প্রায় ১১ বছর পর ব্যঙ্গচিত্র কান্ডের ফৌজদারি মামলা থেকে নিষ্কৃতি পেলেন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর অম্বিকেশ মহাপাত্র। বুধবার আলিপুরের দশম অতিরিক্ত দায়রা আদালত থেকে কার্টুন মামলায় নিষ্কৃতি পেয়েছেন রসায়নের এই অধ্যাপক। এই ঘটনাকে তিনি ‘গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিকের জয়’ হিসাবেই দেখছেন।
মামলা থেকে অব্যাহতি পেয়ে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক অম্বিকেশ সমাজমাধ্যমে লিখেছেন, ‘প্রায় ১১ বছর পর ব্যঙ্গচিত্রকাণ্ডের ফৌজদারি মামলা থেকে নিষ্কৃতি মিলল। রাজ্যের সাধারণ প্রশাসন, পুলিশ প্রশাসন, শাসকদল এবং দুষ্কৃতীদের শত বেআইনি এবং অসাংবিধানিক বাধা সত্ত্বেও। এই জয় গণতন্ত্রপ্রিয় নাগরিকের গণতন্ত্রের প্রতি দায়বদ্ধতার জয়।’
২০১২ সালের এপ্রিল মাসে, তৃণমূল দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জি এবং তৃণমূল নেতা মুকুল রায়কে নিয়ে সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি কার্টুন ফরোয়ার্ড করেছিলেন অম্বিকেশ মহাপাত্র। সেই কার্টুনের নির্যাস ছিল, মুকুল রায় মমতা ব্যানার্জিকে অভিযোগ জানিয়ে বলছেন, ব্যারাকপুরের তৎকালীন তৃণমূল সাংসদ দীনেশ ত্রিবেদীর জন্য রেলমন্ত্রী হতে পারছেন না তিনি। এর জবাবে মমতা ব্যানার্জি বলছেন, ‘দুষ্টু লোক ভ্যানিশ’ হয়ে যাবে।
প্রসঙ্গত, এই ‘দুষ্টু লোক ভ্যানিশ’কথাটি কিংবদন্তী পরিচালক সত্যজিত রায় পরিচালিত ‘সোনার কেল্লা’ সিনেমার বহুল প্রচলিত একটি ‘ডায়লগ’। এই ডায়লগকে ব্যবহার করে এই রাজনৈতিক স্যাটায়ার মূলক কার্টুনটি তৈরি হয়েছিল। অম্বিকেশ মহাপাত্র স্রেফ সেই কার্টুনটি ‘ফরোয়ার্ড’করেছিলেন।
এই অপরাধে তখনই অধ্যাপকের পূর্ব যাদবপুরের বাড়িতে গিয়ে হেনস্থা করে ৭০-৮০জন তৃণমূলী দুষ্কৃতি। তাদের নেতৃত্ব দেন ৪ স্থানীয় তৃণমূল নেতা। এরপর পূর্ব যাদবপুর থানায় তৃণমূলের তরফে অম্বিকেশ মহাপাত্র এবং তাঁর প্রতিবেশি সুব্রত সেনগুপ্তর বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ দায়ের করা হয়। ১২ এপ্রিল তাঁদের দুইজনকে গ্রেপ্তার করে পূর্ব যাদবপুর থানার পুলিশ। পরবর্তীকালে আলিপুর আদালতে ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাস থেকে জামিন পান তাঁরা।
পুলিশের তরফে অম্বিকেশ মহাপাত্রের বিরুদ্ধে ভারতীয় দন্ডবিধির ৫০৯, ৫০০, ১১৪ নম্বর ধারা, এবং তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ(বি) এবং ৬৬এ(সি) ধারায় মামলা দায়ের হয়। সেই মর্মে ২০১২ সালেই ৯৬ পাতার চার্জশিট দাখিল করে পুলিশ। এর পরবর্তীকালে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের দুটি ধারা ছাড়া বাকি সমস্ত অভিযোগ প্রত্যাহার করা হয় সরকারের তরফে।
মামালা থেকে নিষ্কৃতির পর সংবাদমাধ্যমে মহাপাত্র বলেন, “২০১৫ সালে সুপ্রিম কোর্ট কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রককে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৬৬এ ধারা খারিজ করার নির্দেশ দেয়। ২০২১ সালে কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক সমস্ত রাজ্যকে লিখিত নির্দেশ পাঠিয়ে ৬৬এ ধারার অন্তর্গত সমস্ত মামলা খারিজের নির্দেশ দেয়। কিন্তু তারপরেও মুখ্যমন্ত্রীর সচিবালয়, পুলিশ এবং বিচার ব্যবস্থার একটা অংশের যোগসাজশে আমার বিরুদ্ধে মামলা চলতে থাকে।“
এর পর, ২০২১ সালের সেপ্টেম্বরে এই মামলা থেকে নিষ্কৃতি পাওয়ার জন্য মুখ্য বিচারবিভাগীয় ম্যাজিস্ট্রেটের এজলাসে আবেদন জানান অম্বিকেশ মহাপাত্র। কিন্তু সেই আবেদন খারিজ হয়। এর পালটা আলিপুর আদালতের দশম অতিরিক্ত দায়রা বিচারকের এজলাসে মামলা থেকে নিষ্কৃতির আবেদন জানিয়ে পিটিশন দাখিল করেন অম্বিকেশ মহাপাত্র। বুধবার সেই আবেদনের ভিত্তিতেই দায়রা আদলত তাঁকে ২০১২ সালে পূর্ব যাদবপুর থানায় করা মামলা থেকে নিষ্কৃতির আদেশ দিয়েছে।
আদালত সূত্রে খবর, অম্বিকেশের বিরুদ্ধে তেমন সাক্ষ্যপ্রমাণ না থাকায় বুধবার বিচারক তাঁকে অব্যাহতি দিয়েছেন। ওই নির্দেশ মুখ্য বিচারবিভাগীয় বিচারকের কাছে পাঠানো হয়েছে।
অম্বিকেশ মহাপাত্রের আরও অভিযোগ, তাঁকে হেনস্থা করার অভিযোগে, ৪ স্থানীয় তৃণমূল নেতার বিরুদ্ধে পালটা অভিযোগ করেছিলেন তিনি। সেই মামলাটিকেও দীর্ঘদিন ধরে চালিয়ে যাচ্ছে পুলিশ প্রশাসন, যাতে দোষীরা শাস্তি না পায়। কিন্তু তিনি সেই মামলার শেষ দেখে ছাড়বেন।
এই প্রসঙ্গে অম্বিকেশ মহাপাত্র পিপলস রিপোর্টারকে জানিয়েছেন, মুখ্যমন্ত্রীর এজলাস, দুষ্কৃতি বাহিনী, শাসকদল এবং কলকাতা পুলিশের যৌথ ষড়যন্ত্রে আলিপুর ক্রিমিনাল কোর্টে দীর্ঘদিন ধরে তাঁর বিরুদ্ধে এই মামলা চলেছে। সবটাই করা হয়েছিল বিচার ব্যবস্থার একটা অংশকে প্রভাবিত করে। যে মামলা একদিনও চলার কথা নয়, সেই মামলাকে দীর্ঘ ১১ বছর ধরে টেনে গিয়েছে রাজ্যের প্রশাসন। সংবিধান রক্ষার দায়িত্বে যারা ছিলেন, তারা নিজেদের কাজ সঠিকভাবে করেননি।
বিরোধী কন্ঠস্বরকে দমন করার জন্যই এই কাজ করা হয়েছে। উচ্চতর আদালতের রায়ে সেই বিষয়টাই স্পষ্ট হয়েছে। এই জয় মানবাধিকার আন্দলনের জয়, গনতন্ত্রের জয়। বিরোধী কন্ঠস্বরকে দমন করার যে প্রচেষ্টা চলছিল, সেই প্রচেষ্টার বিরুদ্ধে এই জয়।’’
বেল বন্ড ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে আদালত। তিনি বলেন, “বেল বন্ড ফেরত দেওয়ার নির্দেশ দিয়েছে জেলা আদালত। আমি আশা করি নিম্ন আদালত জেলা আদালতের এই নির্দেশ মেনে বেল বন্ড ফেরত দেবে আমাকে।“
এই প্রসঙ্গে সিপিআইএম কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য সুজন চক্রবর্তী বলেন, "তিনি শুধু শেয়ার করেছিলেন, মিম তৈরিও করেননি। শুধু শেয়ার করার জন্য তাঁকে বাড়িতে গুন্ডা পাঠিয়ে হেনস্থা করা হলো, থানায় মামলা করা হলো, গ্রেফতার করা হলো, আদালতে মামলা করা হলো, সর্বোপরি সেই মামলা ১১ বছর ধরে চালানো হলো। অথচ সুপ্রিম কোর্ট ২০১৫ সালে ৬৬ এ ধারা খারিজ করার নির্দেশ দিয়েছে। আম্বিকেশ মহাপাত্র ছাড়া আরও অনেকের সাথে এরকম হয়েছে। এই সরকার সংবিধান বিরোধী। তাই কোনো নিয়ম নির্দেশ মানেনি। এই হয় গণতন্ত্রের জয়।
উল্লেখ্য, অম্বিকেশ মহাপাত্রের হয়ে আইনী লড়াই লড়েছেন আইনজীবী সুশীল চক্রবর্তী।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন