'একবার জেলে পাঠিয়ে দিন' - হোমগার্ডের চাকরির আশায় মাওবাদী হওয়ার হিড়িক জঙ্গলমহলে

পাশাপাশি অভিযোগ ওঠে যাঁরা প্রকৃত মাওবাদী, তাঁদের একাংশ এই সুবিধা পাননি।
'একবার জেলে পাঠিয়ে দিন' - হোমগার্ডের চাকরির আশায় মাওবাদী হওয়ার হিড়িক জঙ্গলমহলে
ছবি- সংগৃহীত
Published on

মাওবাদী অধ্যুষিত বলতে পুরুলিয়ার বেশ কয়েকটি এলাকা বোঝাত। গোটা জঙ্গলমহলে মাওবাদীদের যথেষ্ট প্রভাব ছিল। তারা একের পর এক নাশকতামূলক ঘটনা ঘটিয়েছে বামফ্রন্টের আমলে। ক্ষমতা পরিবর্তনের পর তাদের অনেকেই তৃণমূল সরকারে ফিরেছেন। কয়েকদিন আগেই সেই মাওবাদীদের কয়েকজন পুলিশের হোমগার্ডের চাকরি পেয়েছে। তারপর থেকেই চিত্রটাই বদলে গিয়েছে।

আগে কোনও মাওবাদীই প্রকাশ্যে আসতে চাইতেন না অথবা পরিচয় দিতেন না। কিন্তু এখন মাওবাদী হওয়ার হিড়িক পড়ে গিয়েছে গোটা জঙ্গলমহলে। সরাসরি আইনজীবীদের দ্বারস্থ হয়ে তারা আবেদন জানাচ্ছেন 'একবার জেলে পাঠিয়ে দিন'। একসময় মাওবাদী তকমা ঘোচাতে আইনজীবীদের দরজায় লম্বা লাইন পড়ত। আর এখন ঠিক উল্টো।

তৃণমূল আত্মসমর্পণকারী মাওবাদীদের জন্য সরকারি প্যাকেজ ঘোষণা করে। সেই প্যাকেজ অনুযায়ী কয়েকদিন আগে জঙ্গলমহল-সহ পশ্চিম মেদিনীপুর, বাঁকুড়া, পুরুলিয়ার ১১০ জন আত্মসমর্পণকারী মাওবাদী হোমগার্ডে চাকরি পেয়েছেন। পাশাপাশি অভিযোগ ওঠে যাঁরা প্রকৃত মাওবাদী, তাঁদের একাংশ এই সুবিধা পাননি। তাঁরা অনেকেই বিক্ষোভ দেখিয়েছেন।

এদিকে, কয়েকদিন ধরে মেদিনীপুর আদালতের পাশাপাশি জঙ্গলমহলের অন্যান্য আদালতগুলোতে ভিড় জমিয়েছেন যাঁরা আসলেই মাওবাদী নন, তাঁরাই। উদ্দেশ্য সরকারি চাকরি পাওয়া। জেলে ঢোকার কাতর আবেদন জানিয়ে আইনজীবীদের দরজায় কড়া নাড়ছেন তাঁরা। তার জন্য যে কোনও পরিমাণ অর্থ খরচে রাজি। যাঁদের আগেই জামিন হয়ে গিয়েছে এমন শিক্ষিত, স্বল্পশিক্ষিত অথবা অশিক্ষিত, মহিলা-পুরুষেরা মাওবাদী হওয়ার আশায় দিনরাত পড়ে থাকছেন আদালত চত্বরে।

জঙ্গলমহলে বিভিন্ন জায়গায় স্থানীয়রা দাবি জানাচ্ছেন, তাঁরাই মাওবাদী বলে অর্থাৎ যাঁরা চাকরি পেলেন, তাঁরা ভুয়ো মাওবাদী! বিভিন্ন এলাকায় রীতিমতো সভা করে নিজেকে মাওবাদী দাবি করছেন অনেকে। কেবলমাত্র সরকারি চাকরি ও প্যাকেজের জন্য মাওবাদীদের তালিকায় তাঁদের নাম ঢুকিয়ে দেওয়ার আবেদন করছেন তাঁরা। স্বাভাবিক ভাবে সমস্যায় পড়েছেন আইনজীবীরা। কীভাবে তাঁরা এই বেআইনি কাজ করবেন ভেবে পাচ্ছেন না।

মেদিনীপুর আদালতের আইনজীবী অপূর্ব চক্রবর্তী বলেন, ‘‌এমন আগে বহু কেস দেখেছি যেখানে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার পর জঙ্গলমহলের মানুষ আসতেন মাওবাদী তকমা ঘোচানোর জন্য। কিন্তু এখন মানুষ আসছেন মাওবাদী তালিকায় নাম নথিভুক্ত করার জন্য। বিশেষ করে যারা একসময় নিজেদের মামলা শেষ করার জন্য পিড়াপিড়ি করতেন, এখন তারাই মাওবাদী তালিকায় নিজেদের নাম নথিভুক্ত করার জন্য উপস্থিত হচ্ছেন।' তিনি জানান, তাঁরা শুধু আবেদন করছেন, ‘‌স্যার দয়া করে একবার জেলে পাঠিয়ে দিন।’‌ একই অভিজ্ঞতা অন্যান্য আইনজীবীদেরও।

নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পুরুলিয়া জেলার এক পুলিশ আধিকারিক জানান, পুলিশের ওপর অনেক চাপ আছে। অনেক লিখিত আবেদন পড়েছে যে সে মাওবাদী। এখন কে আসল মাওবাদী, তা খুঁজতে অবস্থা খারাপ হয়ে যাচ্ছে। পুলিশ সূত্রে জানা গিয়েছে, যাদের বিরুদ্ধে মাওবাদী মামলা রয়েছে অর্থাৎ রাষ্ট্রদ্রোহিতা, বিস্ফোরণ, খুনের মামলা রয়েছে, তাদের চাকরি দেওয়া হচ্ছে।

কিন্তু চাকরি পাওয়ার জন্য এখন এমন অনেকেই নিজেদের মাওবাদী বলছেন। তাঁদের দাবি, তাঁরা কেউ কেউ স্কোয়াড সদস্য, কেউ কেউ মাওবাদী লিংকম্যান ছিলেন। ফলে সমস্যা বাড়ছে পুলিশের। আসল সমস্যাটা অন্য জায়গায়। কাজ নেই, বেকারের সংখ্যা বাড়ছে। তাই এই সুযোগে নিজেদের চাকরি পাকা করতে মাওবাদী হওয়ার হিড়িক পড়েছে জঙ্গলমহলে।

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in