(মূল কপিটি পুনঃপ্রকাশিত। গত বছর ২ জুন করমন্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর সিএজি-র অডিট রিপোর্ট নিয়ে এই প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল। এর সাথে সম্প্রতি হওয়া কয়েকটি দুর্ঘটনার তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে।)
২০২২ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সংসদে একটি অডিট রিপোর্ট পেশ করেছিল কম্পট্রোলার অ্যান্ড অডিটর জেনারেল বা ক্যাগ (CAG), যেখানে রেলের নিরাপত্তা নিয়ে বেশ কিছু গুরুতর ত্রুটির উল্লেখ ছিল। করমন্ডল এক্সপ্রেস দুর্ঘটনার পর আলোচনায় উঠে আসছে এই অডিট রিপোর্ট। সমালোচকদের মতে, রেল যদি এই রিপোর্টকে গুরুত্ব দিত তাহলে হয়তো এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা এড়ানো যেত।
২০২৩ সালে ২ জুন ওড়িশার বালাশোরে ভয়াবহ দুর্ঘটনার সম্মুখীন হয় করমন্ডল এক্সপ্রেস সহ মোট তিনটি ট্রেন। যার ফলে কমপক্ষে ২৯৬ জনের মৃত্যু হয়েছে এবং হাজার জনের বেশি আহত হয়েছেন। সিগন্যাল এবং পয়েন্ট বিভ্রাটের জন্যই গত কয়েক দশকের অন্যতম এই মর্মান্তিক দুর্ঘটনাটি ঘটেছিল। সোমবার ফাঁসিদেওয়ায় কাঞ্চনজঙ্ঘা এক্সপ্রেস দুর্ঘটনা সেই স্মৃতি উসকে দিয়েছে। সরকারি তথ্য অনুযায়ী এখনও পর্যন্ত ১০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত হয়েছেন প্রায় ৬০ জন। এর আগে গত ১২ অক্টোবর বিহারের বক্সারে দুর্ঘটনার কবলে পড়ে দিল্লি-কামাখ্যা নর্থ ইস্ট এক্সপ্রেস। কমপক্ষে ৫ জনের মৃত্যু হয় এবং আহত হন প্রায় ৭০ জন। ৩০ অক্টোবর অন্ধ্রপ্রদেশের বিজয়ানগরমে সিগন্যাল না পাওয়ার কারণে দাঁড়িয়ে থাকা একটি প্যাসেঞ্জার ট্রেনকে ধাক্কা মারে ভাইজাগ-রায়গড় প্যাসেঞ্জার ট্রেন। কমপক্ষে ১৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল সেই ঘটনায়।
২০২২ সালে সংসদে জমা দেওয়া রিপোর্টে ট্রেনের লাইনচ্যুত এবং সংঘর্ষ প্রতিরোধ করতে রেল মন্ত্রক কী কী ব্যবস্থা নিয়েছে তা খুঁজে বের করার চেষ্টা করেছে ক্যাগ। রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০২১ সালের মার্চের মধ্যে মোট ১,১২৭ টি লাইনচ্যুতের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ‘ইঞ্জিনিয়ারিং ডিপার্টমেন্ট’-এর গাফিলতির জন্য ৪২২টি ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে আবার সবথেকে বেশি দুর্ঘটনা (১৭১ টি) ঘটেছে ট্র্যাকের রক্ষণাবেক্ষণের অভাবের জন্য।
'অপারেটিং ডিপার্টমেন্ট'-এর গাফিলতির জন্য ২৭৫ টি দুর্ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ৮৪ শতাংশ হয়েছে পয়েন্টের ভুল সেটিংয়ের জন্য।
৬৩ শতাংশ ক্ষেত্রে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে রেল বেলাইন হওয়ার রিপোর্টই জমা পড়েনি এবং ৪৯ শতাংশ ক্ষেত্রে কর্তৃপক্ষের দ্বারা রিপোর্ট গ্রহণে বিলম্ব হয়েছে।
মোট ৩৫০ জায়গায় তদন্ত হওয়ার দরকার থাকলেও তা হয়েছে মাত্র ১৬৯ জায়গায়। ১৮১টি ক্ষেত্রে কোনও তদন্ত রিপোর্টই জমা পড়েনি।
CAG জানিয়েছে, রেলওয়ে ট্র্যাকের কাঠামোগত অবস্থার মূল্যায়ন করার জন্য প্রয়োজনীয় টিসিএস (Track Recording Cars)-এর ৩০ থেকে ১০০ শতাংশ ঘাটতি রয়েছে। ট্র্যাক রক্ষণাবেক্ষণ কাজের অনলাইন পরীক্ষার জন্য ওয়েব-ভিত্তিক অ্যাপ্লিকেশন - ট্র্যাক ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম পোর্টালের অন্তর্নির্মিত মনিটরিং প্রক্রিয়াও কার্যকর হয়নি।
রিপোর্টে বলা হয়েছে, ২০১৭-১৮ অর্থবর্ষ থেকে ১ লক্ষ কোটি টাকার ‘রাষ্ট্রীয় রেল সুরক্ষা কোষ’ গঠিত হয়। কিন্তু এই টাকা দিয়ে কোনও গুরুত্বপূর্ণ খরচ করা হয়নি। উল্টে ট্র্যাক পুনর্নবীকরণের জন্য বরাদ্দ হ্রাস পেয়েছে। আবার বরাদ্দকৃত টাকাও পুরোপুরি ব্যবহার করা হয়নি। এমনকি নিরাপত্তা-সম্পর্কিত কাজগুলিও স্থগিত রাখা হয়েছিল। পরিবর্তে ‘নন প্রায়োরিটি টাস্কে’ খরচ করার প্রবণতা বেড়েছিল।
রিপোর্টের শেষের দিকে সিএজি জানিয়েছে, নিরাপত্তা বিভাগে পর্যাপ্ত কর্মী নেই। বর্তমান কর্মীদের জন্যও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি, যা রক্ষণাবেক্ষণের গুণমানকে প্রভাবিত করতে পারে।
বিশেষজ্ঞদের অনুমান, ক্যাগের এই রিপোর্টকে গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করেনি রেল মন্ত্রক, যার পরিণাম আজকের এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন