পশ্চিমবঙ্গের ত্রিস্তর পঞ্চায়েত নির্বাচনে বল্গাহীন সন্ত্রাস ও মৃত্যু মিছিলের প্রতিবাদে কলকাতার মহাবোধি সোসাইটি হলে অনুষ্ঠিত হল এক নাগরিক কনভেনশন। গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষা সমিতির আহবানে ২০ জুলাই-এর এই নাগরিক সম্মেলনে বক্তব্য রাখেন চিত্র পরিচালক অপর্ণা সেন, শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার, সমাজকর্মী সমীর আইচ, সমাজকর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায় এবং নব দত্ত। এছাড়াও গতকালের সভায় উপস্থিত ছিলেন বিভিন্ন গণসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক অপর্ণা সেন পিপলস রিপোর্টারের প্রতিনিধিকে বলেন, “গণতন্ত্রের কোনও কিছু অবশিষ্ট নেই আর এদেশে, এ রাজ্যে। পশ্চিমবঙ্গের ভবিষ্যৎ অন্ধকার। সমস্ত জায়গায়, সব রাজনৈতিক দল, আমাদের শাসকদলকে ধরে বলছি, সবাই একেবারে দুর্নীতিগ্রস্ত। আর যারা দুর্নীতিগ্রস্ত নন তারা কোনও আসন পান না।”
মণিপুরের ঘটনা প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “আমি খুব হতাশ হয়ে গেছি। এতগুলো দশক ধরে বলছি, কিন্তু কোনও লাভ হচ্ছে না। রাজ্য, প্রশাসন, শাসকদল এক হয়ে গেলে সাধারণ মানুষ সবথেকে ক্ষতিগ্রস্ত হন।”
পিপলস রিপোর্টারের প্রতিনিধিকে মীরাতুন নাহার বলেন, অকপটভাবে আমি বলছি, ২০১১ সালে আমিও সরকার পরিবর্তনের পক্ষে ছিলাম। কিন্তু তখন আমি মানুষের ওপর ভরসা করেছিলাম। কিন্তু মানুষ এখন ভয়ের শিকার। পঞ্চায়েত নির্বাচনে যা হয়েছে তাকে ভোট বলেনা। ব্যালট পেপারের অবস্থা তো আমরা সবাই দেখেছি। আমি চাইছি জনগণ ঐক্যবদ্ধভাবে স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠাকারী শাসকদলের বিরুদ্ধে গর্জে উঠুক।
চিত্রশিল্পী সমীর আইচ পিপলস রিপোর্টারের প্রতিনিধিকে বলেন, রাজ্যের শাসকদল যা করছে তা একান্তভাবেই অনভিপ্রেত। এতগুলো হত্যা হল পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে। তা নিয়ে সরকারের কোনও বক্তব্য নেই। গোটা বাংলাকে রাজ্যের শাসকদল পৈতৃক সম্পত্তি ভেবে নিয়েছে। এই স্বৈরতান্ত্রিক সরকারের বিরুদ্ধে দলমত নির্বিশেষে সাধারণ মানুষকে গর্জে উঠতে হবে।”
ভাঙড়ের জমি রক্ষা আন্দোলনের অন্যতম নেতা ও এবারের পঞ্চায়েত ভোটের হিংসার শিকার মির্জা হাসান কনভেনশনে বলেন, “বর্তমান সরকার বুঝে গেছে লুঠ করে খেতে গেলে মানুষের প্রতিরোধ আটকাতে হবে। তাই পুলিশকে সঙ্গে নিয়ে পাড়ায় পাড়ায় পরিকল্পিত সন্ত্রাস সৃষ্টি করা হয়েছে। মনোনয়ন পর্বর শুরুর দিন থেকে হিংসা, সন্ত্রাস শুরু হয়।”
তিনি আরও বলেন, বাম আমলেও বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়ী হওয়ার নজির আছে। মারামারি, সন্ত্রাসের নজির আছে। কিন্তু, তৃণমূলের মদতে এবারের নির্বাচনে সমস্ত রেকর্ড ছাপিয়ে গেছে। ১৩ তারিখ শয়ে শয়ে আগ্নেয়াস্ত্র এখানে ঢুকেছে। এখনো সাধারণ মানুষের বাড়িতে সেইসব অস্ত্র আছে। ১৩ তারিখের থেকেও ১৫ তারিখের সন্ত্রাস মাত্রা ছাড়িয়ে যায়।”
হাসান আরও বলেন, “এখন পুলিশ বাড়ি বাড়ি হুমকি দিচ্ছে। এলাকার বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকিকে ঢুকতে দিচ্ছে না। শান্তি প্রতিষ্ঠার নামে গ্রামে গ্রামে পুলিশ ভোরবেলা ঢুকে নাবালক, নির্দোষদের গ্রেফতার করছে। তুলে নিয়ে আসছে। একপেশে ভাবে পুলিস এসব কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে যুক্ত আছে কিছু মানুষ, প্রশাসন। আর গোটা ভাংড়ের নামে বদনাম হচ্ছে। আসুন সমাজের সকল স্তরের মানুষ এক হয়ে শান্তি ফিরিয়ে আনি।”
শিক্ষাবিদ মীরাতুন নাহার কনভেনশনে বক্তব্য রাখতে গিয়ে বলেন, “ভয় ছড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে। সেই ভয়কে ভয় না পাওয়ার অঙ্গীকার করি আমি। গ্রামের পঞ্চায়েত নির্বাচন নামেই রইল। গ্রামের মানুষরা নিজের পরিচয় দিতে পারল না। গ্রামের সব মানুষ কী সন্ত্রাসী? আজকের সভায় এসেছি, নাগরিকদের দায়িত্ব পালন করতে এসেছি। ভাঙড়ের এই গণহত্যার বিচার বিভাগীয় তদন্ত চাই। এই সন্ত্রাসের কাজ সরকারের নয়। শাসকদল করেছে। প্রকৃত সরকার হলে এরকম সন্ত্রাস চলত না। কতজন হত্যার শিকার হয়েছে এখনও প্রকৃত সংখ্যা জানা নেই। এই হত্যার সঙ্গে যারা যুক্ত তাঁরা ঘুরে বেড়াচ্ছে। শাসক দলনেত্রী পরিকল্পনা মাফিক হত্যা করে ক্ষতিপূরণ ঘোষণা করেন। কিন্তু, তিনি হয়তো জানেন না মানুষের মৃত্যুর বা খুনের কোনো ক্ষতিপূরণ হতে পারে না।”
নাহার আরও বলেন, “গণতন্ত্র ঠিক কী অবস্থায় আছে তা আমাদের আবিষ্কার করতে হবে। কারণ, একটা রাজনৈতিক দল শাসক দল হিসাবে এই গণতন্ত্রকে শেষ করে দিয়েছে।”
মানবাধিকার কর্মী বোলান গঙ্গোপাধ্যায় বলেন, “প্রশাসনের মুখ্যমন্ত্রী SSKM হাসপাতালে দলীয় আহত কর্মীদের দেখতে গেলেন। বাকী যাঁরা মারা গেলেন তাদের কাছে গেলেন না। কেন তাঁরা কেউ বিজেপি ISF CONGRESS কিংবা CPIM বলে। উনি কী শুধু TMC কর্মীদের মুখ্যমন্ত্রী? এই সরকার ও প্রশাসনকে মিশিয়ে দেওয়া কী ভয়ংকর অবস্থা হয় তা প্রমাণিত। নির্লজ্জ মুখ্যমন্ত্রী ও তার সরকার।”
এদিন সভা থেকে রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীর উদ্দেশ্যে এক খোলা চিঠি দেওয়া হয়। যে চিঠিতে বলা হয়েছে, “আপনি অবগত আছেন যে ৮ জুন থেকে ১৪ জুলাই পর্যন্ত গত ৩৭ দিনে পশ্চিমবঙ্গের পঞ্চায়েত নির্বাচনকে কেন্দ্র করে ৫২ জন মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন। এবং বহু মানুষ নিখোঁজ।
আপনি পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। নির্বাচন কমিশনের সাংবিধানিক দায়িত্ব অস্বীকার না করেও, এই কথা অবশ্যই বলা যায় যে এই পঞ্চায়েত নির্বাচন কেন্দ্রিক হত্যালীলা, এবং অরাজকতার দায়িত্ব মূলত পশ্চিমবঙ্গ সরকারের এবং আপনার। কারণ স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের ওপর নির্ভর করেই কেন্দ্রীয় বাহিনী ও নির্বাচন কমিশনকে চলতে হয়। পশ্চিমবঙ্গের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবে এই দায়িত্ব আপনি কোনোভাবেই অস্বীকার করতে পারেন না।
আমরা দাবি করছি, অবিলম্বে এই রক্তস্নাত পশ্চিমবঙ্গে নিরপেক্ষ প্রশাসনিক ব্যবস্থা চালু করার মাধ্যমে পশ্চিমবঙ্গবাসীর প্রাণ, জীবিকা ও সম্পত্তির রক্ষার দায়িত্ব নিতে জনগণের দ্বারা নির্বাচিত সরকার উদ্যোগী হোক।”
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন