২০১৬ বিধানসভা নির্বাচনে বিজেপি জিতে ছিল মাত্র তিনটি আসনে। ২০১৪ সালে বিজেপি কেন্দ্রের ক্ষমতায় আসার পর পশ্চিমবঙ্গে সেটাই ছিল প্রথম নির্বাচন। সুতরাং গেরুয়া শিবির খুব একটা আশা করেনি। কিন্তু ২০১৯- এর লোকসভা নির্বাচনে রাজ্যে গেরুয়া ঝড় ভালোই দাপট দেখিয়েছিল। ৪২টি আসনের মধ্যে ১৮টিই নিজেদের পকেটস্থ করে পদ্ম শিবির। রাজ্যের তৃণমূলের বিরোধী দল হিসেবে নিজেদের বিস্তার করে বিজেপি। ২০২১-এর বিধানসভা নির্বাচনে তাই সবাই মনে করেছিল তৃণমূলের সঙ্গে মার্জিন কমিয়ে দেবে গেরুয়া শিবির।
ভোট পর্বে লাগাতার প্রচার চালিয়েছে বিজেপি। কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব এসেছে ঘনঘন। এমনকী নরেন্দ্র মোদি এবং অমিত শাহ রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ বিধানসভা কেন্দ্রগুলিতে প্রচার চালিয়েছেন, সভা করেছেন। দু'শোর বেশি আসনে জয়ী হবেন বলে আশা করলেও ফল অন্যরকম দাঁড়িয়েছে। মাত্র ৭৭টি আসন নিয়েই সন্তুষ্ট থাকতে হয়েছে তাদের। যদিও রাজ্য নেতৃত্বের সাফাই, তিন থেকে ৭৭টি আসনে পৌঁছনো যথেষ্ট কৃতিত্বের। কিন্তু নিচুতলার কর্মীরা এসব সাফাইতে ভুলছেন না। উপরন্তু যেখানে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তাকে কাজে লাগিয়ে বিজেপি ক্ষমতায় আসার চেষ্টা করছিল, সেই ভাবমূর্তি কতটা বজায় থাকে, তা নিয়ে সংশয় তৈরি রয়েছে দলের অন্দরেই।
শুধু তো পশ্চিমবঙ্গ নয়, পাঁচ রাজ্যের বিধানসভা নির্বাচনে অসম ছাড়া কোথাও আশানুরূপ ফল হয়নি বিজেপির। যোগী আদিত্যনাথের উত্তরপ্রদেশে পঞ্চায়েত নির্বাচনে ধস নেমেছে। এই ধসের পিছনে নানা কারণ উঠে এসেছে। প্রথমত, লাগাতার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি তো আছেই। পাশাপাশি আছে পেট্রোলের মূল্যবৃদ্ধি। গত বছরের শেষ থেকে এই বছরের শুরু পর্যন্ত যখন করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, তখন কেন্দ্রীয় সরকারে গা-ছাড়া মনোভাবের দিকে আঙ্গুল উঠেছে।
গত বছরের শেষ থেকে চলতি বছরের শুরুর দিক পর্যন্ত যখন করোনা পরিস্থিতি অনেকটাই নিয়ন্ত্রণে, বিশেষজ্ঞরা তখনই দ্বিতীয় ঢেউয়ের সম্পর্কে সতর্ক করেছিলেন। কিন্তু তাতে কান দেয়নি কেন্দ্র। এই ঢেউ মোকাবিলার জন্য প্রয়োজনীয় পরিকাঠামো তৈরিতে দুরস্ত, প্ল্যান বি হিসেবে কোনও কিছু ভেবে রাখেনি। ফলে দিকে দিকে শুধু বেড়েছে অক্সিজেনের অভাব, হাসপাতালে বেড না থাকা, টিকার অভাব নিয়ে হাহাকার এবং সাধারণ মানুষের আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুর সংখ্যা। এসবের যে নরেন্দ্র মোদীর জনপ্রিয়তা কমছে, তা এক বাক্যে স্বীকার করে নিয়েছেন বিজেপির শীর্ষস্তরের নেতারাও।
পশ্চিমবঙ্গের বিজেপি নেতারা মনে করছেন, রাজ্যের নির্বাচনে শেষ দু’তিন দফার ভোটে কোভিড মোকাবিলায় কেন্দ্রের ব্যর্থতার খেসারত দিতে হয়েছে। তাঁদের প্রশ্ন, এরপরেও হাল শোধরাতে মোদী-অমিত শাহের দিক থেকে কোনও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না কেন? মেডিক্যাল জার্নাল ‘দ্য ল্যানসেট’-এর সম্পাদকীয়তে বলা হয়েছে, নরেন্দ্র মোদীর সরকারই দেশে জাতীয় বিপর্যয় ডেকে আনার জন্য দায়ী থাকবে। মোদী সরকার কোভিডের মোকাবিলার থেকে টুইটারের সমালোচনা মুছতে বেশি ব্যস্ত বলে মনে হচ্ছে, যা ক্ষমার অযোগ্য।
কারণ বিপদ-বার্তা সত্ত্বেও মোদী সরকার দেশের লক্ষ লক্ষ মানুষকে জড়ো করে ধর্মীয় উৎসব, বড় বড় রাজনৈতিক সভা হতে দিয়েছে। অথচ প্রথম দফা করোনা পরিস্থিতি মোকাবিলার পর গোটা বিশ্বজুড়ে মোদীর জয়গান শুরু করেছিল বিভিন্ন সংবাদমাধ্যম। এখন মোদি সরকারের দায়িত্বজ্ঞানহীনতার দিকে আঙুল বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলার ব্যর্থতার জন্য দায়ী করেছে। স্বাস্থ্যমন্ত্রী হর্ষবর্ধন বলেছিলেন, কোভিডের খেলা শেষ হবে। বিজেপির কিছু নেতা আবার এতে হর্ষবর্ধনের দোষ দেখতে নারাজ। তাঁদের যুক্তি, প্রধানমন্ত্রী নিজেই তো তার আগে দাভোসের ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনে কোভিডের বিরুদ্ধে যুদ্ধজয় ঘোষণা করেছিলেন।
দলের নেতারা কি ভাবছেন, মানুষ ২০২৪-এর আগে এই অক্সিজেন, আইসিইউ বেডের জন্য হাহাকার, টিকার অভাবের কথা ভুলে যাবে?' বিরোধী নেতারা বলছেন, বিজেপি হয়তো কোভিডের ব্যর্থতা ভোলাতে ২০২৪-এর আগে ফের মন্দির-মসজিদ, হিন্দু-মুসলিম, পাকিস্তান-জাতীয়তাবাদের ইস্যু তুলে আনতে চাইবে। কিন্তু বারবার একই হাতিয়ারে কাজ দেবে না।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন