বয়স আশি পেরিয়েছে। কিন্তু এখনও যেকোনও প্রতিবাদ মিছিল বা কোনও ইস্যুতে স্পষ্ট বার্তা জানানোর ক্ষেত্রে বামেদের অন্যতম মুখ বিমান বসু। সে বগটুই কাণ্ডে ঘটনাস্থলে পৌঁছে যাওয়াই হোক, অথবা অন্য কোনও ঘটনা। তিনি কার্যত দলীয় নীতির অভিমুখ এঁকে দেন। এত বছরের রাজনৈতিক জীবনে নিজের হাতের তালুর মতো চেনেন দেশ, রাজ্য, শহর-গ্রাম। তাঁকে সামনে রেখেই বঙ্গ সিপিএম অনেক ক্ষেত্রে দৃঢ় সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
কিন্তু কালের নিয়ম। শুরু হলে তার শেষ তো হতেই হবে। তাই বামপন্থীদের অভিভাবকসম এই মানুষটিকে ছাড়তে হচ্ছে পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য পদ। রবিবার সিপিআই(এম)-র পার্টি কংগ্রেসের শেষদিনে এই ছোটখাটো মানুষটি শুধুই ফিরে গেলেন অতীতে।
পার্টি কর্মসূচিতে কোনওদিন বিমান বসুকে কোনও ঋতু মেনে চলতে দেখা যায়নি। প্রায় পঞ্চাশ বছর ধরে আলিমুদ্দিন তাঁর সর্বক্ষণের ঠিকানা। যেদিন শরীর দেবে না, সেদিন থেকে তিনি আর বেরোবেন না। এমনই ছিল মন্ত্র তাঁর। মঞ্চ থেকে ছোট লাফে নেমে পড়া, তড়তড়িয়ে সিড়ি ভাঙায় আজও তরুণদের চ্যালেঞ্জ ছুড়তে পারেন।
সিপিআই(এম) সদর দফতরের ছাদে একফালি বাগানে নানা ফুল ও ফলের সমাহার। একফালি বাগানের মালি বিমান বসু। প্রতিদিন গাছের পরিচর্যায় সময় দেন। দলের বিভিন্ন দফতর সামলে আজ শীর্ষে। নতুনকে এগিয়ে দেওয়ার পক্ষপাতী তিনি বরাবরই। বলেন, নতুনের পায়ে আগামীর শব্দ শোনা যায়।
বাড়ি ছাড়ার পরে প্রথমে বেনিয়াপুকুরে কৃষকসভার অফিসে উঠেছিলেন। পরে প্রমোদ দাশগুপ্ত ভবনে পাকাপাকি থাকতে শুরু করেন। কান্নুরে দাঁড়িয়ে বললেন, 'এতদিন আমিই পার্টির সব জানতাম। কাউকে কিছু জানাতে হত না। এখন পার্টি আমাকে যা বলবে, সেটাই করব। শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত পার্টিই করব। কারণ, আমার তো পার্টি ছাড়া আর কিছু নেই।'
কয়েকদিন আগে বিমান বসুর স্মৃতিতে উঠে এসেছিল মা'য়ের কথা। বলেন, 'মাকে আমি খুব ভালবাসতাম। তাঁর জন্যই কমিউনিস্ট পার্টিতে আসা। বড়দের মুখে শুনেছি মাকে আমি নাকি জন্মের সময় খুব কষ্ট দিয়েছিলাম। আমি যখন গর্ভে, পূর্ববঙ্গ থেকে মাকে নিয়ে বাবা স্টিমারে গোয়ালন্দ হয়ে ট্রেনে কলকাতা এসেছিলেন। স্টিমারযাত্রায় মায়ের রক্তক্ষরণ হয়। ট্রেনে উঠে রক্ত বন্ধ হয়। কলকাতায় এসে তখনকার ক্যাম্পবেল হাসপাতালের নামী ডাক্তার নীলরতন সরকারের কাছে বাবা লিখে পাঠিয়েছিলেন মাকে পরীক্ষা করাতে। প্রসবের সময় আর পাঁচটা শিশুর মতো আমার মাথা আগে বেরোয়নি, পা বেরোয়। আর কষ্ট পেয়েছিলাম সেই মাকেই ছেড়ে পার্টির সর্বক্ষণের কর্মী হয়ে। বাড়ি ছাড়লাম।'
জীবনে রাজনীতি ছাড়া আর কিছুই নেই। শ্বাস-প্রশ্বাসে শুধুই শ্রেণি সংগ্রাম, শোষিতের জন্য লড়াই। শুধুই সাম্যবাদের গান। সকালের কৈশোর থেকে সন্ধের অবসর, পুরোটাই রাজনীতিতে নিবেদিত বিমানবাবু কী কী পদ সামলেছেন? বামফ্রন্ট চেয়ারম্যানের। বঙ্গ সিপিআই(এম)-র প্রাক্তন সম্পাদক। সিপিআই(এম) পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদ্য প্রাক্তন সদস্য তিনি। পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ ছাড়তে হল বয়সের কারণে। তবে কেন্দ্রীয় কমিটির আমন্ত্রিত সদস্য হিসেবে থাকবেন। ১৯৮৫ সালে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্যপদ পেয়েছিলেন বিমান বসু। তখন তিনি ৪৬।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন