“সংকীর্ণ রাজনীতিতে তৃণমূল আর বিজেপি সমান।” কলকাতার ইষ্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের উদ্বোধন নিয়ে রাজনৈতিক তরজায় সরগরম রাজ্য। সোমবার বহু প্রতীক্ষিত ইষ্ট ওয়েস্ট মেট্রোর শিয়ালদহ থেকে সেক্টর ফাইভ পর্যন্ত পথের উদ্বোধন হয়েছে। এদিন বিকেল ৪টে নাগাদ হাওড়া ময়দান স্টেশন থেকে ভার্চুয়ালি প্রকল্পের উদ্বোধন করেন কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি।
যদিও উদ্বোধনের পাশাপাশি ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের কৃতিত্ব কার তা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। একদিকে যেমন এই প্রকল্পের কৃতিত্বের দাবি করেছে কেন্দ্রের শাসক বিজেপি, তেমনই এই প্রকল্পের যাবতীয় কৃতিত্ব নিতে তৎপর রাজ্যের শাসকদল তৃণমূলও। প্রকল্পের উদ্বোধনের সময় কেন্দ্রীয় মন্ত্রী স্মৃতি ইরানি এই প্রকল্পকে প্রধানমন্ত্রীর 'নরেন্দ্র মোদির স্বপ্ন' বলে দাবি করেছেন। তিনি বলেন এই স্বপ্ন আজ রূপায়িত হচ্ছে। আবার তৃণমূলের পক্ষ থেকে মমতা ব্যানার্জিকে 'এই প্রকল্পের রূপকার' বলে দাবি করা হয়েছে। অন্যদিকে এই প্রকল্প যে তাদেরই দূরদর্শী পরিকল্পনার ফসল তা তুলে ধরতে সরাসরি লড়াইয়ের ময়দানে নেমেছে সিপিআই(এম)।
এ প্রসঙ্গে সোমবার সিপিআই(এম) ওয়েস্ট বেঙ্গলের অফিসিয়াল ফেসবুক পেজে ৫টি পোস্টারের এক সেট পোস্ট করা হয়েছে। পোস্টারগুলির ক্যাপশনে লেখা হয়েছে, "কাজ শুরু বামফ্রন্টের সময়েই, মমতার বাধাতেই প্রকল্পে কালক্ষেপ। উন্নয়ন নিয়ে মমতা ব্যানার্জির ঘৃণ্য রাজনীতির পথেই কেন্দ্রের মোদী সরকার। ক্ষমতায় বসে কেউ ব্যস্ত ইতিহাস থেকে নেহরুদের নাম মুছতে, কেউ ব্যস্ত বামপন্থীদের নাম মুছতে। এরা কি আদৌ অক্ষয় হয়ে থাকবে ভবিষ্যতে?"
ঠিক কী কী লেখা আছে সিপিআই(এম)-র সেই পোস্টার সেটে?
সিপিআই(এম)-এর প্রথম পোষ্টারে দাবি করা হয়েছে, “হাওড়া থেকে সল্টলেক, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্পের শিলান্যাস হয়েছিল ২০০৯ সালের ২২ ফেব্রুয়ারী। শিলান্যাস করেছিলেন বামফ্রন্ট সরকারের মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। উপস্থিত ছিলেন তৎকালীন বিদেশমন্ত্রী প্রণব মুখার্জি। সেই সময় রেলমন্ত্রকের হাতে ছিল না প্রকল্পটি, কেন্দ্র ও রাজ্য সরকারের যৌথ প্রকল্প ছিল এটা।”
দ্বিতীয় পোষ্টারে সিপিআই(এম) জানিয়েছে, "মমতা বন্দোপাধ্যায় শিলান্যাস অনুষ্ঠানের আগে বলেছিলেন, 'ঋণভারে জর্জরিত রাজ্যকে কেন্দ্র কেন এত টাকা দিচ্ছে? রাজ্য সরকারকে মদত দেওয়া বন্ধ করুন। লোকসভার ভোট চলে এসেছে, এখনও সিপিএম'কে তোয়াজ করছেন কেন?' শিলান্যাস অনুষ্ঠানে বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের যাওয়ার পথে কালো পতাকা দেখানোর চেষ্টা করেছিল তৃণমূল কর্মীরা। সেদিনই বিকেলে কেন্দ্রীয় মন্ত্রী প্রণব মুখার্জিকে "সিপিএম'র পদলেহনকারী বাংলার এক নায়ক" বলে সম্বোধন করেছিলেন পার্থ চ্যাটার্জি।
সিপিআই(এম) জানিয়েছে, ভারতে নদীর তলা দিয়ে প্রথম ট্রেনলাইন তৈরির এই মেট্রো প্রকল্পের কাজ তো ২০১৪-র অক্টোবরে শেষ হওয়ার কথা ছিল। হয়নি কেন? ২০২২-র জুলাইয়ে প্রকল্পের আংশিক উদ্বোধন হচ্ছে কেন? কারণ, রেলমন্ত্রককে কাজে লাগিয়ে হাওড়া ও শিয়ালদহে মেট্রো স্টেশনের পরিকল্পনাকে বানচাল করতে উঠেপড়ে লাগেন মমতা। কদর্য রাজনীতিকে মর্যাদার লড়াইয়ে নিয়ে যায়নি বামফ্রন্ট সরকার। রেলমন্ত্রকের হাতে প্রকল্প তুলে দিয়ে বামফ্রন্ট সরকার বলে "কেন্দ্র-রাজ্য যৌথ উদ্যোগেই হোক, অথবা রেলের মাধ্যমেই হোক, ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রো প্রকল্প চালু হলেই নাগরিকদের লাভ।"
ইষ্ট ওয়েস্ট মেট্রো প্রসঙ্গে রাজ্যের তৃণমূল সরকারকে কাঠগড়ায় তুলে সিপিআই(এম) জানিয়েছে, প্রকল্প হাতে পেয়েই কলকাতার কিছু ব্যবসায়ী, জমি মাফিয়াদের স্বার্থে ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর রুটটাই পাল্টে ফেলেন মমতা। ইঞ্জিনিয়ার ও ভূবিজ্ঞানীদের যাবতীয় সমীক্ষার থেকে বেশি গুরুত্ব পায় তৃণমূল নেতাদের মর্জি। যার ফলে প্রকল্পে ব্যয় হাজার কোটি টাকা বেড়েছে। দশ বছর সময় নষ্ট হয়েছে, শেষ হয়নি প্রকল্পের কাজ। নতুন রুটে মধ্য কলকাতায় বিভিন্ন বাড়িতে ফাটল দেখা দিচ্ছে।
নিজেদের প্রচারে সিপিআই(এম) জানিয়েছে, ইউপিএ সরকার থেকে বামপন্থীরা সমর্থন তুলে নিলেও বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের আমন্ত্রণে প্রণব মুখার্জী এসেছিলেন প্রকল্প শিলান্যাসে। উন্নয়নকে গুরুত্বের দৃষ্টিতে দেখেছিলেন তাঁরা। আর এখন? রাজ্যপাল জগদীপ ধনকড়কে আমন্ত্রণ জানালেও ইস্ট-ওয়েস্ট মেট্রোর অনুষ্ঠানে মমতা ব্যানার্জীকে আগে থেকে আমন্ত্রণ জানানো হয়নি।
সিপিআই(এম) আরও জানিয়েছে, ঠিক যেমন, ২০০৯-র আগস্টে রেলমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী টালিগঞ্জ থেকে গড়িয়া সম্প্রসারিত মেট্রোরেল প্রকল্পের উদ্বোধন করেছিলেন রাজ্যপাল গোপালকৃষ্ণ গান্ধীকে পাশে বসিয়ে। ঐ সম্প্রসারণের ৩৩% ব্যয়বহন করলেও আমন্ত্রণ পাননি পশ্চিমবঙ্গ সরকার মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। আসলে সংকীর্ণ রাজনীতিতে তৃণমূল আর বিজেপি সমান।
এই প্রসঙ্গে রাজ্যের প্রাক্তন নগর উন্নয়ন মন্ত্রী তথা সিপিআইএম নেতা অশোক ভট্টাচার্য বলেন, বিজেপি সরকার এবং তৃণমূল সরকার উভয়ের পক্ষ থেকে ইতিহাসকে বিকৃত করার চেষ্টা করা হচ্ছে। তৎকালীন বামফ্রন্ট সরকারের দীর্ঘ প্রচেষ্টার ফলেই জাপান সরকারের আন্তর্জাতিক সহায়তা সংস্থার অর্থ ইস্ট ওয়েস্ট মেট্রো করিডর প্রকল্পে আনা সম্ভব হয়েছিল। রাজ্যের নগরোন্নয়ন দপ্তরের পক্ষ থেকে এই প্রকল্পের পরিকল্পনা করা হয়েছিল। তৎকালীন মুখ্যমন্ত্রী বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য এই প্রকল্পের জন্য আন্তরিকভাবে উদ্যোগ নিয়েছিলেন বলে এটা সম্ভব হয়েছিল।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন