এবছরের ছ'ই ডিসেম্বর বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ত্রিশ তম দিবস ছিল। উনিশশো বিরানব্বই সালের ওই দিনে আরএসএস'র নেতৃত্বাধীন হিন্দুত্ববাদী শক্তি বাবরি মসজিদের তিনটি গম্বুজকেই শুধু ধূলোয় মিশিয়ে দেয়নি, ভারত সাধারণতন্ত্রের সংবিধানের অন্যতম মূল দুই স্তম্ভ গণতন্ত্র ধর্মনিরপেক্ষতার গোড়া ধরে নাড়িয়ে দিয়েছিল। আজকের দেশের পরিস্থিতি দেখে এটা বলা যেতেই পারে, গত তিন দশকে ভারত রাষ্ট্র এই ক্ষতের মেরামতি তো করে উঠতে পারেই নি, বরঞ্চ ওই স্তম্ভগুলির ভিত আরও নড়বড়ে হয়েছে। আর এখন তো কালের পাকচক্রে ওই ক্ষত যারা তৈরি করেছিল সেই হিন্দুত্ববাদী শক্তিই রাষ্ট্রক্ষমতায় গেঁড়ে বসেছে। এই ক্ষতগুলির বিস্তৃতিতেই তাদের আকাঙ্ক্ষিত হিন্দুরাষ্ট্রের লক্ষ্যপূরণের জমি মজবুত হবে। তাই সুনির্দিষ্ট পরিকল্পনামাফিকই শুরু হয়েছে আর্থ-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক সর্বক্ষেত্রে বিনির্মাণ। স্বাধীনতা সংগ্রামে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের মধ্য দিয়ে যে ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারগুলি ভারতবাসীরা পেয়েছিলেন তার বিনির্মাণ। চলছে সরকারের পরিপোষণায় অপবিজ্ঞান যুক্তিহীনের এক সর্বব্যাপী চর্চা।
তবে ক্ষত মেরামতি করার সময় ও সুযোগ দুই-ই যথেষ্ট পাওয়া গিয়েছিল। ত্রিশ বছরটা খুব একটা স্বল্প সময় নয়। দেশের ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক শক্তি তা হাতছাড়া করেছে। হিমালয়সমান দুর্বলতা থাকা সত্ত্বেও এখনও পর্যন্ত ঘোষিত অবস্থানের দিক থেকে কংগ্রেস দেশের সর্ববৃহৎ ধর্মনিরপেক্ষ ও গণতান্ত্রিক দল। আর সেই কারণেই এই অবস্থার জন্য তাদের দায়ই সবচেয়ে বেশি। কমিউনিস্ট-বামপন্থীদের একটা প্রচেষ্টা ছিল অবশ্যই। কিন্তু গত এক দশকে বাংলা, ত্রিপুরার মতো শক্ত ঘাঁটিগুলিতে তাদের শক্তির ধারাবাহিকভাবে হ্রাস ঘটেছে। মতাদর্শগত অবস্থানে দৃঢ় থাকলেও এই শক্তি হ্রাস তাদের প্রচেষ্টাগুলিকে দুর্বল করেছে। সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের বিষয়, ওইসব রাজ্যে বামপন্থীদের রাজনৈতিক শূন্যস্থান দখল করেছে বিজেপি ।
জনগণের একটা ভালো অংশের মধ্যে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের ঘটনার প্রকাশ্য বিরোধিতা ছিল। তাঁদের মধ্যে অনেকেই এর প্রতিবাদে রাস্তায় নেমেছিলেন। সাধারণত সবসময় রাস্তায় নেমে প্রতিবাদে অংশ নেওয়াটা প্রথমেই খুব বড়ো আকারে হয় না। বাবরি মসজিদ ধ্বংসের সময়েও এর ব্যতিক্রম হয় নি। এই প্রতিবাদকে প্রসারিত করার জন্য নিরবচ্ছিন্ন রাজনৈতিক প্রক্রিয়া জারি রাখাটা জরুরি। সেটা চলেছিল কিছুদিন। একটা বিষয় অবশ্যই উল্লেখনীয়, খুব গভীরভাবে না হলেও গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ মূল্যবোধের একটা অনুশীলন দেশের সামাজিক ও রাজনৈতিক ক্ষেত্রে তখনও বজায় ছিল। তাই বাবরি মসজিদের ধ্বংস কখনই সমর্থনযোগ্য হতে পারে না, এ ভাবনাই জনমানসে প্রশ্রয় পেয়েছিল। বলা যায় এটাই প্রাধান্যসৃষ্টিকারী ভাবনা ছিল। হিন্দুত্ববাদী রাজনৈতিক দল ও সংগঠনগুলি ছাড়া সমস্ত গণতান্ত্রিক ধর্মনিরপেক্ষ রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের রাজনৈতিক অবস্থান ছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে। জনমানসে ওই ভাবনা তৈরির পেছনে এই রাজনৈতিক দল-সংগঠনগুলিরও যে অবদান ছিল তা অনস্বীকার্য। এই রাজনৈতিক অনুশীলনে সর্বাগ্রে ছিলেন কমিউনিস্টরা,বামপন্থীরা এবং সমাজবাদীরা। স্বাধীনতা আন্দোলনের মোটাদাগের ঐতিহ্যগুলোকে মূলস্রোতের রাজনীতিতে সমষ্টিগতভাবে বহে নিয়ে যাওয়ার প্রচেষ্টাটা তখনও একেবারে বন্ধ হয়ে যায় নি, বাবরি মসজিদ ধ্বংসের বিরুদ্ধে দেশের রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের এই ইতিবাচক অবস্থান ছিল সামগ্রিকভাবে তারই একটা বহিঃপ্রকাশ।
তবে বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পক্ষে সমর্থন থাকা মানুষের সংখ্যাটাও যে সেসময়ে একেবারেই নগণ্য ছিল, ব্যাপারটা মোটেই সেরকম নয়। বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে ছ'ই ডিসেম্বর-উত্তর সময়ে দেশের অনেক জায়গায় ভয়াবহ ধর্মীয় দাঙ্গাও হয়। সেই দাঙ্গায় জীবনহানি ও সম্পত্তি ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণও কম ছিল না। তবুও এসব বিবেচনায় রেখেই বলা যায়, হিন্দুত্ববাদী শক্তি কিংবা জনগণের মধ্যে তাদের সমর্থন-ভিত্তি তখনও সমাজিক ক্ষেত্রে নির্ধারক শক্তি তো হয়ে ওঠেই নি, বরঞ্চ তারা কিছুটা কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল বাবরি মসজিদ ধ্বংসকে কেন্দ্র করে। যদিও পরবর্তীতে এসবের পরিণতিতে কেন্দ্র বা রাজ্যগুলিতে বিরাটভাবে ক্ষমতায় আসতে না পারলেও হিন্দুত্ববাদীদের মূল শক্তি হিসেবে বিজেপি যে কিছুটা নির্বাচনী ডিভিডেন্ট পেয়েছিল তাকে অগ্রাহ্য করা যাবে না। তৎকালীন কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকার কখনই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের দায় অস্বীকার করতে পারবে না। সে ইতিহাস আমরা জানি। তা নিয়ে আলোচনা নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু এসবের পরেও ভরতের রাজনৈতিক পরিমণ্ডল এবং ভারতের জনমানসের ইতিবাচক অবস্থান গ্রহণের পরিণতিতেই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের পর কেন্দ্রীয় সরকার এবং সামগ্রিকভাবে রাষ্ট্রের সমস্ত অংশ অন্তত ঘোষিতভাবে এর বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছিল। তাই দেশের হিন্দুত্ববাদী শক্তি তাদের কঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছতে একটা বড়ো ধাপ অতিক্রম করতে সফল হওয়ার পরও দেশজুড়ে উৎসবে শামিল হতে পারে নি। আর বৌদ্ধিক জগতে উনিশশো বিরানব্বই সালের ছ'ই ডিসেম্বরের ঘটনা স্বাধীন ভারতে অন্যতম কলঙ্কজনক অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত হয়েছিল।
বাবরি মসজিদ ধ্বংসের উনত্রিশ বছর পরের ছবিটা একেবারেই আলাদা। অনেকটা বিপরীতও। ধর্মনিরপেক্ষতার রাজনীতির চর্চা অনুশীলন যে সম্পূর্ণ স্তব্ধ হয়ে গেছে তা ঠিক নয়; বলা যায় ভারতীয় সমাজ-রাজনীতিতে তা আর প্রাধান্য সৃষ্টিকারী বিষয় নয়। অন্তত হালফিলের এটা প্রবণতা বলা যেতেই পারে। ভারতের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের সবচেয়ে বড়ো পাহারাদার দেশের সুপ্রিম কোর্ট বলে দিয়েছে, শতাধিক বছর ধরে বিতর্কিত অযোধ্যার ওই ২.৭৭ একর জমির আইনগত অধিকার রামলালারই। তার মন্দির ওখানেই হবে। ঐতিহাসিক প্রমাণের চেয়ে হিন্দুদের আস্থা ও বিশ্বাসের ওপরই বেশি ভরসা রেখেছে দেশের সর্বোচ্চ আদালত। কোর্টের নির্দেশ সরকার মন্দির তৈরির ট্রাস্ট গড়ে দেবে। কোর্টের নির্দেশে কেন্দ্রীয় সরকার ট্রাস্টও গড়ে দিয়েছে। আমাদের ধর্মনিরপেক্ষ সংবিধানের ওপর হাত রেখে শপথ নেওয়া প্রধানমন্ত্রী কোভিডের ভরা মরসুমে অযোধ্যায় রাম মন্দিরের শিলান্যাস করেছেন। যদি তর্কের খাতিরে ধরেও নেওয়া হয়, অযোধ্যায় হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে ১৫২৮ সালে বাবরের সেনাপতি মির বাকি বাবরি মসজিদ তৈরি করেছিলেন, তাহলেও কী বর্তমানের রাজনীতিকে বৈধতা দিতে আমরা অতীতকে পরিবর্তন করতে পারি! চাঁদ সওদাগরের বাঁ হাতে মনসার মাথায় ফুল দেওয়ার মতোই সুপ্রিম কোর্ট ওই রায়তে বলেছে, বাবরি মসজিদ ধ্বংস এবং ১৯৪৯ সালে মসজিদ অপবিত্র করা আইন ভঙ্গকারী ঘটনা ছিল। আর ২০২০ সালের ৩০ সেপ্টেম্বর ওই সুপ্রিম কোর্টই বাবরি মসজিদ ধ্বংসের মামলায় অভিযুক্ত এল কে আদবানি, উমা ভারতী সহ সকলকে বেকসুর খালাস দিয়েছে। বাবরি মসজিদ ধ্বংস দিয়ে হিন্দুত্ববাদীরা যে বিত্ত আঁকা শুরু করেছিল তা সম্পূর্ণের দিকেই এগোচ্ছে।
১৯৪৯ সালের ২৩ ডিসেম্বর হিন্দুত্ববাদী দুষ্কৃতীরা বাবরি মসজিদের কেন্দ্রীয় গম্বুজের তলায় রামলালার মূর্তি রেখে এসেছিল। তার তিন দিন পর প্রধানমন্ত্রী পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তৎকালীন উত্তর প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রী জি বি পন্থ-কে চিঠি দিয়ে নির্দেশ দিয়েছিলেন, এসব বদমায়েশি বন্ধ করতে হবে। তাঁর যুক্তি ছিল: “ একটা বিপজ্জনক নজির ওখানে তৈরি হয়েছে। যার পরিণতি খারাপ হবে।” আজকে মোদী-যোগীর যুগলবন্দিতে এ কল্পনাতেও আনা যায় না। নেহরুর এই উদাহরণের এখন শুধু ইতিহাসেই স্থান। তার চর্চাই নেই, অনুশীলন তো অনেক দূরের বিষয়। তাই আমাদের শুনতে হয় কোনো এক পদ্মশ্রী বিজয়ী অভিনেত্রীর কাছে যে, ২০১৪ সালে মোদি ক্ষমতায় আসার পরই ভারত প্রকৃত স্বাধীনতা পেয়েছে। এর সপক্ষে তথাকথিত সর্বভারতীয় চ্যানেলগুলিতে প্রাইম টাইমে চলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা প্যানেল ডিসকাশনও চলে।
ছ’বছর টানা শাসন চালানোর পর ২০০৪ সালে এনডিএ সরকারের পতন ঘটে। বিজেপি'র উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনীতি ও অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে উদারনীতির আগ্রাসী রূপায়ণের বিরুদ্ধে ওই জনাদেশ ছিল। বামপন্থীদের সমর্থনের ওপর কংগ্রেস নেতৃত্বাধীন ইউপিএ সরকার যতদিন নির্ভরশীল ছিল ততদিন তারা ওই দুটি বিষয়কে বিবেচনায় রেখেই নীতি প্রণয়ন করত। বলা যায় সরকার চালানোর দায়ে তা করতে তারা বাধ্য হয়েছিল। কিন্তু বামপন্থীরা সরকার থেকে সমর্থন তুলে নেওয়ার পর থেকেই ইউপিএ সরকার এসব ব্যাপারের গুরুত্বকে অনেক লঘু করে ফেলে। সার্বভৌম অর্থনীতি, পররাষ্ট্রনীতি, দুর্নীতিমুক্ত সরকার এবং শিক্ষা রাজনীতি প্রশাসন সহ সর্ব ক্ষেত্রে ধর্মনিরপেক্ষ সংস্কৃতির অনুশীলন দেশের গণতান্তিক ব্যবস্থাকে শক্তিশালী করে, সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে দুর্বল করে। পণ্ডিত নেহরু স্বাধীনতার পর সেটাই করার চেষ্টা করেছিলেন। দ্বিতীয় ইউপিএ সরকার যথেষ্ট সুযোগ ও ক্ষমতার অধিকারী হয়েও সেকাজে অমার্জনীয় অবহেলা দেখিয়েছে। সেই ছিদ্র পথেই হিন্দুত্ববাদী শক্তি ক্ষমতায় এসেছে, শক্তি বাড়িয়েছে। আর দেশজুড়ে এক সাম্প্রদায়িক সংস্কৃতির বাতাবরণ তৈরিতে সফল হয়েছে। এই উপরিকাঠামোর ওপর ভিত্তি করেই তাদের সমস্ত অপকর্ম আজ ন্যায্যতা পাচ্ছে। ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ঐতিহ্য ও উত্তরাধিকারগুলি এবং সংবিধানের মূল্যবোধগুলি ক্রমশ লঘু হচ্ছে, গুরুত্ব হারাচ্ছে। এর চর্চাকেও সেকেলের বিষয় হিসেবে তুলে ধরার সুপরিকল্পিত প্রয়াস চলছে।
তবে সব ছবিটাই এতটা হতাশাজনক নয়। সাম্প্রতিক ঐক্যবদ্ধ কৃষক আন্দোলন, শ্রমিক আন্দোলন কিছুটা আশার আলো দেখাচ্ছে অবশ্ই। অন্তত এই আন্দোলনগুলি উদার অর্থনীতি এবং সাম্প্রদায়িক নীতির বিরুদ্ধে জোরের সাথে কথা বলছে। জনগণকে তারা শামিল করতে, কিছু ক্ষেত্রে সরকারকে পিছু হঠতে বাধ্য করতে সফল হচ্ছে। আন্দোলনগুলিতে কমিউনিস্ট এবং বামপন্থীদের সরব উপস্থিতি রয়েছে। ইতিবাচক রাজনৈতিক পরিমণ্ডল নির্মাণের আন্দোলনগুলি একটা সম্ভাবনা তৈরি করেছে। এটাকে যেকোনো মূল্যে বাঁচিয়ে রাখতে হবে, শক্তিশালী করতে হবে হিন্দুত্ববাদীদের বিনির্মাণের রাজনীতিকে পরাস্ত করতে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন