১৯৪৭ খ্রিস্টাব্দের ১৫-ই আগস্ট। কান্নুর জেলে দেখা গেল এক আশ্চর্য দৃশ্য। সকালে যে সময়টা কয়েদিদের কিছুক্ষণ কারাকক্ষের বাইরে রাখা হয়, তখনই দেখা গেল একটা ত্রিবর্ণ পতাকা হাতে কারাগারের এক প্রান্ত থেকে আরেক প্রান্তে হেঁটে যাচ্ছেন এক বন্দি। তাঁকে ঘিরে রয়েছে অন্যান্য কয়েদিদের একটি দল। পুলিশকে অগ্রাহ্য করে কান্নুর জেলের ছাদে উঠে বন্দিরাই সেদিন উড়িয়ে দিয়েছিল ত্রিবর্ণরঞ্জিত জাতীয় পতাকা (যদিও তা অশোক চক্র নয়, চরকাখচিত)। পতাকা উত্তোলন করে তার ছায়ায় দাঁড়িয়েই স্বাধীনতার অর্থ নিয়ে সহবন্দিদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা দিয়েছিলেন সেই ব্যক্তি যাঁর হাতে এতক্ষণ পতাকা শোভা পাচ্ছিল। কারাগারে বন্দি থাকার সময়ও গোপনে একটি তিরঙ্গা তিনি নিজের কাছে রেখে দিয়েছিলেন। এই কর্মসূচীর পরিকল্পনা ও নেতৃত্বপ্রদানও করেছিলেন তিনি। জেল কর্তৃপক্ষ বন্দির এই দুঃসাহস মোটেই ভালো ভাবে নেয় নি। স্বাধীন ভারতে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্যও কারাগারে তাঁকে সহ্য করতে হয়েছিল অত্যাচার। কে ছিলেন এই বন্দি ? তিনি প্রখ্যাত কমিউনিস্ট নেতা আইল্লাথ কুট্টেরী গোপালন নাম্বিয়ার, যাঁকে আমরা এ.কে. গোপালন বলে চিনি।
এ.কে. গোপালন জন্মগ্রহণ করেন কেরলের উত্তর মালাবারের মাকেরী গ্রামে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দের ১-লা অক্টোবর। তাঁর বাবা ও দাদা দুজনেই কেরলার সমাজ সংস্কার আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিশেষ করে তাঁর বাবা ভি. কে. রাইরু নাম্বিয়ার ছিলেন উত্তর মালাবারের নায়ার সোসাইটির সম্পাদক। এই কারণে অল্প বয়স থেকেই সমাজ সংস্কারের প্রতি গোপালনের একটি আগ্রহ গড়ে ওঠে। তাঁর পিতা যে মাসিক পত্রিকা সম্পাদনা করতেন, তার কাজকর্মের প্রতিও বালক গোপালনের গভীর আকর্ষণ ছিল। কিশোর বয়সেও তিনি ছিলেন বাবার ছায়াসঙ্গী। স্থানীয় বোর্ডের নির্বাচনে তাঁর পিতা অংশগ্রহণ করলে সেই সূত্রে গোপালনের অল্প বয়সেই রাজনীতি সম্পর্কে একটি ভালো ধারণা তৈরি হয়ে গিয়েছিল।
পিতার কাজে সাহায্য করার পাশাপাশি গোপালনের পড়াশোনাও চলতে থাকে। গোপালন প্রথমে বাসেল জার্মান মিশন পার্সি স্কুল এবং তেলিচেরীতে ব্রেনেন কলেজে পড়াশোনা করেন। স্কুলে পড়ার সময়েই তিনি কংগ্রেসী রাজনীতির প্রতি আকর্ষিত হন। এই সময়ে কয়েকজন কংগ্রেস নেতা কারামুক্ত হয়ে তেলিচেরীতে আসলে তাঁদের বিপুল সম্বর্ধনা প্রদান করা হয়। এই অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করার জন্য গোপালন এবং তাঁর বন্ধুদের শাস্তি পেতে হয়েছিল। যাই হোক পড়াশোনা শেষ করে তিনি শিক্ষকতার কাজে যোগ দেন। প্রায় সাত বছর তিনি শিক্ষকতা করেছিলেন।
ছাত্র থাকাকালীনই গোপালন ক্রমশঃ গান্ধীবাদী রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিলেন। বিশেষ করে খাদি আন্দোলন নিয়ে তাঁর অসম্ভব উৎসাহ ছিল। ছুটির দিনে গোপালন গ্রামে গ্রামে গিয়ে খাদি ও স্বদেশীর প্রচার করতেন। তাঁর মনে হয়েছিল ব্রিটিশ ব্যাঘ্রের যে সর্বাপেক্ষা ভয়ানক শ্বদন্ত হল দেশের টুঁটি চেপে ধরে আছে, তা হল তার অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদ, যা দেশের মানুষকে নিঃস্ব করে দিচ্ছে। তাঁর রাজনৈতিক বিকাশের এই পর্যায়ে গোপালনের মনে হয়েছিল বিদেশী দ্রব্য বয়কট, স্বদেশীর প্রচার এবং চরকার প্রচলনের মাধ্যমে অর্থনৈতিক সাম্রাজ্যবাদের এই মারণ কামড় থেকে দেশকে মুক্ত করা সম্ভব। অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর গান্ধীজি সম্পর্কে অনেকেরই মোহভঙ্গ হয়েছিল, কিন্তু গোপালন তখনও মহাত্মার কট্টর সমর্থক ছিলেন এবং ১৯৩০-এর দশক পর্যন্ত চরকা প্রচলন, খাদির প্রচার ও স্বদেশী দ্রব্যের প্রসার এই তিন নিয়েই ছিল তাঁর রাজনীতি।
১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে মহাত্মা গান্ধী লবণ সত্যাগ্রহ শুরু করলে গোপালন তাতে যোগদান করেন। ডান্ডি যাত্রাকে অনুসরণ করে কেরলার কংগ্রেস নেতা কে. কেলাপ্পনের নেতৃত্বে কালিকট থেকে প্যায়ানুর অবধি একটি জাঠা সংগঠিত হয়। গোপালন ছিলেন এই মিছিলের সম্মুখে। তিনি এই আইন অমান্য আন্দোলনের প্রেক্ষিতেই স্থির করেন আর শিক্ষকতার চাকরি করবেন না, জাতীয় আন্দোলনই হবে তাঁর একমাত্র ধ্যানজ্ঞান। এই ভাবেই জাতীয় আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়লেন তিনি। কালিকটে লবণ সত্যাগ্রহে অংশগ্রহণ করার সময়েই গোপালন গ্রেপ্তার হন। তাঁর গ্রেপ্তারের খবর আসতেই তাঁর স্কুলের ছাত্ররা তাদের ভূতপূর্ব শিক্ষকের মুক্তির দাবীতে শুরু করে স্বতঃস্ফুর্ত আন্দোলন। শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের মধ্যে তিনি কতটা জনপ্রিয় ছিলেন এই ঘটনা ছিল তার প্রকৃষ্ট নিদর্শন।
জেল থেকে গান্ধী-আরউইন চুক্তির ফলে কংগ্রেস কর্মীদের মুক্তি দেওয়া হয়। গোপালনও মুক্তি লাভ করেন। মুক্তি পেয়েই তিনি ওয়েনাড়ে কংগ্রেস পার্টির সংগঠন গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। এই সময় ১৯৩২ সালে পুনা চুক্তির প্রেক্ষিতে গান্ধীজি অস্পৃশ্য হরিজনদের অধিকারের জন্য নতুন করে আন্দোলনের ডাক দেন। গোপালন সোৎসাহে সেই আন্দোলনে সাড়া দেন। তিনি অস্পৃশ্যতার বিরুদ্ধে গ্রামে গ্রামে আন্দোলন গড়ে তুলতে থাকেন। তৎকালীন কেরলার সামাজিক পরিস্থিতির প্রেক্ষিতে এই কাজটি সহজ ছিল না। কান্ডোথ থেকে প্যায়ানুর পর্যন্ত অস্পৃশ্যদের নিয়ে তিনি এক বিশাল মিছিলের নেতৃত্ব প্রদান করেন। বর্ণবাদীরা এই মিছিলে হামলা চালালে গোপালন গুরুতর জখম হন। কিন্তু কোনো আঘাতই তাঁকে দমিয়ে রাখতে সক্ষম হয়নি। তিনি কিছুদিন বাদেই আবার দ্বিগুণ উৎসাহে হরিজন আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন।
গোপালনের উদ্যোগেই কেরলা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটিতে গুরুভাইয়ুর মন্দিরে অস্পৃশ্য হরিজনদের প্রবেশের দাবীতে সত্যাগ্রহকে সমর্থন করার প্রস্তাব গ্রহণ করে। এই সিদ্ধান্তকে বাস্তবায়িত করতে মাঠে নামেন গোপালন স্বয়ং। মন্দিরে প্রত্যেক জনজাতির প্রবেশের দাবীতে তাঁর নেতৃত্বেই সত্যাগ্রহীরা মন্দিরের প্রধান দরজায় পিকেটিং শুরু করে। এই আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদানের জন্য গোপালন গ্রেপ্তার হলেন। তিনি মাত্র তিন মাস বন্দি ছিলেন, কিন্তু এই সময়েই কারাগারে তাঁর উপর অকথ্য অত্যাচার চালানো হয়। এই কারাগারেই তাঁর পরিচয় হয় আরেক গান্ধীবাদী সত্যাগ্রহী পি. কৃষ্ণ পিল্লাই-এর সঙ্গে। পিল্লাই গান্ধীবাদী হলেও এই সময়ে তিনি কংগ্রেসের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বীতশ্রদ্ধ হয়ে এবং কংগ্রেসের মাধ্যমে কোনো সত্যিকারের বৈপ্লবিক পরিবর্তন সম্ভব নয় এই সিদ্ধান্ত থেকে সাম্যবাদী ও সমাজতন্ত্রী ভাবধারার নিকটবর্তী হচ্ছিলেন। গোপালন তাঁর দ্বারা গভীর ভাবে প্রভাবিত হন। তিন মাস জেলে থাকার পর তিনি যখন বাড়ি ফিরে আসলেন, তখন তাঁর শরীর দুর্বল, ওজন প্রায় বত্রিশ পাউন্ড কমে গেছে। কিন্তু দেখা গেল ওই শরীরেই মাত্র কয়েক সপ্তাহ বাদেই তিনি আবার গুরুভাইয়ুর-এ ফিরে গিয়ে আন্দোলনে যোগ দিয়েছেন। গোপালন আবার গ্রেপ্তার হলেন। এবার তাঁকে রাখা হল বেল্লারী জেলে। কিছুকাল পরে তিনি সেখান থেকে মুক্তি লাভ করেন।
ইতিমধ্যে ১৯৩৪ সালে পাটনায় কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টি প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। আইন অমান্য আন্দোলনের পর বাবু রাজেন্দ্রপ্রসাদের মতো কংগ্রেসী দক্ষিণপন্থী নেতাদের আচরণ গোপালন ভালো ভাবে নেননি। বিশেষ করে কংগ্রেসের দক্ষিণপন্থীরা শ্রমিক কৃষকদের যে অর্থনৈতিক সংগ্রাম, তাকে জাতীয় সংগ্রামের সঙ্গে যুক্ত করার বিপক্ষে অবস্থান গ্রহণ করায় গোপালন অত্যন্ত ক্ষুব্ধ হন। এই সময় জয়প্রকাশ নারায়ণ, রাম মনোহর লোহিয়া, আচার্য নরেন্দ্র দেব প্রমুখের রাজনীতির সঙ্গে তিনি অনেক একাত্ম বোধ করেন। এই প্রেক্ষিতেই তিনি কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। কংগ্রেস সোশ্যালিস্টরা তখন কংগ্রেসের মধ্যেই কাজ করতেন। গোপালনও তাই করলেন। তিনি এই সময় কেরলা প্রদেশ কংগ্রেস কমিটির সম্পাদক নিযুক্ত হন। শ্রমিক ও কৃষক শ্রেণীর সামাজিক ও অর্থনৈতিক অবস্থা নিয়ে এই সময় থেকেই তিনি গভীর অধ্যয়ন শুরু করেন। যত অধ্যয়ন করেন, ততই তিনি গ্রামাঞ্চলে কৃষকদের জমিদারী শোষণ ও শহরে পুঁজিপতিদের শ্রমিক শোষণকে আরও গভীর ভাবে বুঝতে পারেন। মার্কসবাদের প্রতি তাঁর আকর্ষণ এই শোষণের চরিত্র বোঝার পথ সন্ধান করার সূত্রেই বৃদ্ধি পায়। ধীরে ধীরে গোপালন গান্ধীবাদী রাজনীতির পথ থেকে একেবারেই সরে আসেন। সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য হিসেবে তিনি কেরলে ট্রেড ইউনিয়ন গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন। একসময় যেভাবে দিনে প্রায় পঁচিশ তিরিশ মাইল হেঁটে, গ্রামে গ্রামে ঘুরে তিনি খাদির আদর্শ প্রচার করতেন, ঠিক একই ভাবে সাবান কারখানা, কাপড়ের মিল, বিড়ি শিল্প সব জায়গায় শ্রমিক সংহতির বার্তা নিয়ে ঘুরতে থাকলেন গোপালন। কেরলায় নারকেল দড়ি শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা বিশেষ করে এই সময় ভয়াবহ ছিল। গোপালন দিনের পর দিন তাঁদের সঙ্গে কাটিয়ে, তাঁদেরই একজন হয়ে, তাঁদের আস্থা অর্জন করে এঁদের সংহত করলেন দেশী ও বিদেশী শোষকদের বিরুদ্ধে। এই কার্যাবলীকে গোপালন জাতীয় সংগ্রামের অবিচ্ছেদ্য অংশ বলে মনে করতেন।
এই সময় কেরলায় দেখা দিল দুর্ভিক্ষ। দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষদের নিয়ে তেলিচেরী থেকে মাদ্রাজের উদ্দেশ্যে জাঠার আহ্বান করা হল। নেতৃত্ব দিলেন গোপালন। ৯৬৬ কি.মি পথ অতিক্রম করে এই জাঠা মাদ্রাজে পৌঁছলে ভীষণ আলোড়ন সৃষ্টি হয়। হাজার হাজার মানুষ ভিড় করে গোপালনের কথা শুনতে আসতেন। এই সময় গোপালনকে সাহায্য করতেন আরেক সোশ্যালিস্ট এবং পরবর্তী কালে কমিউনিস্ট পার্টিতে তাঁর সহকর্মী পি. রামমূর্ত্তি। অচিরেই জাঠার নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আবার গ্রেপ্তার হলেন গোপালন। তাঁর কারাদন্ড হল নয় মাসের। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে গোপালন আবার ঝাঁপিয়ে পড়লেন সোশ্যালিস্ট আন্দোলনে। কিন্তু এই সময়েই তাঁর ক্রমশঃ সোশ্যালিস্ট পার্টির নেতৃত্ব সম্পর্কে একপ্রকার হতাশা তৈরি হচ্ছিল। তাঁর মনে হয়েছিল সোশ্যালিস্ট দলের নেতারা নামেই সমাজতন্ত্রী, বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রের আদর্শের থেকে গান্ধীবাদের প্রতিই তাঁদের যেন আনুগত্য অধিক। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে সকল সোশ্যালিস্ট নেতাকেই শ্রদ্ধা করতেন। বিশেষ করে জয়প্রকাশ নারায়ণকে। কিন্তু এই সময়ে বোম্বেতে ট্রেড ইউনিয়নে কমিউনিস্ট পার্টির কার্যকলাপ দেখে তাঁর এই দলের প্রতি আকর্ষণ বৃদ্ধি পায়। শুধু গোপালনের নয়, সমগ্র কেরলা সোশ্যালিস্ট পার্টিরই কমিউনিস্টদের প্রতি এই সহানুভূতি ছিল। তাঁরা ১৯৩৯ সালে কেরলা সি.এস.পি-এর পিনারাই মিটিং-এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন যে তাঁরা কংগ্রেস সোশ্যালিস্ট পার্টির সদস্য হলেও কমিউনিস্টদের সঙ্গে কাজ করবেন। এইভাবে কমিউনিস্ট পার্টি এই মিটিং-এর প্রেক্ষিতে দক্ষিণ ভারতের তিনজন অত্যন্ত পোড় খাওয়া স্বাধীনতা সংগ্রামীকে তাঁদের সমর্থক হিসেবে লাভ করলেন - ই.এম.এস নাম্বুদিরিপাদ, পি. কৃষ্ণ পিল্লাই এবং এ.কে গোপালন। দক্ষিণ ভারতের প্রায় সমগ্র সোশ্যালিস্ট সংগঠনই কমিউনিস্টদের দিকে চলে যায় এই সময়কালেই। গোপালন এই কালপর্বে ত্রিবাঙ্কুর-এর গণআন্দোলনেও উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেন।
১৯৪০ খ্রিস্টাব্দে যখন জয়প্রকাশ নারায়ণ সোশ্যালিস্ট পার্টি থেকে কমিউনিস্টদের বহিষ্কার করেন, তখন অন্যান্য বহু সিএস.পি-এর কমিউনিস্ট নেতার মতো গোপালনও সরাসরি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করেন। কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগদান করার পর তিনি ত্রিচি, তাঞ্জাভুর, মাদুরাই-তে রেল শ্রমিকদের মধ্যে সংগঠনের কাজে নিয়োজিত ছিলেন। এই সময় পুলিশ তাকে গ্রপ্তার করে। কিছুদিনের মধ্যেই জেলখানা থেকে তিনি আরও চারজন কংগ্রেসের সঙ্গে পুলিশের চোখে ধোঁয়া দিয়ে পালিয়ে যেতে সক্ষম হন। এরপর থেকে ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত গোপালন লুকিয়ে সারা দেশ পরিভ্রমণ করেন। কখনো তিনি বিমার এজেন্ট, কখনও বা ইঁটভাটার ম্যানেজার রূপে তাঁকে দেখা যায়। ১৯৪৬ সালে কালিকট বিধানসভা কেন্দ্রের প্রার্থী হিসেবে পার্টির নির্দেশে প্রকাশ্যে আসার আগে অবধি ব্রিটিশ পুলিশ তাঁকে ধরতেও পারেনি। নির্বাসনে প্রতিদ্বন্দ্বীতা করার সময়েই গোপালন গ্রেপ্তার হন। স্বাধীনতা দিবস তিনি কারাগারেই উৎযাপন করেছিলেন। কি অভিনব ছিল সেই উদযাপন তার বর্ণনা এই লেখার শুরুতেই প্রদান করা হয়েছে।
স্বাধীনতা পরবর্তীকালে প্রবাদপ্রতিম কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে এবং পরবর্তীকালে ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি (মার্কসবাদী)-এর প্রতিষ্ঠাতা নবরত্নের একজন হিসেবে তাঁর যে ভূমিকা ছিল, তা ভোলার নয়। কিন্তু তাঁর সেই অবদান যথেষ্টই স্মরণ করা হয়। চর্চার অভাব রয়েছে স্বধীনতা পূর্ববর্তী কালে কমরেড এ. কে. গোপালনের একজন স্বাধীনতা সংগ্রামী হিসেবে যে অবদান রেখেছিলেন তা নিয়ে। অথচ কমরেড গোপালনের কাছে দেশের স্বাধীনতা সমাজতন্ত্রের পথে ছিল প্রথম ধাপ। সাম্যবাদে তাঁর বিশ্বাস ছিল তাঁর দেশপ্রেমেরই বহিঃপ্রকাশ ও সমাজতন্ত্র ছিল তাঁর স্বদেশপ্রেমের সঙ্গে অতপ্রোত ভাবে জড়িত। তাঁর নিজের ভাষাতেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে তিনি লেখেন – “Discard at least now your delusion that you can thwart man’s spirit of freedom with guns and swords and stone walls. We have a weapon that vanquishes all these: unalloyed patriotism and love for the working class. We will serve the people, no matter whether we starve or die.” তাই শুধু কমিউনিস্ট নেতা হিসেবে তাঁকে স্মরণ করলে সেই স্মরণ সম্পূর্ণ হয় না। তাঁকে এর পাশাপাশি স্মরণ করতে হবে একজন প্রথম শ্রেণীর দেশপ্রেমিক স্বাধীনতা সংগ্রামী রূপেও। স্বাধীনতার ৭৫ বছর উপলক্ষে তাঁর এই অবদানকে স্মরণ করার উদ্দেশ্যেই এই সংক্ষিপ্ত প্রবন্ধের অবতারণা। সেই উদ্দেশ্য পালনে যদি এই প্রবন্ধ বিন্দুমাত্র সফল হয়ে থাকে, তাহলে সেই সাফল্যই হবে লেখকের তরফ থেকে এই প্রথম শ্রেণীর দেশপ্রেমিক ও সত্যিকারের কমিউনিস্টের প্রতি শ্রদ্ধাঞ্জলি।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন