আমরা যারা নিজেদের বাঙালি বলে দাবি করে থাকি তাদের কাছে অন্তত বাঙালি সংস্কৃতি এখনও প্রাসঙ্গিক। স্রোতমান নদীর মতো চলমান। শাসনের নামে শস্যগর্ভা এই ভূখণ্ড কত রকমের দস্যুদের লুটের শিকার হয়েছিল, সেই ইতিহাসের দিকে এখন আর তাকাই না। বাঙালির সংস্কৃতির ইতিহাসের দিকে তাকাতে এখনো সাহস পাই। অজস্র লুষ্ঠন ও বিদেশি সংস্কৃতির সঙ্গমে, শাসনে-শোষণেও বাঙালি সংস্কৃতি বেঁচে আছে। খুব সবলভাবে বেঁচে আছে তা বলা যাবে না। বাংলা নববর্ষের মতো খুবজোর আর একটা দুইটা উপলক্ষ পাওয়া যাবে, যা কোনমতেই বিস্মৃত হতে দেবে না যে, আমরা বাঙালি। কালের পোকামাকড়ে খাবলে খাওয়া, ক্ষত-বিক্ষত, দ্বিধাবিভক্ত বাঙালি সংস্কৃতি মুমূর্ষু রোগীর মতো গোঙাতে গোঙাতে এখনও টিকে আছে - এই সত্য অস্বীকার করা যাবে না। করছিও না। তবে, এই বাস্তবটিকেও স্বীকার করে নিতে হচ্ছে যে, ঘর-গৃহস্থি থেকে জীবন-বিন্যাসের কোন পর্যায়েই আমরা আর বাঙালি সংস্কৃতিকে চাই না। অবশ্য কতজন বাঙালি থাকতে চাই - এটিও দেখবার বিষয়।
কি অতীতে, কি বর্তমানে চিরদিনই বাঙালির সংস্কৃতি বাংলার শাসকগোষ্ঠীর শোষণের অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার হয়েছে। শুধু তুর্কি-মোঘল-পাঠানরাই নয়, শস্যের স্বর্গভূমি বাংলায় যারাই শাসক ছিলেন, তারাই প্রয়োগ করেছেন একটি করে নতুন সংস্কৃতি, কাটাকাটি করে নিজেদের সুবিধামত ব্যবহার করেছেন বাঙালির সংস্কৃতিকে। বাঙালি সংস্কৃতির এই দুঃখের ইতিহাস মঙ্গলকাব্যের ‘বারোমাস্যা’র মতোই চিরকাল লেগে আছে। বাংলা ভাষা ও বাঙালির সংস্কৃতি কী কারণে পাকিস্তানিদের চোখের বালি হয়েছিল, তারও খতিয়ান পাই অতীতের ইতিহাসে। ইংরেজ শাসনের দুশো বছরে দেখা গেল, এবার বাঙালির রক্ত ফিল্টার করে সেখানে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে ইংরেজি সংস্কৃতি। “রক্তে ও রঙে ভারতীয়, আর রুচিতে, মতে, নীতিতে ও বুদ্ধিতে ইংরেজ”_- এমন কৌশলী নীতির সুফল যে কী পরিমাণে ফলেছে তারই প্রমাণ পাচ্ছি এখন বাঙালির ঘরে ঘরে, জীবনযাপনের প্রণালীতে। রক্তে-রঙে ভারতীয় বা বাঙালি থাকলেও আমরা আসলে কী পরিমাণে বাঙালি আছি কিংবা আদৌ কিছু অবশিষ্ট আছে কি না, নাকি সবটাই হারাতে বসেছি, এই প্রশ্নই উঠে আসছে। হাসান আজিজুল হক এই রকম একটি প্রশ্ন তুলেছেন - আমাদের সংস্কৃতি কী হবে? কেন এবং কোন যুক্তিতে তার একটি স্বল্পদৈর্ঘ্য ব্যাখ্যাও দিয়েছেন এই ভাবুক কথক। সন্দেহ নেই, বাঙালি সংস্কৃতির পেছনের ইতিহাস, আর চালু বাস্তবতার বৈপরীত্য ও সাংঘর্ষিকতার দিকে তাকিয়ে এই প্রশ্নের জন্ম। ভাবতে হচ্ছে এখন। ভাবতে হচ্ছে, বাঙালি সংস্কৃতির কত অংশ বাঙালির আছে। ভাবতে হচ্ছে, আর কতদিন বাঙালি থাকা যাবে। ব্রিটেনের একজন নাগরিককে প্রশ্ন করলে সে বলবে, আমি ব্রিটিশ, ফ্রান্সের নাগরিক বলবে, ফরাসি। আমাদের কাউকে প্রশ্ন করলে একদল বলবে বাঙালি, আর কেউ বলবে বাংলাদেশি, যাদের গ্রিনকার্ড জুটে গেছে বা জুটানোর চেষ্টায় আছে, ইংরেজি শিখে নিজেকে ফিট করছে বাঙালীত্বের গন্ধ শরীর থেকে মুছে ফেলতে, তারা বিড়ালের মতো মুখ মুছে বলে দেবে, আমি বাঙালি বা বাংলাদেশি তো নই-ই, কোনোকালে ছিলাম সেটিও এখন আর মনে করতে চাই না। অদ্ভুত এক আত্মবৈপরীত্যের রোগে রোগাক্রান্ত জাতি।
কত হাজার বছর অতিক্রম করে এসেছে বাঙালির সংস্কৃতি_- সেই নৃতাত্ত্বিক হিসাব দেবার সামর্ঘ্য আমার নেই। সেই হিসাব নৃতাত্ত্বিকরাই করবেন। অন্তত, দুই হাজার বছরের সচিত্র জীবনপ্রণালি তো বাঙালির আছে, এই হিসাব পেতে খুব বেশিদূর যেতেও হয় না। সংস্কৃতি মানেই বেঁচে থাকা, বেঁচে থাকার ইতিহাস। দুই হাজার বছরের বেঁচে থাকার ইতিহাস আছে বাঙালির, তার অর্থ বাঙালির সংস্কৃতি আছে। সংস্কৃতি আছে অর্থ একটি সার্বভৌম আত্মপরিচয় আছে। দাঁড়াবার মতো নিজের একটি জায়গা আছে। তবে ভাবতে হচ্ছে কেন, আমাদের সংস্কৃতি কী হবে?
বাঙালি সংস্কৃতির ট্রাজেডি বহু রকমের। একে তো বাঙালি তার শরীরে বইছে বারোয়ারি রক্ত, তার উপরে চেপেছে ভিন্ন জাতিগোষ্ঠীর রকমারি সংস্কৃতি। আর্-অনার্ষের বিতর্কে না গিয়ে সম্রাট অশোকের শাসনকালকেও যদি ভিত্তি হিসেবে ধরে নেই, তাহলে দেখা যাবে বাঙালির সংস্কৃতিকে ধোলাই বা গাড়াপিটার ইতিহাস বহুকালের। বৌদ্ধ-হিন্দু-মুসলিম শাসনে বাঙালি সংস্কৃতি গ্রহণ-বর্জনের মধ্য দিয়ে হেঁটেছে। মূলচ্যুতি ঘটেনি বটে, কিন্তু সাংস্কৃতিক পরাধীনতার গ্লানি ও নিপীড়ন সয়েছে অসহ্য রকমের। বিস্ময়কর বাস্তব হল, ধর্ম-সম্প্রাদায় নির্বিশেষে সাধারণের জীবন প্রণালীতেও তেমন ছেদ পড়েনি। ভাষা ও পণ্যোৎপাদন প্রণালীর অভিন্নতা তো আছেই, নারী-পুরুষের পোষাক পরিচ্ছেদ, অলংকার, প্রসাধনের তেমন হেরফের ঘটেনি। এমন কি বিদেশি ও ভিনধর্মী মুসলমান জাতিগোষ্ঠী, যারা সম্পূর্ণ ভিন্ন একটি সংস্কৃতির ধারক ও বাহক, বাঙালির উদার সংস্কৃতি খুব সহজেই আত্মস্থ করে নিয়ে সামনে এগিয়েছে। মুসলমানরা স্থায়ী আবাস হিসেবে বাংলাকে বেছে নিলে বাঙালি সংস্কৃতির পরিধি, গ্রহণযোগ্যতা ও অনুশীলন বেড়ে যায়। বিশেষত, স্বাধীন সুলতানি আমলে (১৩৩৮-১৫৩৮) বাঙালি সংক্কৃতি, বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের অবিশ্বাস্য রকমের বিকাশ ও পরিপুষ্টি বাঙালি মুসলমানদেরকে পরিপূর্ণ বাঙালি হিসেবে প্রতিষ্ঠা দিয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতি এই দুই প্রধান ধারা স্রোতমান নদীর মতোই এক হয়ে একটি মহাসমুন্রে এসে দাঁড়িয়েছে। বাঙালির সংস্কৃতির উত্তরাধিকার তার চৌহদ্দির জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সকলের। কেন আর এই প্রশ্ন, বাঙালির সংস্কৃতি কী হবে?
এই সত্য মেনে নিতে হবে যে, এই প্রশ্ন ইংরেজ শাসনের ডিভাইভ এন্ড রুলস পলিসি থেকে সৃষ্ট। বিকৃত মস্তিস্ক হতে জন্ম দুই বিকলাঙ্গ রাষ্ট্র ভারত-পাকিস্তান বিভক্তির পরেই বাঙালির সংস্কৃতি বিকলাঙ্গতার রোগে আক্রান্ত। বাঙালি সংস্কৃতিকে ধর্মের পেটে ঢুকিয়ে ফেলার সব পথ খোলাসা করে দিয়ে গেছে তারাই। বাংলা ভাষা চলবে না, রবীন্দ্র-নজরুল সঙ্গীতে ছুঁতমার্গ ইত্যাদি ফতোয়ার মুখে পড়ে বাঙালি সংস্কৃতি। কিন্তু বাঙালি সংস্কৃতির শরীরে যে এত শক্তি জমে আছে, তার হদিস খোদ বাঙালিদেরই জানা ছিল না, যা দেখা গেল মুক্তিযুদ্ধে। বাঙালির জানা ছিল না এ কারণে যে, বাঙালি হাজার বছরের অধিক সময় ধরে নিজের ভাষা ও জাতিসত্তার স্বাতন্ত্যকে বিপ্লবের মুখোমুখি দাঁড় করাতে সাহস পায় নি। পলাশি যুদ্ধের কথা ভাবলে ভীবণ লজ্জা পাই, তবু না বলে পারা যাচ্ছে না, আমাদের পঞ্চাশ হাজার পদাতিক ও আঠারো হাজার অশ্বারোহী বাহিনী হেরে গেল ইংরেজের তিনহাজার সৈন্যের কাছে; ইংরেজের মরল মাত্র ২২ জন, আমাদের শতে শতে৷ ইংরেজের সেই তিনহাজার সৈন্যের মধ্যে দুই হাজার একশো জন ছিল বাঙালি বা ভারতীয়।
ধরে নেওয়া হয়েছিল, মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে প্রাপ্ত স্বাধীন বাংলাদেশে বাঙালি সংস্কৃতি এবার রাহুমুক্ত হবে। বাঙালির শ্রেষ্ঠতম এই প্রাপ্তিটাকে পেতে কত বড় ও ভয়ানক ক্ষতিটাকেই না মেনে নিতে হয়েছে। বাঙালির একাংশের হলেও একটি স্বাধীন দেশ, একটি মানচিত্র, সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার নিরঙ্কুশ স্বীকৃতি জুটেছে, রাষ্ট্র হবে ধর্মনিরপেক্ষ, সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক মুক্তি আসবে; এসব মিলিয়ে একটি স্বয়ম্ভূ বাঙালি সংস্কৃতি হবে। দুর্ভাগা বাঙালি ও তার সংস্কৃতির জন্য এমন সুখের দিন কল্পনা করা গেছিল কি? এখন কেন প্রশ্ন ওঠে, বাঙালির সংস্কৃতি কী হবে? কেন এমন অশনিসংকেত? এর চেয়ে ভয়ানক আতঙ্কের কী হতে পারে? স্বাধীনতা উত্তর বাস্তবতা কি এই প্রশ্নের আড়ালের বাস্তবতা!
বলতে দ্বিধা নেই, বাংলাদেশ নামক যে রাষ্ট্রটি আমরা পেলাম তা কী চেহারা নিয়ে জন্মালো এবং কীভাবে বেড়ে উঠবে তার কোনটাই ঠিক করা হয়নি। রাষ্ট্র কি গণতান্ত্রিক হবে, ধর্মনিরপেক্ষ যুক্তরাষ্ট্রীয় হবে, না সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র হবে_ কোনটাই সুরাহা করে জাতির সামনে আনা হল না। ফলে পুরো জাতি থেকে গেল আত্মপরিচয়ে হাজার বছরের পুরনো সেই দ্বিধায় - আসলে সে কতটা বাঙালি আর কতটা হিন্দু বা মুসলমান। রাষ্ট্র তাকে কী হিসেবে দেখছে। চরম দ্বিধাপীড়িত বাঙালির একটা বড় অংশ স্বাধীনতাটাকে সেই পুরনো মদে নতুন বোতলজাত বলে ধরে নিল। তৈরি করার সুযোগে সতেজ, সবল ও সুসংগঠিত হয়ে ওঠে ধর্মান্ধ ও স্বাধীনতা বিরোধী পরাজিত শক্তি। খুব অল্পদিনের মধ্যে রাষ্ট্রের স্থপতিকে সপরিবারে খুন করে তাদের পথ মসৃণ করে নিল। জন্মের কিছুদিনের মধ্যে সংবিধানকে ফের আঁতুর ঘরে নিয়ে পুনর্জন্মের ব্যবস্থা করে নিজেদের সুবিধামত করে নিল। বাঙালিকে রাতারাতি বাংলাদেশি করে পোশাক পাল্টিয়ে সংবিধান পাল্টিয়ে ফেলে ধর্মাশ্রয়ী করে দিল রাষ্ট্রকে। আমাদের সুখ-স্বপ্ন, দেখভালের দায়িত নিল তারাই, যারা গণতন্ত্রকে পতিতার মতো ব্যবহার করে চরম স্বৈরতন্ত্র চালু করে রেখেছে শত শত বছর ধরে।
ব্রিটিশরা চাতুর্ষের সাথে অখণ্ড বাঙালিকে দুই খণ্ড করে গেছে। আর আমাদের কর্নেলরা বন্দুকের নলা দিয়ে রাষ্ট্র ও জাতিকে বিছিন্ন করে কায়েমী স্বার্থবাদী একটি বিশেষ শ্রেণি সৃষ্টি করেছে, যারা এখন রাষ্ট্রের নিয়ামক শক্তি। ফলে বাঙালি নিজভূমে এখন আর পরবাসী না হলেও দ্বিতীয় শ্রেণির নাগরিক। রাষ্ট্র জনগণের হয়নি, জনগণের স্বার্থ দেখে না, জনগণের সাথে রাষ্ট্রের ও নিয়ামক শক্তির আচরণ দমনমূলক। এদিকে আমেরিকার প্রেমে এতটাই রাধা দেওয়ানা, বাঁশিও বাজাতে হয় না, কারণে-অকারণে সব দিতে প্রস্তত। আমেরিকার করতলে বলির পাঁঠার মতো মাথা দিয়ে রেখেছে। আমার ঘর-গৃহস্তির মাতব্বরিও এখন আমেরিকার হাতে। আমাদের ভালমন্দ দেখভালের দায়-দায়িত্ব নিয়েছে তারাই।
স্বাধীনতার পরের দুই দশক গণতন্ত্রকে সেনাব্যারাকে উপর্যুপরি ধর্ষণের পরেও একদিন সত্যি গণতন্ত্র আসবে, সেই সুখস্বপ্নে দিন কেটে যাচ্ছিল। নব্বই-এ স্বৈরতন্ত্রের পতনের মধ্য দিয়ে গণতন্ত্র যে চেহারা নিয়ে আবির্ভাব ঘটেছে, মানুষ যেভাবে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে, সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখলেও এর চেয়ে বেশি ভয় পেত না। আর আমাদের রাজনীতির রয়েল বেঙ্গল টাইগাররা এমনি ভয়ার্ত পরিস্থিতি সৃষ্টি করে ফেলেছে যে, রাজনীতি এখন রীতিমত একটি দাঁতাল বিষধর সাপ। সামনে যেতেই ভয় হয়। মানুষ রীতিমত পালিয়ে বেড়ায়। সাপের মাথার মণির মতো ক্ষমতার মণি একবার পেলে কিছুতেই খোয়াতে চায় না। আত্মঘাতি রাজনীতির বিপন্নতার ভাইরাসে আক্রান্ত আমরা। স্বাধীনতাবিরোধী, দেশবিরোধী, বাঙালিবিরোধী শক্তির জোট আর স্বাধীনতার পক্ষের শক্তির জোট এখন সম্মুখ সমরে যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। চাপাবাজি আর ভোজবাজি, লুটবাজি আর জোরবাজি চলছে, সাথে চলছে নাকচ আর পাল্টা নাকচের টকশো। স্যাটেলাইট চ্যানেলের সুবাদে সেই টকশোর সাথে জড়িয়ে যাচ্ছে উঠতি মধ্যবিত্ত শিক্ষিতশ্রেণি। রাজনীতি পেটে ঢুকে বদহজম হয়ে বিষাক্ত বর্জ্য হয়ে বেরুচ্ছে আমাদের শিক্ষা, সমাজ, সংস্কৃতি, অর্থনীতির সব অর্জন।
চরম বিশৃঙ্খলা ও অস্থিরতার মধ্য দিয়ে চলেছে বাঙালি সংস্কৃতি। এই বাস্তবতায়, বাঙালির একটি বড় অংশ বিশ্বসংস্কৃতির ভোক্তা হয়ে বাঙালি সংস্কৃতিকে ভাবছে নিতান্তই পচনশীল ও পরিত্যাজ্য। নির্মাণহীন, সংস্কৃতিবিবর্জিত একটি ধনিক অজগরশ্রেণি সৃষ্টি হয়ে গেছে চার দশকে। বাংলাদেশের আলো-বাতাস চরম বিবাক্ত লাগে তাদের। অক্ষমভাবে হলেও শিক্ষাব্যবস্থার বিপুল বিস্তারে সার্টিফিকেটধারী কিছু শিক্ষিত পেয়েছি, পাশাপাশি পেয়েছি রাষ্ট্রের প্রত্যক্ষ মদদে সৃষ্ট একটি উচ্চাভিলাসী মধ্যবিত্ত শ্রেণি। তারা নিজেরা দারুণ সংকটে। না ঘরকা না ঘটকা। মানতে পারছে না বাঙালি সংস্কৃতিকে, অন্যদিকে টিকেটও পাচ্ছে না আমেরিকা-ব্রিটেনের। ফলে দেশে যখন থাকতেই হবে, দেশটাকেই লন্ডন-নিউইয়র্ক বানাও। চাইনিজ, ফাস্টফুড, বিউটিপার্লার, ইংলিশ মিডিয়াম স্কুল-কলেজ-ভার্সিটি বানিয়ে এখানেই প্রডাক্ট করো আমেরিকা-ব্রিটেনের নাগরিক, এজন্য বাঙালির সমাজ, সংস্কার, বিশ্বাস, সোজাকথায় বাঙীলিত্বকে যত পারো ভাগাড়ে ফেলে আসো। এই কাজে রাষ্ট্রের উদারহস্তের বাহবা তো আছেই। ঘোল দিয়ে দইয়ের সাধ মেটানোর জন্য বাঙালিয়ানাকে ছাট দিয়ে কোনোমতো ঠাঁট বজায় রেখে আর কতকাল চলা যায় এভাবে! কিছুটা আফসোসেরই কথা। মধ্যযুগের কবি আব্দুল হাকিম তাদের বেজন্মা বলে দেশত্যাগের পরামর্শ দিয়েছিলেন, এইকালে হলে কী করতেন? পারতেন বলে মনে হয় না। যেখানে রাষ্ট্রই চাচ্ছে এবং রাষ্ট্রের সরাসরি মদদে সবই হচ্ছে।
বাঙালির রাষ্ট্র দীর্ঘকাল পরাধীনতার যুপকা্ঠে বন্দি থাকলেও সাংস্কৃতিক দৈন্য এমন চরমে ছিল না। এখন সাংস্কৃতিক পরাধীনতা চলছে, পশ্চিমা সংস্কৃতি ও প্রতিবেশি হিন্দি সংস্কৃতির কৃষ্ণতরূপে বিমুগ্ধ তরুণ প্রজন্ম হালে, চালে, আচারে-ব্যবহারে, পোষাক-পরিচ্ছদে, চলনে-বলনে, জীবনদৃষ্টিতে ক্রমশ পরনির্ভর, পরমুখাপেক্ষী ও বিদেশি নাগরিক হয়ে যাচ্ছে। ফলে সামাজিক দ্বন্দ্বও এখন চরমে। দেশে জন্ম নিলেই দেশ কারও আপন হয় না। স্বাধীনতা উত্তর গজিয়ে ওঠা নতুন প্রজন্ম দেশে জন্ম নিয়েছে বটে, দেশকে নিজের করে ভাবতে দেওয়া হয়নি বা হবে না। পথে-ঘাটে, শহরে-বাজারে, এমনকি মধ্যবিত্তের বাড়িতে যাদের দেখি, মনে হয় বিদেশ থেকে আগত এরা। এরা যে আসলে বাংলাদেশের নাগরিক এমনটা মনে হয় না, মনে হয় ভিন গ্রহ থেকে বেড়াতে এসেছে। এভাবেই একটি নববিকৃতি লালন করে আসছে মধ্যবিত্তের একটি বড় অংশ। চরম উচ্ছঙ্খল, নির্মাণহীন, মনুষ্যত্বহীন, গলায় পাশ্চাত্যের দড়ি বাঁধা, করোটিতে পাশ্চাত্যের ব্লু-পিকচার নিয়ে একটি বিকৃত রুচিসম্পন্ন প্রজন্মের বিস্তার কী পরিমাণে বেড়েছে, তা দেখা যায় ব্যান্ডসঙ্গীত, রকসঙ্গীত, ইংরেজি নববর্ষ, পার্কে, পথে, ঘরে। এই প্রজন্মের হাতেই বাঙালির জাতিসত্তার ভূত-ভবিষ্যত বা রক্ষাকবচ!
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন