জেল মিউজিয়ামের রেস্তোরাঁয় স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামে মেনুকার্ড! নিন্দায় সরব ইতিহাসবিদরা

রেস্তোরাঁর কর্মীদের কথায়, এখানে খেতে আসা মানুষদের স্বাধীনতা সংগ্রামের 'আমেজ' দিতে প্ল্যাটারগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামে রাখা হয়েছে।
বিতর্কিত সেই মেনু কার্ড
বিতর্কিত সেই মেনু কার্ডছবি - সোশ্যাল মিডিয়া
Published on

কেউ কেউ ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলছেন 'উদ্ভট মেনুকার্ড', আবার কারোর কারোর তীব্র কটাক্ষে ভরা পোস্ট ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। কিন্তু আসল ব্যাপারটা কী? আলিপুর সেন্ট্রাল জেল মিউজিয়ামের পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত ‘একান্তে ইন্ডিপেন্ডেন্স কিচেন’ নামক একটি রেস্তোরাঁ। সেখানকার মেনুকার্ডে রয়েছে খোদ স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নাম দিয়ে তৈরী আমিষ-নিরামিষ প্ল্যাটার!

মঙ্গলবার সকাল থেকেই চার রকমের প্ল্যাটার সমেত মেনুকার্ডের ছবি ব্যাপক ভাইরাল হয়েছে সোশ্যাল মিডিয়ায়। তারপর থেকেই শুরু হয়েছে সমালোচনার ঝড়। চার ধরণের ভোজ থালিতে রয়েছে - 'সাঁওতাল বিদ্রোহ প্ল্যাটার', 'সিপাহী বিদ্রোহ প্ল্যাটার', 'আইএনএ স্পেশাল প্ল্যাটার' এবং 'বিবিডি (বিনয়-বাদল-দীনেশ) প্ল্যাটার'।

মূলত ফেসবুকের একটি খাদ্য বিষয়ক গ্রুপে সিপাহি বিদ্রোহ এবং বিবিডি প্ল্যাটারের ‘রিভিউ’ পড়ে অনেকে বিষয়টি জানতে পারেন। তারপর থেকেই ক্ষোভে ফুঁসছেন মানুষজন। আগে মিউজিয়ামের পশ্চিম প্রান্তে ছিল জেল হাসপাতাল। সেই ভবনেরই একতলায় তৈরী হয়েছে রেস্তোরাঁটি।

সূত্রের খবর, মঙ্গলবার এক মহিলার সাথে রেস্তোরাঁর এক কর্মচারীর কথোপকথনে মহিলাকে বলতে শোনা যায় - আচ্ছা, এই 'আজাদ হিন্দ'টা তো ৩৯৯ টাকা। এতে কী কী থাকছে? উত্তরে কর্মচারীটি বলেন - এতে আপনি লুচি, বাসন্তী পোলাও, মটন কষা পাবেন। পাল্টা মহিলা বলেন, ওরে বাবা! অত খেতে পারব না, আর দামটাও...। এই 'বিনয়-বাদল-দীনেশ'টা বেশ সস্তা দেখছি। এতেই বা কী কী থাকছে? আর দু'জনের কুলোবে তো?

রেস্তোরাঁর অন্যান্য কর্মীদের কথায়, এখানে মূলত চারটি প্ল্যাটার পাওয়া যায়। এখানে খেতে আসা মানুষদের স্বাধীনতা সংগ্রামের 'আমেজ' দিতে প্ল্যাটারগুলি স্বাধীনতা সংগ্রামীদের নামে রাখা হয়েছে। প্ল্যাটারগুলির দামের তারতম্য রয়েছে। আমিষ এবং নিরামিষ দু'রকমই পাওয়া যায়। নিরামিষাশীদের জন্য রয়েছে 'বিবিডি (বিনয়-বাদল-দীনেশ) প্ল্যাটার'।

সোশ্যাল মিডিয়ায় মেনুকার্ডের ছবি ভাইরাল হওয়ার বিষয়টি নিয়ে এক রেস্তোরাঁ কর্মীকে প্রশ্ন করা হলে, কোনও উত্তর মেলেনি। অন্য আরেক কর্মী জানান - সকাল থেকে আমাদের বলা হয়েছে, মেনুকার্ডের ছবি যেন কেউ না তোলে। ওভাবে কি কাউকে আটকাতে পারি আমরা? তাই মেনুকার্ড দেওয়া বন্ধ রয়েছে। মনে হয় 'কিছু একটা গণ্ডগোল' হয়েছে।

তবে গণ্ডগোলটা ঠিক কী তা জানতে চাওয়া হয় মিউজ়িয়াম পরিচালনার দায়িত্বপ্রাপ্ত হিডকোর কর্তা দেবাশিস সেনের কাছে। তিনি বলেন, আমি নিজে বিষয়টি খতিয়ে দেখব। কাউকে আঘাত দেওয়া আমাদের উদ্দেশ্য নয়। অবিলম্বে মেনুকার্ডের বদল আনা হবে।

তবে এখানেই শেষ নয়, নবনির্মিত সংগ্রহশালার প্রদর্শনীতে ভগৎ সিং, অরবিন্দ ঘোষ, চন্দ্রশেখর আজাদের পাশে একই বন্ধনীতে রাখা হয়েছে ব্রিটিশদের কাছে ৬ বার মুচলেকা দেওয়া সাভারকারের নাম। মিউজিয়ামের বই বিপণীতে রয়েছে কেবলমাত্র মুখ্যমন্ত্রী মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা বইসমগ্র।

এছাড়াও, রেস্তোরাঁর কিচেন থেকে কিছুটা দূরে থাকা বন্দিদের বারাককে রূপান্তরিত করা হয়েছে প্রদর্শনশালায়। যেখানে রয়েছে দক্ষিণ কলকাতার পুজো মণ্ডপের একটি প্রতিমা। যা দেখে ইতিমধ্যেই ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দর্শনার্থী থেকে শুরু করে ইতিহাসবিদ এবং গবেষকরাও। তাঁদের মতে, সাধারণ মানুষের করের টাকায় দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস এবং গরিমাকে কর্দমাক্ত করা হচ্ছে।

এ প্রসঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাক্তন নুরুল হাসান চেয়ার অধ্যাপক অরুণ বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন, এ তো পরিষ্কার ইতিহাসের জনমোহিনী বিকৃতি। অত্যন্ত গর্হিত কাজ। এ সব খাবারের সঙ্গে ইতিহাসের ছিটেফোঁটা সম্পর্কও নেই। মিউজ়িয়ামে ঘুরতে ঘুরতে খিদে পেলে খাবারের বন্দোবস্ত থাকতেই পারে। তার সঙ্গে খামোখা ইতিহাসকে মেশানোর চেষ্টা কেন?

প্রেসিডেন্সি বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজতত্ত্বের শিক্ষক উপল চক্রবর্তী জানান, সারা দুনিয়াতেই মিউজ়িয়াম, সঙ্গের সুভেনির শপ (স্মারক বিপণি), কাফে ইত্যাদি মিলিয়ে ইতিহাসের এক ধরনের পণ্যায়নের পরিসর তৈরি হয়। ইতিহাস তখন আমজনতার খোরাক হয়ে ওঠে। মেনুকার্ডটা এরই উদ্ভট রূপ।

বিতর্কিত সেই মেনু কার্ড
RBU: জোড়াসাঁকো ক্যাম্পাসের হেরিটেজ ভবন ভেঙে 'তৃণমূলের দফতর' নির্মাণ! হাইকোর্টে ধাক্কা রাজ্যের

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in