"আজ যে এই ২৫ হাজারের মত মানুষ, যারা শিক্ষকতা করছেন, যাদের অনেকেই শিক্ষক হবার যোগ্য। যারা নিজেদের যোগ্যতায় চাকরি পেয়েছেন বা পেতেন। কিন্তু তাদের সকলের চাকরি গেল কেন? কারণ স্কুল সার্ভিস কমিশন সমস্ত অন্যায়টা করেছে শিক্ষাদপ্তরের নির্দেশ, মুখ্যমন্ত্রীর নির্দেশনায়। আসলে এই সরকার যা নিয়োগ করেছে সব দুর্নীতি করেই করেছে।" সোমবার মুর্শিদাবাদ জেলা সিপিআইএম অফিসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে একথা বলেন দলের রাজ্য সম্পাদক মহম্মদ সেলিম। এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি প্রসঙ্গে কলকাতা হাইকোর্টের রায়ে প্রায় ২৬ হাজার জনের চাকরি বাতিলের নির্দেশ আসার পর এদিন মহম্মদ সেলিম একথা বলেন।
তিনি আরও বলেন, "এই পরিকল্পনা করা হয়েছে নবান্ন থেকে এবং কালীঘাট থেকে। রূপায়িত করা হয়েছে তৃণমূলের দপ্তর থেকে। আমি একই সঙ্গে মুখ্যমন্ত্রীর দিকেও অভিযোগের আঙুল তুলছি। পার্থ চ্যাটার্জি বলেছেন মুখ্যমন্ত্রীর কাছ থেকে লিস্ট আসতো, ভাইপোর কাছ থেকে লিস্ট আসতো। এখন ভাইপো পিসির বাঁচার জন্য এদের চাকরি গেল। যারা যোগ্য প্রার্থী ছিল, ঠিকমত প্যানেল করা হয়েছিল এসএসসি লিস্ট জমা করলে তাদের তো চাকরি যেত না। কিন্তু সে কাজ করা হয়নি।"
এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন - এই রায় সুদূরপ্রসারী। আমার সবচেয়ে দুঃখ যে আমাদের দেশের মানুষ চাকরির জন্য হন্যে হয়ে ঘুরছে, চাকরি পাচ্ছে না। বেকারি সর্বোচ্চ। সেইসময় পুলিশে, সেনাবাহিনীতে, শিক্ষকতায় কিছু নিয়োগ হয়। কিন্তু সে সব নিয়োগও হচ্ছে না। যেটুকু নিয়োগ হচ্ছে তাতেও দুর্নীতি হচ্ছে। দীর্ঘদিন ধরে বঞ্চিত এই চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলনে আমরা তাদের পাশে ছিলাম। আমরা কোনও রাজনৈতিক দলের ঝান্ডা নিয়ে সেখানে যাইনি।
মুখ্যমন্ত্রীকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে এদিন সিপিআইএম পলিটব্যুরো সদস্য বলেন - মুখ্যমন্ত্রী এদের বারবার স্তোকবাক্য দিয়েছেন বা এমন কমিটি করেছিলেন যে সেই কমিটির সদস্যরা এখন জেলে। তিনি চাকরিপ্রার্থীদের আন্দোলন ভাঙার চেষ্টা করেছেন। মুখ্যমন্ত্রী এলাকা ধরে ধরে কোটা দিয়ে দিয়েছিলেন। তারা নিয়োগ করেছে। তিনি নিজে বলেছেন শুভেন্দুকে বিভিন্ন জেলার দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সে সব পূর্ব মেদিনীপুরে দিয়ে দিয়েছে।
এদিন সেলিম জানান - আজকের রায়ে প্রথম কথা হয়েছে মামলার রায়ের সুযোগে নিয়োগ বন্ধ করা যাবে না। অথচ মুখ্যমন্ত্রী বছরের পর বছর নিয়োগ বন্ধ করে রেখেছেন। কারণ সরকার চায়নি। সরকার যা নিয়োগ করেছে সব দুর্নীতি করে করেছে।
রাজ্যের শাসকদলকে আক্রমণ করে এদিন মুর্শিদাবাদ লোকসভা কেন্দ্রের সিপিআইএম প্রার্থী বলেন - সরকার সবসময় প্রমাণ লোপাট করতে চাইছে। বিধায়কের ফোন জলে পড়ে গেছিল এখানেই। হাইকোর্ট বারবার বলেছিল, যত লোকের চাকরি পাবার কথা তার চেয়ে বেশি লোক চাকরি করছে। আপানার স্মস্য তথ্য দিন। এসএসসি তা দিতে পারেনি। তারপর অযোগ্য লোকেদের নাম চাওয়া হয়েছিল। তাও দেওয়া হয়নি।
তিনি আরও বলেন, যাদের যাদের চাকরি হয়েছে তাদের চেয়ে দশগুণ বেশি লোক টাকা দিয়েছে, যাদের চাকরি হয়নি। তাদেরকে বলছি, তৃণমূলের নেতাদের নামে এফআইআর করুন, নাম প্রকাশ করুন, আমাদের দিন। তাদের ঘর ঘেরাও করুন। টাকা আদায় করতে হবে। যে শিক্ষকরা নিজ যোগ্যতায় চাকরি করেছেন তাঁরা কেন টাকা ফেরত দেবেন? যারা চাকরি সরকার শ্বেতপত্র প্রকাশ কুরক। মুখ্যমন্ত্রীর কাছে হোয়াইট লাই ছাড়া আর কিছু হোয়াইট নেই, সব ব্ল্যাক।
মুখ্যমন্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে সিপিআইএম রাজ্য সম্পাদক এদিন বলেন, সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত মমতা গেছেন তদন্ত আটকানোর জন্য। বেআইনি নিয়োগকে মান্যতা দেবার জন্য। আদালতকে পদে পদে বাধা দেওয়া হয়েছে। নিয়োগকে স্থগিত করে রাখা হয়েছে। আমরা স্বচ্ছতার সঙ্গে দ্রুত নিয়োগের দাবি করছি। হাইকোর্টকেই দরকার হলে এই টিম তৈরি করে দিতে হবে। দুর্নীতিগ্রস্তদের মমতা ব্যানার্জি বাঁচাতে পারবেন না।
তিনি বলেন, ওএমআর শিট নেই, চাকরির পরীক্ষা দেয়নি এমন লোক বিডিও হয়ে আছে। যাদের বেআইনি পথে চাকরি হয়েছে তাঁরা তো প্রিসাইডিং অফিসার হয়েছে, পঞ্চায়েতে ভোট লুঠ করেছে। এঁরা যাদের এমএলএ এমপি করেছে তাঁরাও তো বেআইনি ভাবেই হয়েছে। এই ধরণের অযোগ্য লোকরা মমতা ব্যানার্জিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। তার সুনজরে থাকতে চেয়েছে। তাদের কাছে আজ স্পষ্ট বার্তা যাওয়া উচিত যে মমতা ব্যানার্জি বাঁচাতে পারবে না।
রাজ্যের শিক্ষক সমাজের কাছে ক্ষমা চেয়ে নিয়ে এদিন মহম্মদ সেলিম বলেন, আমাদের দেশের, রাজ্যের শিক্ষা ব্যবস্থাকে বাঁচাতে হবে। আজ মুখ্যমন্ত্রীর জন্য শিক্ষকদের মান মর্যাদা নষ্ট হয়েছে। আমি সমস্ত শিক্ষকদের কাছে ক্ষমাপ্রার্থী।
এদিন তিনি দাবি করেন, ভাইপো এবং পিসিকে গ্রেপ্তার করে সব টাকা উদ্ধার করতে হবে। কোনও সেটিং চলবে না। পার্থ বলেছে ২৫% আছে। তাহলে বাকি ৭৫% তো পিসি ভাইপোর কাছে আছে। কেউ রেহাই পেলে চলবে না। আইন অনুযায়ী যাদের এটা দেখার কথা, তাদের উপযুক্ত সময়ে এগুলো দেখা উচিত ছিল। তাঁরা সেগুলো দেখেননি। তাদের বিরুদ্ধে সংবিধান অবমাননা করার অভিযোগে শাস্তি হওয়া উচিত। যাদের জন্য এটা হয়েছে তাদের সরাতে হবে। কান ধরে, টেনে হিঁচড়ে তাদের নিচে নামাতে হবে। তাহলেই শিক্ষা বাঁচবে, স্কুল বাঁচবে, ছাত্র ছাত্রী শিক্ষক সবাই বাঁচবে।
তিনি আরও বলেন, ২৫ হাজার শিক্ষক মানে একটা পরিবারে ৫ জন করে থাকলে প্রায় ১ লক্ষ ২৫ হাজার মানুষ হয়। মমতা ব্যানার্জির অপদার্থতা, লোভের কারণে আজ এই অবস্থা হল। সমস্ত আইনি ব্যবস্থাকে ধ্বংস করার এই প্রবণতা ভয়ংকর।
উল্লেখ্য, এদিনই কলকাতা হাইকোর্ট এসএসসি নিয়োগ দুর্নীতি মামলায় ২০১৬ সালের সমস্ত নিয়োগ বাতিলের নির্দেশ দিয়েছে। এছাড়াও মেয়াদ উত্তীর্ণ হয়ে যাবার পর যাদের চাকরি হয়েছে তাদের সকলকে প্রাপ্ত বেতন ১২% সুদ সহ ফেরত দেবার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। আগামী চার সপ্তাহের মধ্যে এই টাকা ফেরত দিতে হবে বলে জানিয়েছে আদালত।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন