আজ উত্তর ২৪ পরগনায় মতুয়া মহাসঙ্ঘের প্রধান কেন্দ্র ঠাকুরনগরের মাঠে অমিত শাহের জনসভা। প্রস্তুতি শেষ। কেন্দ্রীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এদিন সংশোধিত নাগরিকত্ব আইন নিয়ে কী বার্তা দেন, সেদিকেই তাকিয়ে মতুয়ারা। একদিনের সফরে আসছেন তিনি।
গত মাসেই ঠাকুরনগরে সভা করার কথা ছিল। কিন্তু দিল্লিতে বিস্ফোরণের জেরে স্থগিত হয়ে যায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর সফর। মঞ্চ তৈরি হলেও, শেষমুহূর্তে বাতিল হয় সভা। তবে তাঁর নির্দেশে সেই মঞ্চ খোলা হয়নি। বৃহস্পতিবার ঠাকুরনগরের সেই মঞ্চেই সভা করতে আসছেন অমিত শাহ। ইতিমধ্যেই শেষ হয়েছে অস্থায়ী হেলিকপ্টার প্যাড তৈরির কাজ। বিভিন্ন এলাকা থেকে আসতেও শুরু করেছেন মতুয়ারা।
বিজেপি সূত্রের খবর, সকাল সাড়ে ১১টা নাগাদ কোচবিহার থেকে বিজেপির পরিবর্তন যাত্রার রথ উদ্বোধন করবেন তিনি। দুপুর ৩টে ২০ মিনিট নাগাদ ঠাকুরনগরে পৌঁছবেন অমিত শাহ। প্রথমে হরিচাঁদ-গুরুচাঁদ মন্দিরে পুজো দিয়ে বেলা পৌনে চারটে নাগাদ ঠাকুরনগরের জনসভায় বক্তব্য রাখতে উঠবেন তিনি। তবে যে নাগরিকত্ব সংশোধনী আইন নিয়ে মতুয়ারা উদগ্রীব, বিধানসভা ভোটের আগে তা কার্যকর করা হচ্ছে না, তা আগেই জানিয়ে দিয়েছে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রক। জানানো হয়েছে, সিএএ কার্যকর করার জন্য রাজ্যসভা ও লোকসভার কমিটির তরফে কেন্দ্রকে ৯ এপ্রিল থেকে ৯ জুলাই পর্যন্ত সময়সীমা দেওয়া হয়েছে। সেক্ষেত্রে নির্বাচনের প্রাক্কালে মতুয়াদের ক্ষোভ প্রশমনে অমিত শাহ কী বার্তা দেন, তার ওপরেই নির্ভর করছে রাজ্যে নির্বাচনের একাধিক আসনের ফল। কারণ, এরাজ্যে অন্তত ৭৪টি বিধানসভা কেন্দ্রে মতুয়া ভোটাররা গুরুত্বপূর্ণ। উত্তর ও দক্ষিণ ২৪ পরগনার ৩১টি সংরক্ষিত বিধানসভা আসনে কার্যত নিয়ন্ত্রকের ভূমিকা নেয় মতুয়া ভোটব্যাঙ্ক। যদিও অমিত শাহের সভাকে কটাক্ষ করতে ছাড়েনি তৃণমূল।
বুধবার সভার প্রস্তুতি খতিয়ে দেখেন বনগাঁর বিজেপি সাংসদ শান্তনু ঠাকুর। সঙ্গে ছিলেন বনগাঁর বিজেপি নেতা তপন সিংহ। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকদের একাংশের ব্যাখ্যা, সিএএ নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারের ‘গড়িমসি’র জেরে নাগরিকত্বের প্রশ্নে ‘মন্থন’ চলছে মতুয়া সম্প্রদায়ের মধ্যে। তাই অমিত-বার্তার অপেক্ষায় অধীর আগ্রহে মতুয়া সমাজ। তাঁদের সামাল দিতেই শান্তনুর বার্তা, ‘‘এর আগে কেউ সিএএ নিয়ে ভাবেননি। মতুয়ারা এই দাবি দীর্ঘ দিন ধরেই জানিয়ে আসছে। আগামিকাল স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর ভাষণে সিএএ নিয়ে তাঁদের অবস্থান আরও স্পষ্ট করে দেবেন।“ তিনি যে দু'পক্ষের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখার চেষ্টা করছেন, তা পর্যবেক্ষকদের কাছে স্পষ্ট। ঠিক এই জায়গাতেই আসলে কী ঘটতে চলেছে তা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করছে বনগাঁর তৃণমূল শিবির। প্রাক্তন তৃণমূল সাংসদ মমতাবালা ঠাকুরের মতে, ‘‘অমিত শাহ রাজনৈতিক সভা করতে আসছেন। উনি সিএএ নিয়ে কিছুই বলবেন না। কারণ উনি জানেন, এটা কখনই করতে পারবেন না।’
মমতাবালার সুরে রাজ্যের খাদ্যমন্ত্রী জ্যোতিপ্রিয় মল্লিক বলেন, ‘‘অমিত শাহ এনপিআর, এনআরসি এবং সিএএ নিয়ে কী বলেন আগে শুনি। মতুয়াদের দাবি মতো, নির্বাচনের আগে উনি কী করে এটা চালু করবেন জানি না। বিষয়টায় ধোঁয়াশা রয়েছে। অমিত শাহের এই সফর মতুয়ারা কতটা গ্রহণ করবেন তা-ও জানি না। শান্তিপ্রিয় মতুয়াদের হয়তো উনি ভুল বুঝিয়ে চলে যেতে পারেন।’’
এদিকে সিএএ নিয়ে আশ্বাস দেওয়া নিয়ে বলিউডি স্টাইলে কটাক্ষ করলেন মতুয়া সম্প্রদায়ভুক্ত গৌরাঙ্গ হালদার এবং অধীর দেওয়ান। বিজেপি সাংসদ সানি দেওল অভিনীত সিনেমা ‘দামিনী’-তে তাঁর মুখের সংলাপ ধার করেই তাঁদের অভিমত, ‘‘তারিখ পে তারিখ, তারিখ পে তারিখ। কবে এই প্রশ্নের উত্তর মিলবে জানা নেই। দেখি কাল কী হয়।’’
গত ডিসেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে শান্তিনিকেতন সফর ছিল অমিতের। বোলপুরে তিনি স্পষ্ট জানিয়েছিলেন, এখনও নাগরিকত্ব আইন পুরোপুরি হওয়া বাকি আছে। এখনই সিএএ নিয়ে ভাবছে না কেন্দ্রীয় সরকার। আপাতত করোনা পরিস্থিতির মোকাবিলা করাই মূল লক্ষ্য।
অমিতের এই বার্তা নিয়ে শোরগোল পড়ে গিয়েছিল মতুয়াদের মধ্যে। মুখ খুলেছিলেন শান্তনুও। দলীয় কর্মসূচিও এড়িয়ে যাচ্ছিলেন তিনি। তারপর তাঁকে নিয়ে দলীয় আলোচনাও হয়। তাতে তিনি আবার দলমুখী হন। নাগরিকত্ব প্রশ্নে কেন্দ্রের অবস্থান জানতে ‘অস্থির’ হয়ে উঠেছিলেন শান্তনু। তার উপর অমিতের সফর বাতিল হওয়ায় ঠাকুরনগরে মতুয়াদের ভক্তিকেন্দ্রে পরিস্থিতি সামাল দিতে যান রাজ্য বিজেপি-র কেন্দ্রীয় পর্যবেক্ষক কৈলাস বিজয়বর্গীয় এবং বিজেপি-র সর্বভারতীয় সহসভাপতি মুকুল রায়। অমিত নিজেও শান্তনুকে ফোন করে জানান, খুব তাড়াতাড়িই ঠাকুরনগরে আসবেন। সাময়িক ভাবে সেই পরিস্থিতির মোকাবিলা করা গেলেও তা যে চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত নয়, সেই বার্তা বিজেপি-র কেন্দ্রীয় নেতৃত্বের কাছে শান্তনু ভালোরকম ভাবেই পৌঁছে দিতে পেরেছেন বলেই মনে করছে রাজনৈতিক মহলের একাংশ।
সিএএ নিয়ে আশ্বাসের পাশাপাশি রাজ্যে বিধানসভা ভোটের প্রাক্মুহূর্তে নতুন একটি দাবি তুলেছেন শান্তনু। রাজ্যের ৮০টি আসনে মতুয়া ভোট ‘ফ্যাক্টর’ হয়ে উঠতে পারে বলে তাঁর মত। তাই ওই সব আসনে মতুয়া সম্প্রয়াদের মধ্যে থেকে প্রার্থী বাছাই করার দিকে জোর দিয়েছেন তিনি। আর সারা ভারত মতুয়া মহাসঙ্ঘ এমনটা চায় বলেও দাবি বনগাঁর সাংসদের।
বনগাঁর বিজেপি নেতা দেবদাস মণ্ডলের সংক্ষিপ্ত জবাব, ‘‘কত জন মতুয়া ভোটে প্রার্থী হবেন তা নিয়ে দল সিদ্ধান্ত নেবে।’’ এই প্রসঙ্গে বনগাঁর তৃণমূল নেতা গোপাল শেঠের মতে, ‘‘যিনি বাড়ির পাশের লোককে চেনেন না, তিনি ৮০টি বিধানসভা আসনে নির্বাচনে জেতার স্বপ্ন দেখেন কী করে? উনি নামেই সাংসদ। ওঁর কোনও কার্যকলাপ নেই। সেই কারণে ওঁর নাম বনগাঁর মানুষ ভুলে গিয়েছেন।‘ মতুয়ারা তৃণমূলের পক্ষেই রয়েছেন বলে দাবি তাঁর।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন