গর্বের পদ্মা সেতু নির্মাণ নিয়ে অন্তর্ঘাতের অভিযোগও তোলা হয় তাঁর বিরুদ্ধে।
এবার সেই ইউনুসই হতে চলেছে বাংলাদেশের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান। তবে এই প্রথম নয়। জানা যায়, ২০০৭ সালের জানুয়ারি মাসে বাংলাদেশে সামরিক বাহিনী ক্ষমতা দখল করে ইউনূসকে তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী করার প্রস্তাব দেয়। কিন্তু সেই সময় সেই প্রস্তাব অস্বীকার করেছিলেন ইউনূস। তবে এবারে প্রস্তাব মেনে নিলেন তিনি। তবে চলতি বছরের শুরুতে এক সাক্ষাৎকারে ইউনূস জানিয়েছিলেন, রাজনীতিতে তিনি খুব অস্বস্তি বোধ করেন।
এর আগে ২০০৭ সালে একটি রাজনৈতিক দল চালু করেছিলেন। কিন্তু মাস কয়েক যেতে না-যেতেই তিনি রাজনীতি থেকে দূরত্ব তৈরি করেন। প্রসঙ্গত, ইউনূসের সেই রাজনীতি করার কালে হাসিনা সামরিক বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন