উপনির্বাচন মানেই শাসকদলের জয়। প্রায়শই এমনটাই হয়েছে এরাজ্য। কিন্তু সাগরদিঘিতে তার উল্টো হয়ে পরাজয়ের সম্মুখীন হতে হয়েছে শাসকদল তৃণমূল কংগ্রেসকে। শুধু তাই নয়, রাজ্যের প্রধান বিরোধী দল হিসাবে বিজেপির জামানত জব্দ হয়েছে এই কেন্দ্রে। কিন্তু, কেন এমন হল, তা নিয়ে চুলচেরা বিশ্লেষণ চলছে বিভিন্ন মহলে।
১) সাঘরদিঘির বিধায়ক ছিলেন সুব্রত সাহা। ২০১১ সাল থেকে টানা তিনবার এই কেন্দ্রে জিতেছেন তিনি। রাজ্যের খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ এবং উদ্যান পালন দফতরের স্বাধীন দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রীর দায়িত্বপালনও করেছেন। একসময় মুর্শিদাবাদ জেলার তৃণমূল কংগ্রেস সভাপতি ছিলেন। অর্থাৎ, এই সাগরদিঘি ছিল তৃণমূল কংগ্রেসের গড়। কিন্তু, ২০২২ সালের ২৯ ডিসেম্বর, সুব্রত সাহার মৃত্যুর সবকিছু পাল্টাতে শুরু করেছে। বিধানসভায় 'শূন্য' কংগ্রেসের কাছে হারতে হলো তৃণমূলকে।
২) গত ২১ জানুয়ারি, ইন্ডিয়ান সেকুলার ফ্রন্ট (ISF)-এর প্রতিষ্ঠা দিবসে বিধায়ক নওশাদ সিদ্দিকি ও ও তাঁর দলের বহু কর্মীকে গ্রেফতার করেছিল মমতা বন্দ্যপাধ্যায়ের প্রশাসন। 'মিথ্যা' মামলায় তাঁদের এক মাসেরও বেশি সময় ধরে জেলে আটকে রাখা হয়েছিল। এই ঘটনা ভালোভাবে নেয়নি রাজ্যের মানুষ। ঘটনাচক্রে, বৃহস্পতিবার ভোটগণনার মধ্যেই ৪০ দিন পরে কলকাতা হাই কোর্ট থেকে জামিন পেয়েছেন নওশাদ।
বিশেষজ্ঞদের একাংশ মনে করছেন, নওশাদের মতো একজন সংখ্যালঘু নেতাকে দীর্ঘদিন জেলে আটকে রাখার বিষয়টিকে ভাল চোখে দেখেননি সাগরদিঘির সংখ্যালঘু ভোটাররা।
৩) পরিসংখ্যান বলছে, সাগরদিঘির প্রায় ৬০ শতাংশ ভোটার সংখ্যালঘু। তফসিলি জাতির ভোটার রয়েছেন ১৮.৫ শতাংশ। আর তফসিলি উপজাতি ভোটার রয়েছেন ৬.৫ শতাংশ। কিন্তু, আনিস খানকে 'হত্যা' এবং তাঁর 'খুনিদের' শাস্তি না দেওয়া, রাজ্যের বিভিন্ন নিয়োগ ক্ষেত্রে দুর্নীতি, আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়কে 'অকেজো করে রাখার অপচেষ্টা' ভালোভাবে নেয়নি সাগরদিঘির সংখ্যালঘু ভোটাররা।
৪) তৃণমূলে থাকার সময় মুর্শিদাবাদে দলের দায়িত্বে ছিলেন শুভেন্দু অধিকারী। সেই সময় থেকেই তৃণমূলের উত্থান শুরু হয়েছিল সাগরদিঘিতে। পরে তিনি দল বদল করে গেরুয়া শিবিরে যোগ দিলে, সাগরদিঘি-সহ একাধিক জায়গায় এর প্রভাব পড়ে।
আবার, একাধিক তৃণমূল ও বিজেপি নেতাদের মধ্যে দলবদলের ফলে, অনেকেই বিজেপিকে এরাজ্যে তৃণমূলের-বি টিম ভাবতে শুরু করেছেন। সম্প্রতি, সেকথা বলেছেন বিজেপির চন্দ্র বসুও। ফলে, বিজেপির সঙ্গে তৃণমূলের আন্তঃসম্পর্কের কথা সামনে আসায়, সংখ্যালঘু ভোটব্যঙ্ক আবার বাম-কংগ্রেসের দিকে ঘুরতে শুরু করেছে।
রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা জানাচ্ছেন, মোটের উপর পঞ্চায়েত নির্বাচনের মুখে সাগরদিঘির ফলাফল তৃণমূলকে কার্যত আয়নার সামনে দাঁড় করিয়েছে। গোটা বাংলা জুড়ে তৃণমূল অপ্রতিরোধ্য - এই মিথটা ভেঙেছে। সংখ্যালঘু অধ্যুষিত সাগরদিঘিতে তৃণমূলের আসন হাতছাড়া হচ্ছে। এটা নিঃসন্দেহে বড় ইঙ্গিত।
উদাহরণ টেনে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, একই অবস্থা হয়েছিল বাম জমানায়। ১৯৯৮ সালের উপনির্বাচনে রাসবিহারী বিধানসভা কেন্দ্র থেকে জিতেছিলেন শোভনদেব চট্টোপাধ্যায়। 'শূন্য' থেকে তৃণমূল কংগ্রেসের একমাত্র বিধায়ক রাজ্য বিধানসভায় পা রেখেছিলেন। এসময় রাজ্যে বামেদের খুবই প্রভাব ছিল।
কিন্তু, সেই প্রভাব যে ক্ষয়িষ্ণু, সেই ইঙ্গিত সেদিনের উপনির্বাচনে মিলেছিল। আর, একটা উপনির্বাচন যে অনেক কিছুর ইঙ্গিত দেয়, সেটাও জানান দিয়েছিল সেদিন।
আবার সেই ঘটনার উলাটপুরান হয় কিনা, তা নিয়ে জল্পনা শুরু হয়েছে রাজ্যবাসী।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন