দেশভাগ দাঙ্গা নিজ বাসভূম ছেড়ে ছিন্নমূল মানুষের স্রোতের মধ্যদিয়ে যে স্বাধীনতা আমরা পেয়েছিলাম তার পঁচাত্তর বছর পূর্ণ হলো এই পনরোই আগস্ট। সেদিনের ইতিহাস যতোই যন্ত্রণাদায়ক রক্তাক্ত হোক না কেন, স্বাধীনতার পঁচাত্তর বছরের মুহূর্ত যেকোনো দেশের ক্ষেত্রেই আবেগের গৌরবের। ভারতের বিচারে এটা আরেকটু বেশিই। কেননা প্রায় দুশো বছর ধরে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে এক মহাকাব্যিক লড়াইয়ের মধ্যদিয়ে অর্জিত এই স্বাধীনতা। বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে বলা যায় এক অনন্যসাধারণ।
স্বাধীনতা পঁচাত্তরের উদযাপনের তোড়জোড়ের শুরু গত বছরের পনরোই আগস্ট থেকেই। একেবারে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় উদ্যোগে বিস্তৃত পরিসরে। ‘আজাদি কা অমৃত মহোৎসব’ মোদি সরকারের এই বৃহৎ উদযাপন-আয়োজনের ট্যাগ লাইন। ঠিক বিপণন দুনিয়ার আদলে। মোদি সরকারের বিজ্ঞাপনপ্রিয়তা সর্বজনবিদিত। তাই স্বাভাবিকভাবে এইরকম একটা গ্রান্ড ইভেন্টকে তারা যে হাতছাড়া করবে না এটাই প্রত্যাশিত ছিল। বাস্তবে হয়েছেও তাই।
সরকারি ক্ষমতা অর্থকে ব্যবহার করে এই মহোৎসবের প্রচারে সঙ্ঘের ব্রান্ড রাজনীতি উগ্র জাতীয়তাবাদের বিপণন চলছে একেবারে করপোরেট কায়দায়। ১৯৪৭ সালের ১৪ আগস্ট আরএসএসে'র মুখপত্র ‘অরগানাইজার’ লিখেছিল, ‘তিন সংখ্যাটা হিন্দুদের কাছে অশুভ। তাই তিন রঙের জাতীয় পতাকা দেশের পক্ষে অশুভ ক্ষতিকর। হিন্দুরা কখনই একে সম্মান করবে না।’ পঁচাত্তর বছর পর তাদেরই সরকার আজাদি কা অমৃত মহোৎসবে ডাক দিয়েছে ‘হর ঘর তিরাঙ্গা’ কর্মসূচির। ১৩ থেকে ১৫ আগস্ট এই কর্মসূচি সফলে দেশজুড়ে চলেছে অঢেল সরকারি বিজ্ঞাপন। সঙ্গে চলেছে হুমকিও— ঘরে জাতীয় পতাকা না তুললে দেগে দেওয়া হবে দেশদ্রোহী হিসেবে।
গত কয়েক বছরে হিন্দুত্ববাদী রাজনীতির বিরোধিতাকে যখন দেশদ্রোহী হিসেবে চিহ্নিত করতে সফল হয়েছে এই সরকার, তখন ঘরে জাতীয় পতাকা না তোলাকে দেশদ্রোহী আখ্যায়িত করা তাদের পক্ষে অনেক সহজ। হরিয়ানা এবং আসামে তো ফতোয়াই জারি হয়ে গেছে, রেশন পেতে গেলে জাতীয় পতাকা কেনা বাধ্যতামূলক। এই দুই রাজ্যেই বিজেপি সরকার। স্বাধীনতার পঁচাত্তরের মহোৎসবে এসবের মধ্য দিয়ে আজাদির কোন অমৃত স্বাদ দেশের আম জনতা পাচ্ছে তা হয়তো বিধাতাই জানেন। তবে এই হর ঘর তিরঙ্গা কর্মসূচীর মধ্যে অন্য ইঙ্গিত মিলছে।
২০২১ সালের ডিসেম্বর মাসে ফ্ল্যাগ কোডে সংশোধনী আনে সরকার। তখন বোঝা যায়নি এই সংশোধনীতে কী উদ্দেশ্য লুকিয়ে আছে। বলা হয়, খাদি, সুতি ছাড়াও পলিয়েস্টার ব্যবহার করা যাবে ফ্ল্যাগে। আমরা তো সবাই জানি, দেশের সর্ববৃহৎ পলিয়েস্টার উৎপাদক সংস্থা কোনটি। এবং তার মালিকের সঙ্গে মোদির সম্পর্কটাও। বোঝাই যাচ্ছে, তাদের বিরাট মুনাফার সুযোগ করে দিতেই দেশপ্রেমের আড়ালে এই কর্মসূচি নিয়েছে সরকার। বিমুদ্রাকরণের ঘোষণার পরও দেশবাসী দেখেছিল, প্রধানমন্ত্রী মোদিকে ডিজিটাল লেনদেনের কোম্পানি পেটিএমের পাতাজোড়া বিজ্ঞাপনে নিজেকে হাজির করতে।
আসলে ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের সঙ্গে আরএসএস'র কোনো মৌলিক সম্পর্ক কোনোদিনই ছিল না। তাই স্বাধীনতার আবেগের সাথে প্রতারণা করতে তাদের নৈতিকতায় বাধে না। তাদের নেতা হেগড়েওয়ার মনে করতেন, ব্রিটিশদের বিরুদ্ধে লড়াই করে শক্তিক্ষয় করার চেয়ে তা সঞ্চয় করে রাখা দরকার অভ্যন্তরীণ শক্র মুসলিম, কমিউনিস্ট ও খ্রিস্টানদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য। আন্দামানের জেল থেকে মুক্তির জন্য সাভারকরের মার্সি পিটিশনের কথাতো দেশবাসীর জানা। সাভারকর জানিয়েছিলেন, তিনি ব্রিটিশ শক্তির সহায়ক হিসেবে কাজ করবেন। এমনকী তিনি ব্রিটিশদের কাছ থেকে প্রতি মাসে টাকাও পেতেন তাদের সাহায্য করার জন্য।
প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী বাজপেয়ী ১৯৪২ সালে ভারত ছাড়ো আন্দোলনে তাঁর পৈতৃক গ্রাম বতেশ্বরে গ্রেপ্তার হয়েছিলেন। পরে ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে বিবৃতি দিয়ে জানান, তিনি আন্দোলনে ছিলেন না। কিন্তু তিনি দেখেছেন লীলাধর বাজপেয়ী এবং আরেকজনের নেতৃত্বে স্থানীয় ফরেস্ট অফিসে ভাঙচুর হয়েছে। এই বিবৃতির ভিত্তিতে অটল ছাড়া পান কিন্তু লীলাধরের পাঁচ বছরের জেল হয়। পুরো গ্রামের ১০ হাজার টাকা জরিমানা হয়। এই বেইমানির ইতিহাস হিমশৈলের চূড়া মাত্র। স্বাধীনতা সংগ্রামের পুরো সময়টাজুড়ে আরএসএস'র ইতিহাস হলো বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস। তারা চেয়েছিল, পাকিস্তান যেমন ইসলামিক রাষ্ট্র হয়েছে, তেমনি হিন্দু রাষ্ট্র হোক ভারত। ভারত ধর্মনিরপেক্ষ দেশ হিসেবে আত্মপ্রকাশ করায় তারা হতাশ হয়। সেই হতাশারই বহিঃপ্রকাশ ছিল তাদের হাতে গান্ধীজির মৃত্যু।
তবে স্বাধীন ভারতে গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য ছিল ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধান এবং সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গ্রহণ। আরএসএস সহ দেশের হিন্দুত্ববাদী শক্তি সংবিধান তৈরির প্রক্রিয়ায় অংশ নেয়নি। তারা প্রকাশ্যেই এই সংবিধানের বিরোধিতা করত। স্বাধীনতা আন্দোলনে কংগ্রেসের নেতৃত্বে জাতীয়তাবাদী, সশস্ত্র বিপ্লবী এবং কমিউনিস্ট-বামপন্থী ধারা স্বাধীন ভারত সম্পর্কে যে ভাবনাগুলি লালনপালন করে এসেছিল সেগুলির প্রতি কংগ্রেস খুব একটা যে গুরুত্ব দেয়নি সেকথা মিথ্যা নয়।
তবুও দেশের ধর্মনিরপেক্ষ চরিত্রকে অক্ষুণ্ণ রাখা এবং রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের ওপর ভিত্তি করে স্বনির্ভর অর্থনীতি গড়ে তোলার চেষ্টা জওহরলাল নেহরু করেছিলেন। এই দুটিরই চরম বিরোধী হিন্দুত্ববাদী শক্তি। তাই বর্তমান সময়ও বিজেপি এবং নরেন্দ্র মোদির রাজনৈতিক আক্রমণের মূল লক্ষ্য থাকে সবসময় নেহরু। এ প্রসঙ্গে একটা বিষয় উল্লেখ করতেই হবে যে, স্বাধীনতা আন্দোলনের প্রতিশ্রুত বিষয়গুলির মধ্যে ভূমিসংস্কার, শ্রমিকদের অধিকার, গণতান্ত্রিক ও অবৈতনিক শিক্ষার প্রচলনের মতো বিষয়গুলিতে যুগান্তকারী কাজ করেছে কেরালা, পশ্চিমবঙ্গ এবং ত্রিপুরার বাম সরকারগুলি। যা দেশের কেন্দ্রীয় সরকারের করার কথা ছিল।
রথযাত্রা ও বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মধ্য দিয়ে হিন্দুত্ববাদী শক্তির উত্থান এবং নয়া-উদারনীতির পথে দেশের চলা শুরু সমসাময়িক ঘটনা। হিন্দুত্ববাদী শক্তি দ্বারা বাবরি মসজিদ ধ্বংস দেশের ধর্মনিরপেক্ষ কাঠামোর ওপর ছিল সবচেয়ে বড়ো আঘাত। কংগ্রেস এর দায় অস্বীকার করতে পারেনা। একইভাবে রাষ্ট্র নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতির পথ থেকে সরে নয়া-উদারনীতির পথে দেশকে নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রেও প্রধান ভূমিকা ছিল কংগ্রেসের। তৎকালীন আন্তর্জাতিক পরিস্থিতির বাধ্যবাধকতায় এর বাইরে ভাবা হয়তো কংগ্রেসের পক্ষে সম্ভব ছিল না, কিছু বিকল্প পথ হয়তো গ্রহণ করা যেত। সে বাস্তবতা ভারতের ক্ষেত্রে ছিল। কংগ্রেস সেই দৃঢ়তা দেখাতে ব্যার্থ হয়েছিল।
নয়া-উদারনীতি যেমন অর্থনীতিতে রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণকে শিথিল করে, একইভাবে দুর্বল করেছে রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পকে। এই রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্প শুধু দেশের অর্থনীতির বুনিয়াদ ছিল না, গণতন্ত্রকেও শক্তিশালী করতে সাহায্য করেছিল। এই ধারণা কল্যাণমূলক অর্থনীতির ভিত্তি ছিল। ১৯৯১ সালের জুলাই মাসে নরসিমা রাওয়ের সরকার যখন এই নীতির প্রয়োগ শুরু করল তখন বিজেপি বলেছিল তাদের ভাবনা হাইজ্যাক করেছে কংগ্রেস। নরেন্দ্র মোদির জমানায় যেভাবে উদারনীতির আগ্রাসী প্রয়োগ চলছে তাতে দেশবাসী বুঝতে পারছে সেদিনের বিজেপি'র কথা কতোটা সত্য ছিল।
এই নয়া-উদারনীতি আন্তর্জাতিক পুঁজির সাথে দেশীয় পুঁজির গাঁটছড়া বাঁধার একটা নতুন সুযোগ এনে দেয়। গত তিন দশকে এই নীতির অবাধ প্রয়োগ দেশীয় পুঁজিপতিদের ব্যাপক শক্তিবৃদ্ধি করেছে। কংগ্রেসের ধর্মনিরপেক্ষতার নীতির সাথে বারবার আপস, দুর্নীতি, জনগণের রুজি রোজগারের ওপর আক্রমণ এবং ভুল রাজনীতি হিন্দুত্ববাদীদের উত্থানে অনুঘটকের কাজ করে। মুনাফা শোষণ লুটকে অবাধ করতে দেশের পুঁজিপতিরাও তাদের প্রকৃত মিত্রকে খুঁজে পায় বিজেপি'র মধ্যে। তাদের মধ্যে গড়ে ওঠে শক্তিশালী আঁতাত। এর মধ্যদিয়েই আরএসএস'র নেতৃত্বে হিন্দুত্ববাদী শক্তি দেশের ক্ষমতা দখল করেছে। এখন আরএসএস তার অ্যাজেন্ডার রূপায়ণ করছে। যার মূল লক্ষ্য দেশকে হিন্দু রাষ্ট্রে পরিণত করা। তাই রামমন্দির নির্মাণের পক্ষে আদালতে রায় হয়। মন্দির নির্মাণের আইন সংসদে পাশ হয়। ধর্মনিরপেক্ষ রাষ্ট্রের প্রধানমন্ত্রী সেই মন্দির নির্মাণের শিলান্যাস করতে যান।
দেশে বর্তমান এই সংসদীয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাও কোনোদিনই হিন্দুত্ববাদীদের পচ্ছন্দের ছিল না। তাই মোদি জমানায় ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাচ্ছে সংসদের অধিবেশনের দিন সংখ্যা। সংসদে কোনো আলোচনা ছাড়াই একের পর এক বিল পাশ হয়ে যাচ্ছে। জনগণের নাগরিক অধিকার, বিরোধিতা করার অধিকার, ব্যক্তি স্বাধীনতা সহ সংবিধানে বর্ণিত অধিকারগুলির ওপর আক্রমণের সাথেই সংসদীয় ব্যবস্থাকেও ধ্বংস করার দিকে এগোচ্ছে আরএসএস'র নেতৃত্বাধীন বিজেপি সরকার। আরএসএস ভালোভাবেই জানে দেশের সংবিধানকে বাঁচিয়ে রেখে তাদের হিন্দুরাষ্ট্র সহ কোনো স্বপ্নই সফল হবার নয়। একইভাবে স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্যও তাদের লক্ষপূরণে বড়ো প্রতিবন্ধকতা। আজাদি কা মহোৎসবের নানা কর্মসূচির মধ্যদিয়ে আসলে লক্ষ্য রয়েছে সেই প্রতিবন্ধকতা দূর করা; স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্যকে, ইতিহাসকে ভুলিয়ে দেবার, বিকৃতভাবে ব্যাখ্যা করা। স্বাধীনতা আন্দোলনে দেশবাসীর আত্মত্যাগ, আবেগকে তাই প্রতিক্ষণে আঘাত করা হচ্ছে, অসম্মানিত করা হচ্ছে।
- লেখক দেশহিতৈষী পত্রিকার সাংবাদিক, মতামত লেখকের ব্যক্তিগত
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন