লুলা দ্য সিলভার জন্ম হয় ১৯৪৫ সালে উত্তর পশ্চিম ব্রাজিলের এক অত দরিদ্র পরিবারে। প্রথাগত পড়াশোনা সম্পূর্ণ করার কোনও সুযোগ পাননি লুলা।
প্রবল অর্থকষ্ট তাঁকে বাধ্য করেছিল আট-নয় বছর বয়স থেকেই রাস্তায় রাস্তায় জিনিস ফেরি আর জুতো পালিশের কাজ করতে।
মেশিনিস্ট হিসেবে প্রশিক্ষণ নেওয়ার পর লুলা কাজ করতে শুরু করেন সাও পাওলোর গাড়ি কারখানায়। সেখানেই ১৭ বছর বয়সে এক দুর্ঘটনায় বাঁ হাতের একটা আঙুল খোয়া যায় লুলার।
যখন লুলার মাত্র আঠেরো বছর বয়েস, ব্রাজিলের দখল নেয় সেনাবাহিনী। ইতি পড়ে গণতান্ত্রিক স্বাধীনতায়। লুলা তখনও রাজনৈতিক ভাবে সচেতন নন। নিজের অস্তিত্বের লড়াই লড়তেই ব্যস্ত।
তাঁর এক ভাই, ব্রাজিলের কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য, তাঁকে প্রথম রাজনীতিতে নিয়ে আসেন। বোঝান, জীবন জীবিকার লড়াইয়ের সঙ্গে রাজনীতির কোনও বিরোধ নেই, বরং একটির সঙ্গে আরেকটি গভীর ভাবে সংযুক্ত। এভাবেই শ্রমিক ইউনিয়নের রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন লুলা।
একের পর এক পদে নিজের দায়িত্ব যোগ্যতার সঙ্গে পালন করে একজন অত্যন্ত বিশ্বাসযোগ্য শ্রমিক নেতা হিসেবে লুলা ৭০-এর দশকে আত্মপ্রকাশ করেন।
১৯৭৫ সালে মাত্র তিরিশ বছর বয়সে যে ইউনিয়নের কর্মী হিসেবে তিনি রাজনৈতিক জীবন শুরু করেছিলেন, তার প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন তিনি।
১৯৭৮ থেকে ১৯৮০-এর মধ্যে লড়াকু শ্রমিক নেতা হিসেবে লুলা ব্রাজিলের সামরিক শাসনের ভিত্তি কাঁপিয়ে দেন। তাঁর নেতৃত্বে একের পর এক ধর্মঘটের মাধ্যমে ব্রাজিলের শ্রমিক শ্রেণী বুঝিয়ে দেয় আর ফাঁকা মাঠে গোল হবে না।
১৯৮০ সালের এপ্রিল মাসে লুলাকে গ্রেপ্তার করা হয়। দেশের গণতন্ত্রের লড়াইয়ের রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে তিনি কারাবাস করেন।
মুক্তি পাওয়ার পরেই লুলা সিদ্ধান্ত নেন ব্রাজিলের শ্রমিক শ্রেণীর নিজের একটা দল প্রয়োজন। এই ভাবনার উপর ভিত্তি করেই আত্মপ্রকাশ করে ওয়ার্কাস পার্টি বা PT। রাজনীতিবিদ হিসেবেও লুলা লাভ করেন অসাধারণ সাফল্য।
১৯৮৬ সালে ব্রাজিলের কংগ্রেসে তিনি নির্বাচিত হয়েছিলেন দেশের মধ্যে সর্বাধিক ভোট প্রাপ্ত প্রার্থী হিসেবে।
সবটাই একটানা সাফল্য ছিল, এমনও নয়। তিন তিন বার প্রেসিডেন্ট পদের জন্য নির্বাচনে লড়েন লুলা। তিনবারই পরাজিত হন। প্রথমবার পরাজিত হয়ে এতো হতাশ হয়েছিলেন, যে ভেবেছিলেন রাজনীতিই ছেড়ে দেবেন।
ফিদেল কাস্ত্রো তাঁকে হাল না ছেড়ে লড়ে যাওয়ার উৎসাহ দেন। নতুন করে প্রস্তুতি নেন তিনি। না, পরের দুইবার পরাজয়ে হতাশা আর গ্রাস করেনি তাঁকে। ব্যর্থতার সোপানে পা রেখেই যে সাফল্যের শীর্ষে পৌছনো যায়, একথা লুলা কখনও ভোলেননি।
২০০২ সালের ২৭-শে নভেম্বর সাফল্যের সেই চুড়া স্পর্শ করেন লুলা। নির্বাচিত হন ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি হিসেবে।
প্রথম শ্রমিক শ্রেণী থেকে উঠে আসা রাষ্ট্রপতি হিসেবে লুলা আমূল পাল্টে দেন ব্রাজিলের মুখ। শিক্ষা থেকে স্বাস্থ্য সকল গুরুত্বপূর্ণ মানব উন্নয়ন সূচকের উপাদানেই তাঁর আমলে ব্রাজিলের দ্রুত উন্নতি হয়।
Bolsa Familia আর Fome Zero-এর মতো সরকারী কর্মসূচীর হাত ধরে লক্ষ লক্ষ মানুষ দারিদ্র্যের বেড়াজাল ছিন্ন করে বেরিয়ে আসেন।
উন্নয়ন ও প্রকৃতির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে সক্ষম হন লুলা। তাঁর আমলে আমাজনের অরণ্য ধ্বংসের হার পূর্বের তুলনায় বহুগুণ হ্রাস পায়।
এতকাল যে আদিবাসী সমাজ সরকারের তরফ থেকে বঞ্চনা লাভ করে এসেছে, লুলা সরকার তাঁদের নতুন সামাজিক সম্মান প্রদান করে।
ব্রাজিলের সর্বকালের জনপ্রিয়তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে (জনপ্রিয়তায় সম্ভবতঃ বিগত শতকের প্রেসিডেন্ট ভার্গাসের সঙ্গেই তাঁর তুলনা সম্ভব) লুলা দুই বার ক্ষমতায় থাকার পর রাজনীতি থেকে সরে আসেন ২০১১ সালে।
ব্রাজিলের রাষ্ট্রপতি হিসেবে নির্বাচিত হন তাঁর ঘনিষ্ঠ অনুগামী দিলমা রুসেফ।
কিন্তু লুলা রাজনীতি পরিত্যাগ করলেও রাজনীতি লুলাকে পরিত্যাগ করেনি। তাঁকে এত সহজে ছেড়ে দিতে ব্রাজিলের দক্ষিণপন্থী শ্রেণী রাজি ছিল না। লুলা যদি সফল হন তাহলে প্রমাণ হবে একজন শ্রমিক শ্রেণী থেকে উঠে আসা প্রথাগত শিক্ষাহীন মানুষও সাফল্যের সঙ্গে দেশ পরিচালনা করতে পারে।
২০১৪ সালে অপারেশ কারওয়াশ নামক এক রাজনৈতিক ভাবে প্রভাবিত তদন্তের মাধ্যমে লুলা সহ ওয়ার্কাস পার্টির বহু নেতার উপর দুর্নীতির অভিযোগ আনা হল।
বাছাই করা কর্পোরেশনের জন্য লুলা তদ্বির করেছেন, এই অভিযোগে লুলা সাড়ে নয় বছরের কারাদন্ডে দন্ডিত হলেন।
২০১৮ সালে নেতৃত্বের অভাবে যখন ওয়ার্কাস পার্টি দিশেহারা, তখনই সেই সুযোগ কে কাজে লাগিয়ে ক্ষমতায় আসেন অতি-দক্ষিণপন্থী জাইর বোলসোনারো। লুলাকে কারাদন্ড দিয়েছিলেন যে বিচারপতি, সেই সের্গেইও মোরোকে তিনি নিযুক্ত করেন ন্যায়মন্ত্রী হিসেবে।
সুপ্রিম কোর্টে লুলা নির্দোষ বিবেচিত হন। বিচারপতি মোরোর রাজনৈতিক পক্ষপাতিত্বের বিষয়টিও সামনে আসে। ২০২২-এর নির্বাচনে বোলসোনারোকে পরাজিত করার প্রতিজ্ঞা করেন লুলা।
অবশেষে গত ৩১-শে অক্টোবর ভোট গণনা শেষ হলে দেখা যায় ৫০.৯% ভোট পেয়ে পুনরায় রাষ্ট্রপতি পদে নির্বাচিত হয়ে ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন তিনি। ব্রাজিলের শাসনভার ফিরে গেছে আবার শ্রমিক শ্রেণীর হাতে।
বোলসোনারো এবং তাঁর বিভাজনের, ঘৃণার রাজনীতি পরাজিত হয়েছে। ৭৭ বছরের লুলা প্রমাণ করেছেন, এভাবেও ফিরে আসা যায়।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন
