১৯৮০-এর দশক। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে রোনাল্ড রেগানের ক্ষমতালাভ বিশ্বজুড়ে মার্কিন হস্তক্ষেপের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে বহুগুণ। আফগানিস্তানে সাউর বিপ্লব থেকে নিকারাগুয়ার সান্দানিস্তা বিপ্লব - মার্কিন বিরোধী সরকার মাত্রই তাকে উৎখাত করতে বদ্ধপরিকর রোনাল্ড রেগানের সরকার। সেই মর্মে সীমাহীন অর্থ ও অস্ত্রের সাহায্য করা হচ্ছে তালিবান থেকে কনট্রা - এই সরকারগুলির বিরোধী শক্তিগুলিকে। বলাই বাহুল্য, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে এই সরকারগুলির সম্পর্ক ঠেকেছে তলানিতে। এর মধ্যেই সকলকে অবাক করে ১৯৮৫ সালে নিকারাগুয়ার বিপ্লবের সপ্তম বর্ষপূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আমন্ত্রিত হলেন এক মার্কিন রাজনীতিবিদ।
নিছক যে সে রাজনীতিবিদ না, তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি রাজ্যের রাজধানীর মেয়র। তিনি এলেন, শত শত জনতার কোলাহলের মধ্যে অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকলেন, দেখা করলেন রাষ্ট্রপতি ড্যানিয়েল ওর্টেগা থেকে বিরোধী দলের নেতা, রাজধানী মানাগুয়ার বস্তিবাসী থেকে স্থানীয় ব্যবসায়ী, এমনকি প্রবাদ প্রতিম বিপ্লবী নেতা ফাদার ম্যানুয়েল ডি'এস্কোটার সঙ্গেও। দেখাসাক্ষাৎ করার পর তিনি ঘোষণা করলেন এরপর থেকে তাঁর শহর ও নিকারাগুয়ার শহর পুয়ের্তো ক্যাবেজা সহোদরা-শহর বা সিস্টার সিটি হিসেবে গণ্য হবে। নিকারাগুয়ায় মার্কিন হস্তক্ষেপ নিয়ে তাঁর মনোভাব নিয়ে কোন রাখঢাক করলেন না এই মেয়র - ‘I will never forget that in the front row of the huge crowd were dozens and dozens of amputees in wheelchairs—young soldiers, many of them in their teens, who had lost their legs in a war foisted on them and financed by the U.S. government.’ তৎকালীন ঠাণ্ডা লড়াইয়ের প্রেক্ষিতে নিজের দেশের সরকারের বিরুদ্ধে এই কঠোর অবস্থান গ্রহণ কোন নামজাদা সেনেটার, হাউজ রিপ্রেজেন্টেটিভ বা গভর্নরের পক্ষে ছিল রাজনৈতিক আত্মহত্যার সমান। সেখানে একটি শহরের মেয়র - তাও নির্দল - তাঁর পক্ষে এই মন্তব্য করা কী পরিমাণ সাহসের বিষয় ছিল - তা কল্পনারও অতীত। কিন্তু এও সত্যি, অসীম সাহস ও নিজের আদর্শের প্রতি দায়বদ্ধতাই ছিল গণতান্ত্রিক সমাজবাদী বলে নিজেকে পরিচয় দেওয়া এই মেয়রের বৈশিষ্ট্য। তিনি - বার্নাড স্যান্ডার্স, যাকে বার্নি নামেই তাঁর বন্ধু ও শত্রুরা ভালো চেনেন।
বার্নাড স্যান্ডার্সের জন্ম ১৯৪১ সালের ৮ই সেপ্টেম্বর - নিউইয়র্কের ব্রুকলিনে এক ইহুদি নিম্নবিত্ত পরিবারে। তাঁর বাবা ইলিয়াস বেন স্যান্ডার্স রঙের সেলসম্যান হিসেবে যা রোজগার করতেন তাতে সংসার চালাতে হত টেনেটুনে। বার্নি ও তার দাদা ল্যারির মা ডরোথি ছোটবেলা থেকেই ছেলেদের শিক্ষা দিয়েছিলেন মিতব্যয়িতার। বার্নি স্মৃতিচারণা করেছেন, একবার শখ করে পাইকারি বাজার থেকে না কিনে স্থানীয় দোকান থেকে জিনিস কেনার জন্য মায়ের কাছে তিনি কিরকম বকা খেয়েছিলেন। কিন্তু অন্য বিষ্যয়ে মিতব্যায়ী হলেও বার্নির বাবা ও মা যখন পাড়ার কারোর কিছু প্রয়োজন হত - সাহায্যে ঝাঁপিয়ে পড়তে কোনদিন কার্পণ্য করেননি। এর মধ্যেই ছেলেদের তাঁরা একটা গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা দিয়েছিলেন - মানুষ একা কিছু নয়, সমাজের মধ্যে, সকলের মধ্যেই তার সার্থকতা। বলা যেতে পারে এই চেতনাই ছিল বার্নির রাজনীতির ভিত্তি।
তবে রাজনীতি সচেতন হলেও কৈশোরে রাজনীতির দিকে বার্নির ততটা নজর ছিল না। বরং এই বিষয়ে দাদা ল্যারি তাঁর থেকে অনেক এগিয়ে ছিল। বার্নির ঝোঁক ছিল খেলাধুলোর দিকে। ট্র্যাক রেসিং-এ তিনি রাজ্যস্তরেও প্রতিযোগিতায় সাফল্য অর্জন করেছিলেন। হাইস্কুল পাশ করার কিছু দিনের মধ্যেই তাঁর বাবা ও মা দুজনেই গত হন। ১৯৬৪ সালে বার্নি ব্রুকলিন কলেজের প্রাথমিক পড়াশোনা শেষ করে ভর্তি হন শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। এটা ছিল তাঁর জীবনের এক মোড়-ঘোরানো ঘটনা। এখান থেকেই তিনি প্রথম প্রত্যক্ষ রাজনীতির সংস্পর্শে আসেন। কৃষ্ণাঙ্গদের সমানাধিকারের দাবীতে সিভিল রাইটস আন্দোলনের সমর্থন থেকে ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে শান্তি মিছিল - বার্নি সর্বত্র শুধু উপস্থিত থাকতেন না, নেতৃত্ব দিতেন। Congress of Racial Equality (C.O.R.E), Student Peace Union (S.P.U) এবং অবশ্যই Young People’s Socialist League ( Y.P.S.L) এর মতো সংগঠন বার্নিকে গভীর ভাবে প্রভাবিত করেছিল। জেফারসন, লিঙ্কন, মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন তো বটেই , বার্নি লিখেছেন তিনি গভীর ভাবে প্রভাবিত হয়েছিলেন মার্কিন সোশ্যালিস্ট পার্টির প্রবাদ প্রতিম নেতা ইউজিন ভি ডেবস-এর দ্বারা। ডেবসের আদর্শেই অনুপ্রাণিত হয়ে বার্নির মনে হয়েছিল - '...without economic democracy it was impossible to achieve genuine political democracy.’ আর এই অর্থনৈতিক স্বাধীনতা একমাত্র সমাজতন্ত্রের মধ্যে দিয়ে আসবে বলেই তিনি মনে করতেন।
এই তরুণ রাজনৈতিক র্যাডিকালরা এই সময় মার্কিন রাজনীতিতে একটি তৃতীয় শক্তি গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন। সেই ভাবনা থেকেই ১৯৭১-এ জন্ম নেয় লিবার্টি ইউনিয়ন। বার্নির ভাষায় – 'The bosses have two parties we need one of our own’। নির্বাচনী রাজনীতিতে বার্নির হাতেখড়ি এর মাধ্যমেই। ভার্মন্ট রাজ্যকে কেন্দ্র করে এই দল নিজেদের শক্তি সংহত করতে থাকে। প্রার্থী হিসেবে বার্নি প্রথম নির্বাচনে পান ২% ভোট, পরবর্তী নির্বাচনে সেটা কমে দাঁড়ায় %১ ভোটে। ১৯৭৪ সালের সেনেট নির্বাচনে একটু ভালো ফল হয় – ৪% । ১৯৭৪ সালে মাইকেল প্যারেন্টি (যিনি এখন প্রখ্যাত মার্কসবাদী তাত্ত্বিক) এই দলের হয়ে সর্বোচ্চ ভোট পেয়েছিলেন – ৭%। প্রবল উৎসাহ ও আদর্শবাদ থাকলেও লিবার্টি ইউনিয়নের ক্ষমতা ছিল না গভীর ভাবে শিকড় গেড়ে থাকা দুই দলের আধিপত্যের অচলায়তনে আঘাত হানার। এর পর কিছুদিন রাজনীতি থেকে অবসর নিলেন বার্নি। জীবনে একটু স্থিতাবস্থার খোঁজে ছুতোরের কাজ থেকে সেলসম্যান - বহু ধরনের জীবিকার সঙ্গেই তিনি যুক্ত হয়েছেন - জীবনের পাঠশালায় তাঁর হয়েছে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতাও। কিছুটা শখে, কিছুটা জীবিকার জন্যই তথ্যচিত্র বানাতেন বার্নি আর সেগুলি শিক্ষামূলক উপকরণ হিসেবে বিক্রি করতেন স্কুলে। ইউজিন ভি ডেবস, মাদার জোনস, এমা গোল্ডম্যান, পল রবসন - বিভিন্ন ব্যক্তিত্বদের নিয়ে তাঁর বানানো তথ্যচিত্রের সংখ্যা নেহাত কম না। ১৯৮১ সালে স্যান্ডার্স আবার রাজনৈতিক আঙিনায় অবতীর্ণ হলেন।
এবার লক্ষ্য অনেক ছোট। ভার্মন্ট রাজ্যের রাজধানী বারলিংটনের মেয়র পদ। কিন্তু তাও একজন নির্দল প্রার্থীর দুটি পূর্ব প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক দলের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে কোন নির্বাচন জেতা সেই সময়ে অসম্ভব মনে করা হত। কেন, সেটা লড়তে নেমেই বার্নি বুঝতে পারলেন। প্রথমেই সমস্যা হল মিডিয়া। বার্নি লিখেছেন, মিডিয়া রাজনীতিবিদ বাছতে বলে ব্যক্তিত্ব দেখে। সেখানে চওড়া হাসি বা প্রতিপক্ষকে কতটা কড়া কথা বলছে সেটা দেখে ভোট দেওয়ার কথা বলা হয় - নীতি দেখে নয়। তাঁর ভাষায় এই 'Soulless politics’ এর প্রকৃষ্ট উদাহরণ দেখা গিয়েছিল সেই নির্বাচনে। বিদায়ী ডেমোক্র্যাটিক মেয়র গর্ডন প্যাকে, অন্যদিকে তাঁর রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী রিচার্ড বোভ - এই দুইয়ের মধ্যেই মূল লড়াই হবে ধরে নিয়ে মিডিয়া শুধু তাঁদের নিয়েই পড়েছিল। শুধু সেটা হলেই বার্নি বীতশ্রদ্ধ হতেন না, তাঁর জেতার সম্ভবনা এমনিতেই কম ছিল আর এর আগে তিনি কখনও নির্বাচন জেতেননি - তাই মিডিয়াতে তাঁর কথা ছাপা নাই হতে পারে। কিন্তু যখন তিনি দেখলেন, নীতি আলোচনার বদলে নেতারা কী খেতে পছন্দ করেন, স্কি করায় কে কত দক্ষ, শিকার পছন্দ কিনা - এই সব অবান্তর বিষয় নিয়েই মিডিয়া ভাষ্য নির্মাণ করছে - তখন তাঁর বিরক্তি আর ক্ষোভের সীমা ছিল না। নিঃশব্দেই কাজ করে যেতে লাগলেন বার্নি। তিনি লিবার্টি ইউনিয়নের পুরনো কয়েকজন সদস্য আর কয়েকজন সমাজতন্ত্রে বিশ্বাসী স্বল্পবয়সী স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে প্রচারে নেমে পড়লেন। সাধারাণত যেভাবে ভোট প্রচার হয় – সেখানে প্রচার হয় নেতার। বার্নি সেই দিক দিয়েই গেলেন না - প্রথমেই তিনি পরিষ্কার করে দিলেন ব্যক্তি স্যান্ডার্স কিচ্ছু না - আসল কথা স্যান্ডার্সের নীতি। সেই সময়ে মার্কিন ভোট রাজনীতিতে বার্নি আরেকটা জিনিস আমদানি করলেন - সেটা হল শ্রেণী ধরে ভোট প্রচার। শহরের যে কয়েকটা অঞ্চলে শ্রমিক শ্রেণীর আবাস সেখানে বার্নি জানপ্রাণ লড়িয়ে দিলেন মিটিং-এর পর মিটিং করে - অপরদিকে সম্পদশালী এলাকায় তিনি ভোট প্রচার করে কোন সময়ই নষ্ট করলেন না।
তিনি প্রথমেই পরিষ্কার করে দিয়েছিলেন তাঁর রাজনৈতিক দায়বদ্ধতা থাকবে একটা শ্রেণীর প্রতি - শ্রমিক শ্রেণী। অবশেষে ১৯৮১-এর ৩রা মার্চ নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হল। নির্বাচনের ফল সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে চমকিত করে দিল। ২২ ভোটে স্যান্ডার্স বিজয়ী। পুনরায় গণনা করার পর সেই লিড কমে ১০ ভোটে দাঁড়ালেও ফলাফল বদলাল না। যে জাতীয় মিডিয়া এই নিয়ে একেবারেই উৎসাহী ছিল না, তাঁরা বারলিংটনের উদ্দেশ্যে ধাবিত হলেন। প্রায় চল্লিশ বছর পরে ডেমোক্র্যাট আর রিপাব্লিকান পার্টির বাইরে তৃতীয় কোন শক্তি কোথাও মেয়র পদে নির্বাচিত হয়েছে - এই খবর ছিল কামানের গর্জনের মতো। বার্নি নিজেও এই খবর বিশ্বাস করতে পারেননি প্রথমে। মেয়র পদে শপথ নিতে গেলে দরকার ছিল একটা দামি কোটের। সেটাও তাঁর ছিল না। বন্ধু বান্ধবদের থেকে ধার করে তাঁকে আলাদা করে কোট কিনতে হয়েছিল। কিন্তু দেশের একমাত্র নির্দল ও সমাজতন্ত্রী মেয়র হিসবে শপথ নিয়েই বার্নির লড়াই শেষ হল না। তিনি জানতেন লড়াই সবে শুরু হয়েছে। তাঁর ভাষাতেই – 'Theory and ideas are exciting, but the practical work of continuing and holding public office – that’s another story’।
প্রথমেই সমস্যা যোগ্য ব্যক্তি নিয়োগে। স্যান্ডার্স শহরের গুরুত্বপূর্ণ পদগুলিতে যোগ্য ও আদর্শবান ব্যক্তিদের নিয়োগে আগ্রহী ছিলেন - কিন্তু এই নিয়োগের জন্য প্রয়োজন ছিল সিটি কাউন্সিলের অনুমোদনের। এদিকে মাত্র ২ জন কাউন্সিল সমর্থক ছিলেন নির্দল ও স্যান্ডার্স সমর্থক বাকি রিপাব্লিকান আর ডেমোক্র্যাটদের ১১ জন কাউন্সিলার বার্নির সমস্ত নীতি ও নিয়োগ প্রস্তাবে ভেটো দিতে জোট বেঁধেছিলেন। উপায়ন্তর না দেখে স্যান্ডার্স রুশ বিপ্লবের প্রাক্কালে পেট্রোগ্রাদ শহরের ঐতিহাসিক উদাহরণ অনুসরণ করবেন ঠিক করলেন - ডুয়েল পাওয়ারের উদাহরণ। কাউন্সিল তাঁর হাতে নেই তো কী হয়েছে? তিনি সমান্তরাল প্রশাসন চালাবেন। প্রথমেই তিনি বিভিন্ন বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ও সমাজতন্ত্রী মতবাদের বিশ্বাসী বা সহানুভূতিশীল এমন কিছু মানুষকে এক করলেন। এরপর তিনি টাউন হলে ঘোষণা করলেন শহরের বাসিন্দারা যা যা সমস্যা সেখানে এসে তাঁরা যেন লিখে দিয়ে যান। স্যান্ডার্স ও তাঁর এই বিশেষজ্ঞর দল এই অভিযোগ আর সমস্যার তালিকা নিয়ে স্যান্ডার্সের রান্নাঘরে বসা শুরু করলেন। আইনত এই দলের কোন ক্ষমতা ছিল না - তাঁরা কোন পারিশ্রমিকও পেতেন না। কিন্তু সরকারের দৈনন্দিন কাজকর্ম যাতে ঠিকঠাক চলে, যাতে মানুষের সমস্যার যথাযথ সমাধান হয়, দুই পার্টি যাতে শুরু না হতেই বার্নির এই 'বিপ্লব'-এর ইতি টানতে না পারে তার জন্য এঁদের প্রাণপাত পরিশ্রম সাধারণ মানুষের মধ্যেও গভীর প্রভাব ফেলল।
মেয়র নির্বাচনের কয়েকমাস পড়েই যখন অল্ডারম্যান নির্বাচন হল, দেখা গেল বার্নির নব গঠিত 'প্রগ্রেসিভ পার্টি' একটুর জন্য সংখ্যা গরিষ্ঠতা লাভ করেনি। তাঁরা ১৩ টি আসনের মধ্যে পেয়েছেন ৫ টি। কিন্তু এই ঘটনার পরে জনমত কোনদিকে তা বুঝতে পেরে ডেমোক্র্যাট বা রিপাব্লিকানদের তরফ থেকেও আর সেইরকম বাধা আসল না। বার্নি এবার সত্যিই নিজের মতো করে কাজ করতে সক্ষম হলেন। বারলিংটন শহরের জন্য তাঁরা যে মডেল গড়ে তুললেন, মিডিয়াতে ও তাঁদের নিজেদের মধ্যেও তা পরিচিত হল 'এক শহরে সমাজতন্ত্র' নামে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এই প্রথম কোন শহরে ভর্তুকি দেওয়া গণ-আবাসন প্রকল্প, গড়ে তোলা হয় নতুন ‘Child Care & Teen Center’। গার্হস্থ্য হিংসার ঘটনা রোধে মহিলাদের নিয়েই গড়ে ওঠে নতুন সংগঠন। বৃক্ষরোপণ প্রকল্প ও নতুন পার্কের মাধ্যমে সাজিয়ে তোলা হয় গোটা শহর। প্রোগ্রেসিভ ট্যাক্সের মাধ্যমে কর ব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো হয়। স্বাস্থ্য, দমকল, পুলিশ - অর্থের অভাবে যে দপ্তরগুলো ধুঁকছিল, ঢেলে সাজানো হয় সেগুলিকে। যতই রেড বেইটিং-এর আশ্রয় নেওয়া হোক না কেন, সাধারণ মানুষ আর Red Scare-এ প্রভাবিত হতে রাজি ছিলেন না।
জনৈক বারলিংটনবাসীর এই সময়ের মন্তব্য দেখলেই বোঝা যায়, এমনকি মতাদর্শগতভাবে উদাসীন আমেরিকানরাও এই প্রশাসনকে কি চোখে দেখছিলেন – 'I don’t know anything about this socialism, but Sanders is doing good job repairing streets.’ তাই সরাসরি রেগানের নীতির বিরুদ্ধে গিয়ে নিকারাগুয়ার পক্ষে বক্তব্য রাখা ও সান্দিনিস্তা সরকারকে সমর্থন করে খাদ্য,বস্ত্র, ওষুধ পাঠানোর জন্য স্যান্ডার্স দেশের মূল ধারার দলগুলির তরফ থেকে তীব্র সমালোচনার মুখে পড়েছেন - কিন্তু তাতেও তাঁকে নড়ানো যায় নি। ১৯৮১ থেকে ১৯৮৯ - এই আট বছর মেয়র পদ থেকে বারংবার চেষ্টা করেও তাঁকে অপসারিত করতে পারেনি ডেমোক্র্যাটরা বা রিপাবলিকানরা, এমনকি অভূতপূর্ব ভাবে ১৯৮৭ সালে জোট বেঁধে লড়াই করেও নয়। দুই রাজনৈতিক দলের মিলিত অর্থবলও বার্নিকে পরাজিত করতে ব্যর্থ হয়। স্যান্ডার্স নিজেই একবার মজা করে বলেছিলেন – 'We did not overwhelm our opponents with money, we overwhelmed them with votes – like its supposed to work in a democracy.’।
২০১৬ সালের রাষ্ট্রপতি নির্বাচনের সময় ডেমোক্র্যাট প্রাইমারি প্রতিযোগিতার সময় বার্নি স্যান্ডার্স উল্কাবেগে মার্কিন মূলধারার রাজনীতিতে তো বটেই, বিশ্বজুড়ে খ্যাতি অর্জন করেছেন। ভার্মন্ট রাজ্যের সেনেটর হিসেবে তিনি ৯০-এর দশকের শেষ দিক থেকেই নির্বাচিত হয়ে আসছেন। সেই ভূমিকা নিয়েই তাঁর জনপ্রিয়তা লাভের পর মিডিয়া অধিক গুরুত্ব প্রদান করেছে। কিন্তু সম্ভবতঃ স্যান্ডার্সের ১৯৮১-৮৯ কালপর্বে বারলিংটনের মেয়র হিসেবে ভূমিকা আরও অধিক আলোচনার দাবী রাখে। কারণ সেনেটর হিসেবে স্যান্ডার্স প্রচলিত মার্কিন আর্থ-রাজনৈতিক কাঠামোর শুধু সমালোচনাই করেছেন, বিভিন্ন বিলের বিরোধিতা বা সমর্থনের বেশি তাঁর রাজনৈতিক ভাবনার হাতে কলমে প্রয়োগ সেখানে দেখা যায় না। কিন্তু মেয়র পদে থাকাকালীনই স্যান্ডার্স নির্মাণ করেছিলেন এক বিকল্প মডেল, যা ভবিষ্যতে শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জন্যই নয় - বিশ্বব্যাপী বিকল্প নীতিতে নগর পরিচালনার একটি সফল উদাহরণ হিসেবে গণ্য হবে। স্যান্ডার্স ২০২০-এর প্রাইমারিতে পুনরায় পরাজিত হয়েছেন বটে - কিন্তু তিনি রেখে গেছেন এক বিকল্প মডেল, এক বিকল্প আদর্শ এবং ডেমোক্র্যাটিক সোশ্যালিস্ট অফ আমেরিকার মতো তাঁর দেখানো পথে চলার মতো একটি সংগঠন। আশা রাখাই যায় যে অচলাতনের প্রস্তর দ্বারে তিনি প্রথম হাতুড়ির ঘায়ে চিড় ধরিয়েছেন - কালক্রমে তা সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়বে। 'এক শহরে সমাজতন্ত্র'র মডেল, এক শহর থেকে একদিন ছড়িয়ে পড়বে সমগ্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন