AI: কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা - মানব সভ্যতা জীবন্ত লাশ হয়ে যাবে না তো?

People's Reporter: চার্লি চ্যাপলিন ‘মডার্ন টাইমস্’–এ একজন শ্রমিকের মেশিন হয়ে ওঠা, আবার মেশিনকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ করে তোলার কাজে প্রযুক্তি-বিভ্রাটের ছবি দেখিয়েছেন।
ছবি প্রতীকী
ছবি প্রতীকীগ্রাফিক্স আকাশ
Published on

মেশিনের অভ্যন্তরে মানুষের বুদ্ধিমত্তার অনুকরণ সম্পর্কে আজ অনেক রকমের কথাই শোনা যাচ্ছে। আমরা অবশ্য অনেক দিন ধরেই একটি প্রশিক্ষিত মেশিন পরিচয়ে রোবটের কথা শুনে আসছি। কিছু ক্ষেত্রে রোবট দেখেছিও। প্রতিটি মেশিনই শ্রম-বিন্যাসের কাঠামোয় একটা ছন্দকে প্রকাশ করে এবং গতি দেয়। সেটাকেই আমরা মেশিনের সক্ষমতা বলে মানি। চার্লি চ্যাপলিন ‘মডার্ন টাইমস্’–এ একজন শ্রমিকের মেশিন হয়ে ওঠা, আবার মেশিনকে মানুষের দৈনন্দিন জীবনের অঙ্গ করে তোলার কাজে প্রযুক্তি-বিভ্রাটের ছবি দেখিয়েছেন। আজকের স্মার্ট মেশিন, ইন্টারনেট যুক্ত কম্পিউটার, তথ্য ও বিশ্লেষণে অত্যাধুনিক।

এখন মেশিনকে নানা অনুমান নির্ভর সম্ভাবনার প্রোগ্রামে বেঁধে দেওয়া হচ্ছে। পদ্ধতি-নির্ভর পরিকল্পনায় মেশিন কাজ করে। একটি মেশিন শ্রমিকের বিকল্প হয়ে একসঙ্গে এখন বহু ধরনের কাজ করে দিতে পারে। তার মধ্যে এখন কৃত্রিমভাবে সেই বিশ্লেষণী-ক্ষমতাগুলিকে পরিকল্পনায় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। এখানে লক্ষ্যগুলির মধ্যে রয়েছে কম্পিউটার-বর্ধিত শিক্ষা, যুক্তি এবং উপলব্ধি। বুদ্ধিমত্তার এমন নমুনা বহুমাত্রিক। সুরক্ষা ব্যবস্থায় মুখ কিম্বা আঙ্গুলের ছাপ শনাক্তকরণ বৈশিষ্ট্য হিসেবে কাজ করে। আবার কোন মেশিন মানুষের অবয়বে পুতুল হয়েও খবর পড়তে পারে, কেউ টাকা দিতে ও নিতে পারে, আবার কেউ জ্ঞানানু জুগিয়ে গবেষণার কাজে সাহায্য করতে পারে।

আমাদের চারপাশেই এখন এআই (AI)। এআই আমাদের জীবন সঙ্গী। এই এআইকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বলবেন কিনা, সেই পরিভাষাগত বিতর্ক অন্য। সমাজতাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণে এই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা একগুচ্ছ পূর্বানুমানকে বোঝায়, যার নিজস্ব সংশ্লেষ ক্ষমতা রয়েছে। উৎপাদন, ফাইন্যান্স, বিপণন শিল্প সহ অনেক সেক্টরের একটি বড় অংশে এবং স্বাস্থ্যসেবার বিভিন্ন পর্যায়ে এখন মেশিন ব্যবহার করা হয়। হাতের ফোনটাকে ব্যবহার করেই আমরা অনেক প্রয়োজন মিটিয়ে ফেলতে পারি। আজকের মেশিন যেহেতু মানুষের প্রাকৃতিক বুদ্ধিমত্তা বৃদ্ধি করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে, তাই বলা হচ্ছে যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সকলের আস্থা অর্জন করতে চিরকালীন সামাজিক মূল্যবোধকে প্রতিফলিত করবে।

এই প্রত্যাশার বিপরীতে তৈরি হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রতি ভয়। প্রযুক্তি-নির্ভর যন্ত্র ব্যবহারে পুঁজির লক্ষ্য যেহেতু রাজনৈতিক, তাই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাধীন নতুন সমাজের জন্য একটি নতুন ধরনের রাজনীতি চলছে যার বয়ান কাজ, অভাব এবং পুঁজিবাদের বাইরে দাঁড়াতে চায়। কাজের দাবি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় মেটে না। এখন কাজের নতুন সুযোগ তৈরি হলেও প্রথাগত চাকরির ভূমিকা দ্রুত হারিয়ে যাচ্ছে। কর্মসংস্থানে সংকোচন সমস্যা সম্পর্কিত সেই উদ্বেগ আজও থেকে যায়। অজান্তেই ডেটা মজুতকারি হয়ে উঠি আমরা।

অভাব এখানে কল্যাণকামী সৃজনশীল ক্ষমতায় বাস করে। কারণ পুঁজি সবক্ষেত্রেই মুনাফা খোঁজে। বেঁধে দেওয়া ছকে যন্ত্র এখনও স্বয়ংক্রিয় থাকে। সম্ভাব্য পূর্ব-পরিকল্পনার বাইরে মেশিন আজও বেরুতে পারে না। আবেগগত পরিসরের অনুপস্থিতিতে আজও তাই মেশিন দুর্বল, বড় যান্ত্রিক। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় চালিত স্বয়ংক্রিয় সেই ব্যবস্থা সর্বদাই অত্যন্ত যুক্তিবাদী, তথ্যনিষ্ঠ এবং ব্যবহারিক। সে মানুষের আবেগকে নির্দিষ্ট কিছু প্যারামিটারে চিনতে পারে। পছন্দ-অপছন্দের প্রতিক্রিয়ায় ক্রেতাকে জানতে পারে, বিগ ডেটা বিশ্লেষণে ক্রেতার মন বুঝতে পারে, এবং ডিজিটাল বিপণন কৌশলে সফল হতে পারে। কিন্তু সে কি ক্রেতার আবেগগুলিকে ছুঁতে পারে? পারে না।     

বরং মানুষের অলসতার সম্ভাবনাগুলিকে বাড়িয়ে তোলে। মানব মস্তিষ্কের ব্যবহার কমাতে সাহায্য করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় লালিত এই উত্তরাধুনিক জীবন। অনিশ্চয়তায় ভরা ক্ষণকালে তিষ্ঠ সেই জীবন। তথ্যের সম্ভাব্য অপব্যবহারের ঝুঁকিতে এখানে মিথ্যার বেসাতি বৃদ্ধি পায়। ব্যক্তিগত ডেটার গোপনীয়তা রক্ষা করাটা চাপের হয়ে ওঠে, বিশেষ করে যখন জাতীয় স্তরে মজুত রাখা ডেটা ব্যাঙ্কের নিরাপত্তাও হ্যাক হয়ে যায়। বায়োমেট্রিক তথ্যের নিরাপত্তা ভূলুণ্ঠিত হয়ে যাওয়াটা উদ্বেগের বিষয় হয়ে দাঁড়ায়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এখানে শুধু সাবেকী পুঁজিবাদের শ্রম-ধারাগুলিকে ভেঙে ফেলে।

এখন দ্রুত সিদ্ধান্ত-গ্রহণ সম্ভব। অ্যালগরিদমগুলি ডিজাইন এবং প্রোগ্রাম করার জন্য নির্ভুলভাবে কাজ করাও সম্ভব। পুনরাবৃত্তিমূলক কাজগুলিকে এখন মানব-শ্রম ব্যাতিরেকেও সহজভাবে করে ফেলা যায়। বৃহত্তর জ্ঞানভাণ্ডারের সহায়তা লাভ করাটাও এখানে সহজ হয়ে ওঠে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্ত থেকে পুঁজি আকারে জ্ঞানানু এখানে লগ্নিকৃত হয়। সার্ভারে জমে ওঠে ডেটা। তাই নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ ও আপডেটের মাধ্যমে বিশ্রামহীন, মজুরিহীন শ্রমের সহায়তায় জ্ঞানীয় পুঁজিবাদ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় পুষ্ট হতে থাকে। রচিত হয় বিলাসিতার স্বয়ংক্রিয় ইশতেহার। সাম্যবাদের মোড়কে এখানে বহুমাত্রিক সম্ভাবনাগুলি হাজির থাকে। সেও এক বুদ্ধিবৃত্তিক মনুষ্যনির্মাণ।

 সম্পূর্ণ কর্মসংস্থানের উপর নির্মিত অর্থনীতিকে দুর্বল করার পরিবর্তে অটোমেশন একদিন স্বাধীনতা, বিলাসিতা এবং সুখের জগতের পথ দেখিয়েছিল। তাতে ধনী-দরিদ্রের প্রভেদ বেড়েছিল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অকল্পনীয় আশার একটি বিশ্বজনীন দৃষ্টিভঙ্গি রচনায় এখন মত্ত। এটি হাইলাইট করে যে আমরা কীভাবে শক্তির প্রাচুর্যের দিকে চলে যাচ্ছি। প্রযুক্তির বিস্ময়কর হাজিরায় মাতৃ-জঠরহীন ভ্রূণ উৎপাদনে শুধু আমরা আজ সফল নই, এই বিশ্বকে খাওয়ায় যে মানব শ্রম তা এখনও আমরা দিতে পারি। তবুও আমরা জীববিজ্ঞানের সীমা অতিক্রম করে প্রত্যেকের জন্য অর্থপূর্ণ স্বাধীনতা তৈরি করতে ব্যর্থ হচ্ছি। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে ব্যবহার করছি যুদ্ধের পরিসরে, মানুষ মারার কাজে। দৈনন্দিন জীবনে সেও এক মারাত্মক প্রয়োগ।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সিস্টেমগুলি তাই জ্ঞানীয় পুঁজিবাদের পক্ষে কাজ করে। প্রচারে আসে সক্ষমতা বৃদ্ধির কথা। মানুষের ক্ষমতা, বিশেষ করে মানবজাতির সহজাত বুদ্ধিমত্তা বাড়ানোর জন্যই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার বিকাশ ঘটানো হয়েছে বলা হয়। দেখা যাচ্ছে একটা মহামারী মানুষের বুদ্ধিমত্তার মাত্রা বৃদ্ধি করে। দক্ষতার বহুমাত্রিকতায় নতুন সমাজ মানবকেন্দ্রিক উন্নয়নে আরও সক্ষতার সঙ্গে কাজ করার উপায় খুঁজে বের করে, উৎপাদনশীলতা বাড়ায়, এবং উন্নত মানব কর্মপ্রবাহ বিকাশের পথগুলিকে অন্তর্ভুক্ত করে। যখন এই মানবকেন্দ্রিকতা নিশ্চিতভাবেই পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করে।

উদ্ভাবনী শক্তির ইতিবাচক দিকগুলিকে আমাদের ব্যবহার করতে হবে। সুযোগের পাশাপাশি চ্যালেঞ্জগুলিকেও আমাদের মোকাবিলা করতে হবে। এই কারণেই শক্তিশালী নৈতিক নীতি, আইনের বিবর্তন, নতুন দক্ষতার জন্য প্রশিক্ষণের গুরুত্ব এবং এমনকি শ্রমবাজার সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা মোকাবেলা করার জন্য আমাদের প্রযুক্তির বাইরেও চিন্তা করতে হবে। আমরা যদি এই নতুন প্রযুক্তির সর্বাধিক ব্যবহার করতে যাই তবে এটিকে অবশ্যই আমাদের বুঝতে হবে।

এই প্রযুক্তির সংলগ্ন না হলে নতুন পরিস্থিতির জন্য নতুন দক্ষতার প্রয়োজন আমরা কীভাবে বুঝবো? প্রকৃতপক্ষে, অনেক বিদ্যমান কাজের জন্যও নতুন দক্ষতার প্রয়োজন হবে। প্রযুক্তিগত পরিবর্তনের মুখে সবসময় এটাই হয়ে থাকে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ক্লাউড এবং অন্যান্য উদ্ভাবনে মেশিন লার্নিং প্রক্রিয়াগুলিকে আমাদের বুঝতে হবে। সেটা না বুঝলে মানব সভ্যতার সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জের মোকাবিলা আমরা করতে পারবো না। মানুষকে নতুন দক্ষতা শিখতে সাহায্য করার উপায় তৈরি করাটাই হল সমাধানের প্রধান পথ।

মহান ‘এআই’ ভয়কে জয় করতে নতুন পাবলিক পলিসি এবং সেই অনুসারী ব্যবস্থা গ্রহণের পথে তাই আমাদের অগ্রসর হতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন সম্পর্কিত তথ্যকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সহায়তায় চাষিদের আগাম সতর্কীকরণে আমরা ব্যবহার করতে পারতাম। পারিনি। সরকারের পাশাপাশি কৃষক সংগঠনের সহযোগিতামূলক, কল্যাণমূলক কাজে সেটা খামতি। অগ্রগতির প্রাথমিক স্তম্ভের উপর সমাজের মনোযোগ এখনও তাই যথেষ্ট নয়। একটি কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী অর্থনীতি, একটি ন্যায্য প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা, এবং এই সবের জন্য সর্বোপরি, সামাজিক কল্যাণের বিকাশ ঘটানোটাই হওয়া উচিত আমাদের মানবিক লক্ষ্য।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় নির্মিত সিস্টেম ইতিমধ্যেই মানুষকে বড় সমস্যা মোকাবেলায় সাহায্য করছে। এর একটি ভাল উদাহরণ হল ‘ইনারআই’, একটি প্রকল্প, যেখানে মাইক্রোসফ্টের যুক্তরাজ্য ভিত্তিক গবেষকরা ক্যান্সারকে আরও কার্যকরভাবে চিকিত্সা করতে সাহায্য করার জন্য একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সিস্টেম বিকাশের চেষ্টা করছেন। তার জন্য তাঁরা ক্যান্সার বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে কাজ করছেন।

বিকল্প প্রযুক্তিব্যবস্থা যতক্ষণ না আমরা তৈরি করতে সক্ষম হচ্ছি, ততক্ষণ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রচলিত ফাঁদকে পাশ কাটিয়েই এর সাহায্য আমাদের নিতে হবে। মানবজাতির মুখোমুখি হওয়া সবচেয়ে জটিল এবং চাপের বিষয়গুলি সম্পর্কে চিন্তা করেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে আমাদের সমাধান খুঁজতে হবে। দারিদ্র্য হ্রাস, শিক্ষার উন্নতি, স্বাস্থ্যসেবা সরবরাহ, মারণ রোগ নির্মূল করা, জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা এবং দ্রুত বর্ধনশীল বিশ্ব জনসংখ্যাকে খাওয়ানোর জন্য পর্যাপ্ত খাদ্য বৃদ্ধির মতো টেকসই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করাটাই যখন আমাদের মানবিক লক্ষ্য।

জ্ঞানীয় পুঁজিবাদের সমকালীন ধারা অবশ্য জীবন বাঁচানো, দুর্ভোগ লাঘব করা এবং মানুষের সম্ভাব্যতা প্রকাশের ক্ষেত্রে প্রাসঙ্গিক চ্যালেঞ্জগুলির সমাধান খুঁজে পাওয়ার সম্ভাবনাগুলিকে জানান দিচ্ছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সমকালীন ব্যবহার সেটা দাবি করলেও, ইঞ্জিনিয়ারিং এবং লিবারেল আর্টসের সংযোগস্থলে শোষণের একমুখীকরণ চিহ্ন আজও দৈনন্দিন জীবনের ক্ষত হয়েই রয়ে যায়।

জীবন্ত লাশ হতে থাকে মানব সভ্যতা। মৃত্যু সেখানে এখনও নিস্তব্ধতায় নেমে আসে। 

- লেখক ফরাক্কা এসএনএইচ কলেজের সমাজবিদ্যার অধ্যাপক, মতামত লেখকের ব্যক্তিগত

স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন

Related Stories

No stories found.
logo
People's Reporter
www.peoplesreporter.in