দ্রুত বদলাচ্ছে যুগ। প্রতিদিনের ব্যস্ততা গ্রাস করছে চাহিদাকে। সময় বাঁচানোর তাগিদে ডিজিটালাইজেশনের দিকে ঝুঁকেছে একবিংশ শতাব্দীর পৃথিবী। আর তার ফলে সবচেয়ে বেশি মার খেয়েছে মুদ্রণ সাংবাদিকতা। যার মারণকোপ থেকে ছাড় পেল না বিজ্ঞান ও পরিবেশ বিষয়ক জনপ্রিয় মাসিক পত্রিকা ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক ম্যাগাজিন’ও।
বুধবার শতাব্দী প্রাচীন এই পত্রিকা তাদের শেষ ১৯ জন নিজস্ব লেখককেও বরখাস্তের নোটিশ ধরিয়ে দিল। মার্কিন মুলুকের ওয়াশিংটন-ভিত্তিক এই পত্রিকা প্রথমবার কর্মী ছাঁটাইয়ের পথে হেঁটেছিল ২০১৫ সালে। তারপর থেকে এই নিয়ে মোট ৪ বার তারা কর্মচারীদের বরখাস্ত করেছে। ইতিমধ্যেই এই ম্যাগাজিনের কয়েক হাজার কর্মী চাকরি হারিয়েছেন।
১৮৮৮ সালে নিজেদের প্রথম সংখ্যা প্রকাশ করেছিল ‘ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক’ পত্রিকা। তারপর থেকে ১৩৫ বছর ধরে গোটা বিশ্বের মানুষের কাছে তারা বিজ্ঞান ও পরিবেশ নিয়ে সবচেয়ে উৎকৃষ্টমানের বক্তব্য পৌঁছে দিয়ে মানুষের অদম্য কৌতূহল নিবারণ করছে। তাদের উজ্জ্বল হলুদ রঙের বর্ডার বিশিষ্ট প্রচ্ছদ সংশ্লিষ্ট ম্যাগাজিন জগতে কার্যত আইকনিকের পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। বর্তমানে বিশ্ব জুড়ে এই জনপ্রিয় পত্রিকার গ্রাহক সংখ্যা প্রায় ১৭ লক্ষ। কিন্তু এতকিছুর পরেও ডিজিটালাইজেশনের আক্রমণ থেকে ছাড় পেল না পত্রিকাটি।
মার্কিন সংবাদপত্র ওয়াশিংটন পোস্ট-এ প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত কয়েকবছর ধরেই ওয়াল্ট ডিজনির মালিকানাধীন পত্রিকাটি আর্থিক মন্দার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিল। তাছাড়াও এই ইন্টারনেট ও ডিজিটালাইজেশনের যুগে একটি মুদ্রণ পত্রিকা হিসেবে অস্তিত্ব রক্ষার লড়াই তো ছিলই। অবশেষে খরচ কমানোর বাহানায় একসঙ্গে শেষ ১৯ জন লেখককর্মীকেও তাদের চাকরি থেকে বরখাস্ত করল পত্রিকা কর্তৃপক্ষ, যার মধ্যে বেশ কয়েকজন উচ্চপদস্থ লেখক রয়েছেন। বরখাস্ত হওয়া কর্মচারীরা জানিয়েছেন গত এপ্রিল মাসেই এই নিয়ে কর্তৃপক্ষের তরফে তাদের খানিক আভাস দেওয়া হয়েছিল।
চাকরি হারানো লেখকরা বুধবার আরও জানিয়েছেন, যেসব চিত্রগ্রাহকরা পত্রিকায় প্রকাশিত চোখ ঝলসানো ছবি তোলার জন্য মাসের পর মাস মাঠেঘাটে ছুটে বেড়ান তাদের সঙ্গেও চুক্তি শেষ করেছে কর্তৃপক্ষ। ওয়াশিংটন পোস্টে প্রকাশিত খবর থেকে আরও জানা গিয়েছে, খরচ কমানোর লক্ষ্যে লেখক ছাঁটাইয়ের পাশাপাশি পত্রিকাটির ছোট্ট অডিও বিভাগটিকেও বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এছাড়াও, আগামী বছর থেকে আরও খরচ কমানোর জন্য আমেরিকার নিউজস্ট্যান্ডে পত্রিকার সংখ্যা বিক্রিও বন্ধ করে দেওয়া হবে বলেও খবর।
যে ১৯ জন লেখককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে তারা অনেকেই তাদের অভিজ্ঞতা সমাজমাধ্যমে ভাগ করে নিয়েছেন। যেমন পত্রিকার বর্ষীয়ান লেখক ক্রেগ ওয়েলচ নিজের টুইটারে লিখেছেন, “সদ্য প্রকাশিত ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকায় একজন সিনিয়র লেখক হিসেবে আমার ১৬তম তথা শেষ লেখা প্রকাশ পেয়েছে। ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার কর্তৃপক্ষ তাদের সমস্ত নিজস্ব লেখককে চাকরি থেকে বরখাস্ত করেছে। আমি সত্যিই ভাগ্যবান যে এতদিন ধরে এত অসাধারণ সব সাংবাদিকদের সঙ্গে কাজ করতে পেরেছি এবং বিশ্বের কিছু গুরুত্বপূর্ণ গল্প বলতে পেরেছি। এটা সত্যিই অনেক সম্মানের ব্যাপার।”
কিন্তু এরপর কী? শতাব্দী প্রাচীন একটি পত্রিকা লেখকহীন অবস্থায় কীভাবে চলবে? তবে কি জনপ্রিয় এই পত্রিকার ১৩৫ বছরের উজ্জ্বল যাত্রাপথ এবার শেষের মুখে? পত্রিকার কর্তৃপক্ষের তরফে কী জানানো হয়েছে? ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক পত্রিকার মুখপাত্র ক্রিস অ্যালবার্ট জানিয়েছেন, “এই লেখক ছাঁটাই আমাদের কাজে আরও নমনীয়তা আনবে। আমরা আরও ভালো ভালো কাহিনী আমাদের গ্রাহকদের কাছে পৌঁছে দিতে পারব। এই ঘটনায় আমাদের পত্রিকার প্রকাশে কোনও প্রভাব পড়বে না।” কিন্তু সেই কাহিনী লিখবে কারা? পত্রিকা সূত্রে খবর, এবার থেকে হয় অস্থায়ী চুক্তিভিত্তিক লেখক অর্থাৎ ফ্রিলান্সারদের সঙ্গে কাজ করবে কর্তৃপক্ষ কিংবা সম্পাদকীয় লেখকদের একত্র করা হবে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন