ডোনাল্ড ট্রাম্প যদি দ্বিতীয় বারের জন্য আমেরিকার প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসে ফিরে আসেন - তার প্রভাব শুধু আমেরিকাতে পড়বে না, পড়বে সারা বিশ্বে। আমেরিকার অভ্যন্তরে অভিবাসন নীতি, পরিবেশ, বন্দুক আইন থেকে LGBTQ+ অধিকার - ট্রাম্প আমেরিকার মূলধারার প্রতিটি ইস্যুকেই নিশানা বানিয়েছেন।
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা এবং আদালত ব্যবস্থাকে ট্রাম্প ‘অভ্যন্তরীণ শত্রু’ হিসাবে চিহ্নিত করেছেন। আমেরিকার একটা বড় অংশের মানুষ বিশ্বাস করতে শুরু করেছেন, ট্রাম্প দ্বিতীয় প্রেসিডেন্ট হতে পারলে বিরোধীদের দমন করতে আদালত ও সংবাদমাধ্যমের অপপ্রয়োগ করতে পারেন।
রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্প? নাকি ডেমোক্র্যাট কমলা হ্যারিস? আমেরিকার পরবর্তী প্রেসিডেন্ট কে হচ্ছেন সেই দিকে তাকিয়ে রয়েছে সারা বিশ্ব। তবে ট্রাম্প জিতলে কী কী পরিবর্তন হতে পারে আমেরিকার রাজনীতিতে?
সংবাদপত্রের স্বাধীনতা –
ট্রাম্প তাঁর প্রেসিডেন্ট হিসাবে প্রথম মেয়াদে ধারাবাহিকভাবে মূলধারার সংবাদমাধ্যমকে আক্রমণ করেছেন। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে বরাবর উগ্র-দক্ষিণপন্থী রক্ষণশীল মিডিয়া ব্যবহার করেছেন। একাধিকবার মানহানিকর আইন দুর্বল করার হুমকি দিয়েছেন এবং সংবাদমাধ্যমকে ‘ভুয়া খবর’ এবং ‘জনগণের শত্রু’ বলে অভিহিত করেছেন। পুনঃনির্বাচিত হলে ট্রাম্প সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে আগ্রাসন যে কমিয়ে দেবেন এমন কোন সম্ভাবনা নেই। সম্প্রতি, তিনি আমেরিকার জনপ্রিয় CBS News-র সম্প্রচার লাইসেন্স বাতিল করার হুমকি দিয়েছেন।
বন্দুক আইন –
রাষ্ট্রপতি হিসাবে, জো বিডেন প্রায় তিন দশকের মধ্যে প্রথম ‘বন্দুক-নিরাপত্তা আইন’ পাস করেছিলেন। এখন আইনজীবীরা আশঙ্কা করছেন যে রিপাবলিকানরা এই নির্বাচনে জিতলে সেই নীতিগুলি সহজেই পাল্টে ফেলবেন।
২০২৩ সালে বন্দুক সহিংসতা প্রতিরোধের জন্য হোয়াইট হাউসে একটি অফিস তৈরি করা হয়েছিল, যার তত্ত্বাবধানে ছিলেন বর্তমান ডেমোক্র্যাট প্রেসিডেন্ট পদপার্থী কমলা হ্যারিস। তবে ট্রাম্প জিতলে এই অফিসও যে বন্ধ হতে চলেছে তা একপ্রকার নিশ্চিত। শুধু তাই নয় – আইনজীবীরা আশঙ্কা করছেন – ট্রাম্প একজন বন্দুক শিল্প-বান্ধব নেতাকে ব্যুরো অফ অ্যালকোহল, তামাক, আগ্নেয়াস্ত্রের পরিচালক হিসাবে মনোনীত করবেন। যিনি জো বিডেনের ‘বন্দুক-নিরাপত্তা আইন’ কার্যকরী করবেন না।
গর্ভপাতের অধিকার –
ট্রাম্প জয়ী হলে, গর্ভপাতের উপর ফেডারেল বিধিনিষেধ জারি হতে পারে। যদিও জাতীয় নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থান সম্পূর্ণরূপে পরিষ্কার নয়। প্রজেক্ট ২০২৫, নামক এক দক্ষিণপন্থী ম্যাগাজিনে ‘১৮৭৩ কমস্টক অ্যাক্ট’ ব্যবহার করার প্রস্তাব করেছে। যে আইনে গর্ভপাতের বড়িকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। উল্লেখ্য, গর্ভ নিয়ন্ত্রক বড়ির মাধ্যমেই আমেরিকায় প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ গর্ভপাত হয়ে থাকে।
‘ইমার্জেন্সি মেডিকেল ট্রিটমেন্ট অ্যান্ড লেবার অ্যাক্ট’ (এমটালা), একটি ফেডারেল আইন যার মাধ্যমে জরুরী অবস্থার ভিত্তিতে গর্ভপাত করা যায়। আমেরিকার একটা বড় অংশের মহিলারা মনে করছেন ট্রাম্প ক্ষমতায় এলে এই আইনকে দুর্বল করতে পারেন।
শহরে সেনার দখল?
ট্রাম্প ইতিমধ্যেই হুমকি দিয়ে রেখেছেন – ডেমোক্র্যাট পরিচালিত শহরে আইন-শৃঙ্খলার অবনতি হলে সেনা পাঠিয়ে শহরের দখল নেবেন। শুধু তাই নয় বিভিন্ন শহরে প্রতিবাদ আন্দোলনে রাশ টানতে, বিশেষ করে ‘বামপন্থী’দের নিয়ন্ত্রণ করতে তিনি সেনা নামাতে দ্বিধাবোধ করবেন না। সেক্ষেত্রে তিনি সেই শহরের মেয়র কিংবা গভর্নরদের সিদ্ধান্তের অপেক্ষায় বসে থাকবেন না। ট্রাম্পের এই নীতি রীতিমতো আমেরিকার যুক্তরাষ্ট্রীয় পরিকাঠামোর পরিপন্থী বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
অভিবাসন নীতি –
ট্রাম্প বরাবর অভিবাসীদের আমেরিকা থেকে বহিষ্কারের পক্ষে। এবারের নির্বাচনী প্রচারে তিনি ধারাবাহিকভাবে ‘আমেরিকান ইতিহাসে সবচেয়ে বড় নির্বাসন অভিযান’ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বারবার স্লোগান দিয়েছেন – “এখন গণ নির্বাসন!”। ট্রাম্প সম্ভবত ২০ মিলিয়ন অভিবাসীকে আমেরিকা থেকে বহিষ্কার করার তার পরিকল্পনা করেছেন। অন্যদিকে অভিবাসন সংক্রান্ত আইজীবীরা বলছেন – যদি ট্রাম্প দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসেন, তাঁরা আরও সংগঠিতভাবে আইনি লড়াই করার জন্য প্রস্তুতি নেবেন।
LGBTQ+ অধিকার –
ট্রাম্প তার প্রথম মেয়াদে সেনাবাহিনী থেকে ট্রান্স লোকদের নিষিদ্ধ করেছিলেন। পুনরায় নির্বাচিত হলে, তিনি LGBTQ+ অধিকারের উপর আরও আক্রমণাত্মক আক্রমণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। ট্রাম্প সমস্ত ফেডারেল এজেন্সিগুলিকে ‘যে কোনও বয়সে লিঙ্গ পরিবর্তনের প্রচার’ বন্ধ করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এই সংক্রান্ত হাসপাতালগুলির তহবিল কাটছাঁট করতে চান তিনি। শুধু তাই নয়, ট্রান্স ব্যক্তিদের আইনি স্বীকৃতি বাতিলের জন্য ফেডারেল স্টেটগুলোকে তিনি চাপ সৃষ্টি করবেন বলেও জানিয়েছেন। LGBTQ+ বৈষম্যহীন নীতিও বাতিল করতে চান তিনি।
আইনি বিশেষজ্ঞরা বলছেন - ট্রাম্পের অধীনে বিবাহের সমতা, সমলিঙ্গের বিবাহ, ট্রান্সদের অধিকার আরও হুমকির সম্মুখীন হতে পারে। বিশেষ করে যদি তাঁর অতিরিক্ত বিচারপতি নিয়োগের সুযোগ থাকে।
প্রতিবাদ আন্দোলনের অধিকার –
২০২০ সালে কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডের মৃত্যুর পর আমেরিকার বিভিন্ন শহর প্রতিবাদে উত্তাল হয়ে ওঠে। কোনও কোনও জায়গায় সেই প্রতিবাদ হিংসাত্মক হয়ে ওঠে। সেই সময় থেকেই রিপাবলিকান-নেতৃত্বাধীন রাজ্যগুলিতে ‘বিক্ষোভ-বিরোধী আইন’ লাগু হয়। ট্রাম্প নিজের প্রচারে প্রতিবাদ দমন করা এবং ‘আইন-শৃঙ্খলা’ ভেঙ্গে পড়ার অজুহাতে সেনাবাহিনী নামানোর মতো প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এদিকে, ট্রাম্প ঘনিষ্ঠ হাউস স্পিকার মাইক জনসন, গাজায় ইজরায়েলের আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদকারী ছাত্রদের বিরুদ্ধে সেনাবাহিনী প্রয়োগ করার প্রস্তাব দিয়েছেন।
ট্রাম্প দ্বিতীয় বারের জন্য প্রেসিডেন্ট হলে - সমস্ত নাগরিক আন্দোলন ও প্রতিবাদের উপর সেনাবাহিনী প্রয়োগ যে করবেন তা একপ্রকার নিশ্চিত। শুধু তাই নয় – নির্বাচিত হওয়া রিপাবলিকানদেরকে বাধ্য করবেন এমন একটি আইন আনতে, যেখানে প্রতিবাদীদের থেকে ক্ষতিপূরণ আদায় করা যায়। ইতিমধ্যে রিপাবলিকান পরিচালিত রাজ্য টেনেসিতে এইরকম একটি আইন পাস করা হয়েছে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন