৩ অক্টোবর, মঙ্গলবার সকালে অনলাইন নিউজ পোর্টাল নিউজক্লিকের একাধিক সাংবাদিককের বাড়িতে হানা দেয় দিল্লি পুলিশের বিশেষ শাখা। পুরুষ সাংবাদিকদের থানায় তুলে নিয়ে গিয়ে এবং মহিলা সাংবাদিকদের বাড়িতেই জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়। নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা গেছে, সমস্ত সাংবাদিকের কাছেই পুলিশ জানতে চেয়েছে – ২০২০ সালে দিল্লি দাঙ্গা, কোভিডকালে দেশের চিকিৎসাব্যবস্থা এবং পরিযায়ী শ্রমিক ও নিম্নবিত্তদের দুরবস্থা, তিন কালা আইন নিয়ে মোদী সরকারের বিরুদ্ধে কৃষকদের আন্দোলন নিয়ে কোনও প্রতিবেদন লিখেছেন কিনা তাঁরা। বিরোধী দলগুলো প্রসঙ্গে তাঁদের মতামত কী, তাও জানতে চাওয়া হয়েছে।
দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর নিউজক্লিকের প্রতিষ্ঠাতা এবং এডিটর প্রবীর পুরকায়স্থকে গ্রেফতার করেছে দিল্লি পুলিশ। গ্রেফতার করা হয়েছে সংস্থার প্রশাসনিক কর্তা অমিত চক্রবর্তীকে, যিনি শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী। যাঁদের ৭ দিনের পুলিশি হেফাজতের নির্দেশ দিয়েছে নিম্ন আদালত। এছাড়াও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে নিউজক্লিক সাংবাদিক সুবোধ ভার্মা এবং অদিতি নিগম, ভিডিও সাংবাদিক অভিসার শর্মা, সিনিয়র সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহ ঠাকুরতা, ফ্রিল্যান্সার ভাষা সিং এবং বিশিষ্ট সাংবাদিক উর্মিলেশকে। এঁদের প্রত্যেকের সমস্ত ইলেক্ট্রনিক্স ডিভাইস বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। যদিও এর জন্য কোনও হ্যাশ ভ্যালু দেয়নি পুলিশ। কারও কারও পাসবুক ও পাসপোর্টও বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে। (হ্যাশ ভ্যালু হল কোনও ডিভাইস বাজেয়াপ্ত করার সময় কতটা ডেটা আছে তার বিশদ বিবরণ, যাতে কোনও সম্ভাব্য ট্যাম্পারিং এড়ানো যায়।)
সাংবাদিক পরঞ্জয় গুহঠাকুরতা, যাঁকে সকাল ৮টায় তাঁর বাড়ি থেকে তুলে বিশেষ শাখার সদর দপ্তরে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল। দীর্ঘ জিজ্ঞাসাবাদের পর সন্ধ্যা ৬টা নাগাদ তিনি ছাড়া পান। তিনি দপ্তর থেকে বেরিয়ে সাংবাদিকদের মুখোমুখি হয়ে জানিয়েছেন, “আমাকে অফিসাররা জিজ্ঞাসা করেন আমি দিল্লির দাঙ্গা কভার করেছিলাম কিনা। আমি না বলেছি। তারপর তারা আমাকে জিজ্ঞেস করেন কৃষকদের বিক্ষোভের বিষয়ে আমি প্রতিবেদন করেছি কিনা। আমি বললাম হ্যাঁ। এরপর তা নিয়েই আমাকে বিভিন্ন প্রশ্ন করছিলেন তারা।“
আদানি গ্রুপের লেনদেন এবং ক্রনি পুঁজিবাদের বিষয়ে অনুসন্ধানী প্রতিবেদনের জন্য পরিচিত গুহ ঠাকুরতা আরও জানিয়েছেন, তাঁকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল তিনি সিগন্যাল অ্যাপ ব্যবহার করেন কিনা। আমেরিকার একটি নম্বরে তিনি ফোন করেন মাঝেমাঝে সেটি কার নম্বর? তিনি জানিয়েছেন এটি তাঁর স্ত্রীর ভাইয়ের নম্বর।
নিউজক্লিকের জন্য ফ্রিল্যান্সিং করা এক সিনিয়র সাংবাদিক দ্য ওয়্যারকে (The Wire) জানিয়েছেন, “দিল্লি পুলিশের ছয় সদস্যের একটি দল সকালে একটি নোটিস নিয়ে আমার বাড়িতে আসে, যেখানে UAPA-র ধারাগুলোর উল্লেখ ছিল। তাদের কাছে ইতিমধ্যেই আমার সমস্ত তথ্য ছিল – আমার ফোন নম্বর, আমার ঠিকানা, আমার অনলাইন কার্যকলাপ। নিউজক্লিকের বিষয়ে আমি কতটা জানি সেই নিয়ে ক্রমাগত প্রশ্ন করছিলেন তারা। দিল্লি দাঙ্গা, কৃষকদের বিক্ষোভ এবং কোভিড-১৯ মহামারী সম্পর্কে আমার প্রতিবেদন নিয়ে একাধিক প্রশ্ন করেন তারা। আমি এখনও জানি না আমার বিরুদ্ধে কী অভিযোগ। আমি কোনো এফআইআর পাইনি। কিন্তু ওরা আমার ফোন ও ল্যাপটপ কেড়ে নিয়েছে। দু ঘণ্টা ধরে আমার বাড়িতে তল্লাশি চালিয়েছে।“
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক নিউজক্লিকের এক অল্পবয়সী মহিলা সাংবাদিক জানিয়েছেন, দিল্লি পুলিশ তাঁর কাছে জানতে চেয়েছে এখানে প্রতিবেদন লিখে কত টাকা পান তিনি। কৃষকদের প্রতিবাদ এবং দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে খবর করার জন্য তাঁকে অতিরিক্ত টাকা দেওয়া হতো কিনা। কেন কেন্দ্র সরকার বিরোধী খবর লেখেন তিনি, তা নিয়েও প্রশ্ন করা হয়।
নিউজক্লিকের আর এক সাংবাদিক কর্মী জানিয়েছেন, “দিল্লি দাঙ্গা নিয়ে কিছু লিখেছি কিনা আমাকে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল। আমি না বললে, তারা ধমক দিয়ে ফের একই প্রশ্ন করেন। আমি ফেসবুকে এই নিয়ে কিছু পোস্ট করেছি কিনা তা দেখতে বলেন। বর্তমান সরকার সম্পর্কে আমার মতামত কী, তা জানতে চাওয়া হয়। অরবিন্দ কেজরিওয়ালকে আমার ভাল লাগে কিনা, কংগ্রেস সম্পর্কে আমার দৃষ্টিভঙ্গি কী, এই ধরণের প্রশ্ন করা হয়েছিল।“
মঙ্গলবার সকালে নিউজক্লিকের বেশ কয়েকজন প্রাক্তন কর্মচারীর বাড়িতেও তল্লাশি চালানো হয়েছে। এক প্রাক্তন সাংবাদিক অনলাইন নিউজ পোর্টাল Newslaundry-কে জানিয়েছেন, "আমাকে একটি সার্চ ওয়ারেন্ট দেখিয়েছে পুলিশ, যেখানে আমার নাম উল্লেখ ছিল না, তবে UAPA-র ধারাগুলোর উল্লেখ ছিল। তারা আমার সমস্ত শিক্ষাগত নথি চেক করেছে এবং পরে আমার ল্যাপটপ, ফোন, পাসবুক এবং সম্পত্তি সম্পর্কিত নথিপত্র বাজেয়াপ্ত করেছে।"
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন