ভারতের বেশিরভাগ উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষই নিজেদেরকে এই মাটির আদি বাসিন্দা বলে পরিচিত করেন। সেটা তাদের কাছে গর্বের।
পরিচয়ের সামাজিক নির্মাণে তারা নিজেদের আদিবাসী পরিচয় দেন। আমরাও কোল, ভীল, ভূমিজ, খাড়িয়া, লোধা, শবর, মুণ্ডা, ওঁরাও, সাঁওতাল সহ সকল উপজাতি সম্প্রদায়ের মানুষকে আদিবাসী বলেই জানি। পাঠ্য বইগুলোতেও আক্ষরিক অর্থে তাদেরকে এই ভূমির প্রথম বাসিন্দা বলে উল্লেখ করা আছে। পছন্দের এই “আদিবাসী” শব্দটিও বহুলভাবে ভারতীয় সমাজে প্রচলিত। শুধু স্কুল পাঠ্যে নয়, সংবাদপত্রে, সরকারী নথিতে, এবং উচ্চ শিক্ষার স্বীকৃত গবেষণা বৃত্তেও “আদিবাসী” শব্দটা এই মাটির “প্রথম বাসিন্দা” অর্থে সদা প্রযোজ্য হয়ে এসেছে।
নৃতাত্ত্বিক গবেষকগণ সেই সাধারণ অর্থেই উপজাতীয় জনগণের সম্পর্কে আদিবাসী ধারণাটি লিখেছেন। ঔপনিবেশিক শাসন ও শিক্ষার কারণে উপজাতি জীবনধারা প্রসঙ্গে গবেষণার প্রায় সমস্ত বিষয়ে শব্দটি সেই অর্থেই ব্যবহৃত হয়। এই কমবেশি সর্বজনীন নিয়মের একমাত্র ব্যতিক্রম হল সঙ্ঘ পরিবার এবং যারা আদর্শগতভাবে হিন্দুত্বের প্রতি অঙ্গীকারবদ্ধ। “আদিবাসী” শব্দের বিপরীতে তাদের জন্য পছন্দের শব্দটি হল “বনবাসী” – যারা বনে বাস করে।
এই বনবাসী কেন উন্নয়নের আলোয় আসবে না? তাদের আধুনিক সমাজের অংশীদার করে তোলাটাই তো প্রগতির লক্ষণ। অখণ্ড রামরাজ্যের পথে অগ্রবর্তী হতে গেলে সেই উন্নয়ন অনিবার্য। ইতিহাসের পাতায় বনবাসীরা বর্ণপ্রথার মাধ্যমে ভারতীয় সমাজের মূল স্রোত থেকে প্রান্তিক হয়ে পড়েছে। তারা বাহ্য। তারা অন্তজ। তাই তাদের বর্ণপ্রথায় অন্তর্ভুক্ত করতেই হবে। ঐতিহ্যগতভাবে বর্ণ কাঠামোর বাইরে আর তাদের বিবেচনা করা যাবে না। তারা সম্পূর্ণরূপে অপবিত্র নয়। ফলে ব্রাহ্মণীয় বর্ণ ব্যবস্থার মধ্যে থেকেই বিষয়টিকে দেখতে হবে। তারা বনবাসী বলেই বিচ্ছিন্ন। এই বিচ্ছিন্নতার সুযোগ নিচ্ছে ধর্মের অন্যান্য সংগঠিত রূপগুলি। সংখ্যাগরিষ্ঠ হিন্দু জনসংখ্যার তাই সেখানে একটা দায় থাকে। সেটা হল এই বনবাসী পরিচয়ে সেই সকল সম্প্রদায়কে হিন্দু অংশে পরিণত করা।
এমন ধারণায় নিজেদের গুছিয়ে নিয়ে স্বাধীন ভারত জুড়ে আদিবাসী সমাজের মঙ্গল চর্চা শুরু হয়। উপজাতি অঞ্চলে সেই কাজ করার জন্য সঙ্ঘ পরিবার বহু সংগঠন গড়ে তোলে। স্বাধীনতার পরপরই সেই কাজ তারা যে গতিতে করতে পারতো, আজ সেটাতে তারা অনেক বেশী শক্তি ধারণ করে। রাষ্ট্রের পেশী এখন সহায়ক ভূমিকায় অবতীর্ণ। সরকারের পরিকল্পনায় বরাদ্দ অর্থ সাহায্য নিয়েও বহু স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন আদিবাসীদের বনবাসী করে তুলে প্রগতির আলোয় নিয়ে আসছে। বিদেশ থেকেও ফান্ড আসছে। ইন্ডিয়া ডেভলপমেন্ট এন্ড রিলিফ ফান্ড (আইডিআরএফ) সেই বনবাসী উন্নয়নে খরচ হচ্ছে।
উপজাতি এলাকাকে ফোকাস করে এমন উন্নয়নমূলক কাজ যে সংগঠনগুলি করছে তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল বনবাসী কল্যাণ আশ্রম। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, খাদ্যের একটা জোগান রেখে আদিবাসী মানুষকে সেখানে স্বেচ্ছাশ্রম দানকারী হিন্দু বনবাসী জীবনে গড়ে তোলা হচ্ছে। উপজাতি অঞ্চলে সনাতনী জ্ঞানে শিক্ষা প্রসারে একল বিদ্যালয় সংস্থা একটা জায়গা করে নিয়েছে। শুধুমাত্র উত্তর-পূর্ব ভারতের উপজাতি অঞ্চলে নয়, সারা দেশে লক্ষাধিক স্কুল তারা এখন চালায়। এছাড়াও ভারত কল্যাণ প্রতিষ্ঠান, সেবা ভারতী, ভারতীয় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম, বিবেকানন্দ কেন্দ্র, আদিবাসী সমাজের বন্ধু ইত্যাদি কল্যাণমূলক প্রতিষ্ঠানের সাহায্যে আরএসএস আদিবাসী মানুষকে হিন্দু সংস্কৃতির তালিম দিচ্ছে। হিন্দু আদর্শে অভ্যস্ত করছে। এই সকল সংস্থাই আইডিআরএফ-এর ফান্ড পায়। সেই অর্থ সাহায্যে আদিবাসীদের বনবাসী পরিচয়ে হিন্দু অংশে “ফিরিয়ে আনা” হল তাদের কাজ।
আদিবাসীদের মধ্যে কাজ করা এই সঙ্ঘ সংগঠনগুলির রাজনৈতিক উদ্দেশ্য হল দুটি। প্রথমত, বনবাসীদের (উপজাতীয়দের) হিন্দু বিশ্বাসে “ফিরিয়ে আনা”র নামে অভ্যস্ত করা; এবং দ্বিতীয়ত, খ্রিস্টধর্মে ধর্মান্তরিত হওয়ার প্রবণতাকে “চেক” করা। এই দৃষ্টিভঙ্গি সঙ্ঘের অনেক বইয়ে সুস্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। বনবাসী কল্যাণ আশ্রমের প্রকাশনাগুলিকে লক্ষ্য করলে তা যে সঙ্ঘের ঘোষিত নীতি সেটা বোঝা যায়।
হিন্দুত্বের প্রসারে সেই কর্মকাণ্ডের কথা সঙ্ঘের নানা বইয়ে সবিস্তারে বলা আছে। সেখানে খ্রিস্টান মিশনারিদের বেইমান, তারা ব্রিটিশ উত্তরাধিকারের বাহক হয়ে দেশদ্রোহী, জাতীয়তাবাদ বিরোধী হয়ে ধর্মান্তরিতকরণের মাধ্যমে হিন্দু সমাজের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশকে তারা পদ্ধতিগতভাবে বিচ্ছিন্ন করছে, ইত্যাদি কথা লেখা আছে। সেই চিন্তাধারায় হিন্দুত্বের স্বার্থে পাদ্রী হত্যা বৈধ হতে পারে।
ভারতীয় বনবাসী কল্যাণ আশ্রম (বিকেভিএ) পঞ্চাশের দশকের শুরুতে প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। আজ সত্তর বছর ধরে আশ্রমটি শুধুমাত্র তার কার্যক্রমের সমস্ত ক্ষেত্রেই ধর্মান্তরিতকরণ বন্ধ করতেই শুধু নয়, ধর্মান্তরিতদেরকে হিন্দু সম্প্রদায়ে ফিরিয়ে আনতেও সফল হয়েছে। সুতরাং, ১) খ্রিস্টান ধর্মান্তরিতকরণ বন্ধ করা এবং ২) আদিবাসীদের হিন্দু ধারায় ফিরিয়ে আনা –এই দুই কাজে হিন্দুত্বের প্রকল্প আজ সফলভাবে সচল।
এই সচলতায় হাতিয়ার অনেক, তহবিলও অনেক, ফলে খ্রিস্টান মিশনারি মডেলের বিকল্প নির্মাণে কাজটা করা যাচ্ছে। এখানেও বনবাসী সৈনিক হয়ে আদিবাসী মেয়েরা গ্রামে গ্রামে “রামকথা” প্রচারের কাজ পায়। আদিবাসী মহল্লায় আয়ের পথ খোলে। এই ধর্মীয় “পুনরুত্থান”, “হিন্দুকরণে” জাতীয় সংহতির লালন, নির্বাচনী লাভের “নিশ্চিতকরণ”, সুরক্ষার স্বার্থে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা এবং সহিংসতা হাতিয়ার মজুত রাখা, ইত্যাদি হল সঙ্ঘের মৌলিক কৌশল।
এখানেই কি শেষ? তাতে আদিবাসীকে বনবাসী করার কি প্রয়োজন?
তখনই এই পুনরুত্থানে, হিন্দুকরণে, রক্ষণে এবং ক্ষমতা-নিশ্চিতকরণের সঙ্গে হিন্দুত্বের আভিধানিক উপায় হিসেবে আদিবাসীকে বৈধ বনবাসীকরণের একমাত্র প্রয়োজন অনুভূত হয়। হিন্দুত্বের রাজনৈতিক আদর্শ প্রতিষ্ঠার প্রধান প্রাণভ্রমরা যে বনবাসীকরণেই লুকিয়ে থাকে। সেই কারণেই তাকে বনবাসী করে তোলাটাই সবচেয়ে জরুরী হয়ে পড়ে।
বনবাসীদের (উপজাতিদের) তাদের পূর্বপুরুষ (হিন্দু) জীবনধারা সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করে জাতীয় মূল স্রোতে নিয়ে আসা এবং তাদের সমাজবিরোধী এবং জাতীয় বিরোধী উপাদান থেকে রক্ষা করার মধ্যে দিয়ে বাস্তবায়িত হয় সঙ্ঘের আদর্শিক প্রকল্প। রামকথার প্রয়োজনীয়তা আদিবাসী ঐতিহ্যের জন্য অপরিহার্য নয়, কিন্তু সাংস্কৃতিকরণ প্রক্রিয়ার মধ্যে দিয়ে হিন্দুকরণে সেটা অনিবার্য হয়। সঙ্ঘ সেটা জানে, তাই সংঘ মতাদর্শের মৌলিক ভিত্তির ভরণপোষণের কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসছে আর্যভূমে আদি ভারত ধারণা।
আদিবাসীদের বনবাসী হিসাবে বির্নির্মাণ করার জন্য সঙ্ঘ পরিবারের প্রচেষ্টা তাদের সেই আদর্শিক প্রকল্পের প্রধান গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। আমাদের ভারতকে তাদের “হিন্দু রাষ্ট্র” করে তুলতে ঐতিহাসিক ভিত্তি হিসেবে তাদের প্রয়োজন “ভূমির আদি বাসিন্দা” হওয়ার স্বীকৃতি। একমাত্র আদিবাসীরাই তাদের সেই হিন্দু জাতি নির্মাণ প্রকল্পকে মৌলিকভাবে চ্যালেঞ্জ করে। এই প্রকল্পটি হিন্দুদের ভারতের আদিবাসী হওয়ার দাবির উপর শুধু নির্ভর করে তাই নয়, সেই দাবিকে প্রতিষ্ঠা করতে বনবাসী পরিচয়ে আদিবাসীদের হিন্দু সমাজব্যবস্থার স্তরীক্রমের নীচের স্তরে স্থাপন করাটাকেও নিশ্চিত করে। সঙ্ঘ আদিবাসীদের “আদিবাসী” মর্যাদা অস্বীকার করতে বাধ্য কারণ এটি তাদের নিজেদের দাবির বিপরীতে চলে গিয়ে আর্যরা, যারা দেশে বৈদিক সভ্যতা নিয়ে এসেছিল, তারাই এই ভূমির আদি বাসিন্দা, সেটাকেই ভুলুন্ঠিত করে।
পরিচয় গঠন হল একটি সামাজিক নির্মাণ প্রক্রিয়া। সকল ক্ষেত্রেই পরিচিতিকে সমাজ স্বীকৃতি দেয়। সেই গঠন প্রক্রিয়ায় রাজনীতি অনুঘটকের কাজ করে। আজকের ভারতে তাই বনবাসীরা হিন্দুত্বের রাজনীতিতে সহজেই হয়ে ওঠেন হিন্দু। নিম্নবর্ণের হিন্দু। বোঝানো হয় যে ধর্ম থেকে বিচ্ছেদ (ধর্মান্তর) মানে রাষ্ট্র থেকেও আনুগত্যের বিচ্ছিন্নতা। সেই ধর্ম-মতাদর্শিক প্রশিক্ষণের মধ্যে দিয়েই উপজাতি যুবকদের মস্তিষ্ক-প্রক্ষালন সম্পাদিত হয়। সে হয়ে ওঠে জাগ্রত হিন্দু সেনা।
হিন্দুত্বের রাম শিলা প্রতিষ্ঠা করতে গোড়াতেই তাই “ধর্মের প্রতি অসম্মানের মধ্যে দিয়ে জাতির প্রতি অসম্মান আটকাতে” সঙ্ঘের প্রিয় হয় বনবাসী শব্দ। বড় মধুর হয়ে ওঠে উন্নয়নের কাজ। উপজাতিদের সেই উন্নয়নে তাদের জল, জঙ্গল থেকে উচ্ছেদ আটকায় না। স্বজনতোষী পুঁজিবাদের জাঁতায় তারা উদ্বাস্তু হয়। বনবাসী পরিচয় নিয়ে তারা নাগরিক বস্তি জীবনে লড়াইয়ে বেঁচে থাকেন। আর তখনই “‘জাতীয় বিরোধী’ উপাদান হল মুসলিম আর খ্রিস্টানরা, যারা বহিরাগত” – এই প্রচারে হিন্দুত্বের মূল প্রকল্প হিসাবে হিন্দুদের জন্য একটি জাতি ধারণায় বনবাসী অন্তর্ভুক্ত হন। তার আদিবাসী পরিচয়ের প্রাচীনত্বকে সুগন্ধ হিসেবে গায়ে মেখে ভূমিপুত্রের পরিচয়ে হিন্দুত্ব উদ্ভাসিত হয়। সমাজে প্রতিফলিত হয় ইতিহাসের উপাদান।
সেই কৌশলী সন্ধিক্ষণে রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থী দ্রৌপদী মুর্মু। তিনি আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষ। তাঁর রাজনীতিতে আসা সেই হিন্দুত্বের পথ ধরেই। ফলে ভারতের রাজনীতির প্রাঙ্গণে একজন বনবাসী রাষ্ট্র প্রধানের সহায়তায় হিন্দুত্বের নির্মাণ আদিবাসী পরিচয়কে কতটা দ্রুততার সঙ্গে মুছে ফেলে সেটাই এখন দেখার।
- লেখক ফারাক্কা এস এন এইচ কলেজের সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন