শ্রম অধিকার নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ বিশ্বের খারাপ অবস্থায় থাকা ১০টি দেশের মধ্যে একটি। যেখানে শ্রমিকের অধিকারকে মারাত্মকভাবে লঙ্ঘন করা হয়, শ্রমিকদের ন্যূনতম অধিকারের নিশ্চয়তা নেই। গত ২৬ জুন ইন্ট্যারন্যাশনাল ট্রেড ইউনিয়ন কনফেডারেশন (আইটিইউসি) কর্তৃক প্রকাশিত 'দ্য গ্লোবাল রাইটস ইনডেক্স-২০২২' শীর্ষক এক প্রতিবেদনে এমন দাবি করা হয়েছে।
শ্রমিকের ধর্মঘট করার অধিকার; ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা, যোগদান ও লাইসেন্স প্রাপ্তির অধিকার; নির্বিচারে গ্রেপ্তার-আটক ও ন্যায়বিচার পাওয়ার অধিকার - এই চারটি বিষয়ে ১৪৮টি দেশের উপরে সমীক্ষা চালিয়ে প্রতিবেদনটি করা হয়েছে।
প্রতিবেদনে উল্লেখিত শ্রমিক অধিকার বাস্তবায়নে বাংলাদেশ বাদে বাকি খারাপ ৯টি দেশ হচ্ছে - বেলারুশ, ব্রাজিল, কলম্বিয়া, মিশর, এসওয়াতিনি, গুয়াতেমালা, মায়ানমার, ফিলিপাইন ও তুরস্ক। এই দেশগুলো শ্রমিকদের জন্য বিশ্বের সবচেয়ে খারাপ দশটি দেশ।
আইটিইউসি’র প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শ্রম অধিকার নিশ্চিতে বড় বাধা, পশ্চাদপসরণমূলক শ্রম আইন, ট্রেড ইউনিয়ন করতে প্রতিবন্ধকতা এবং শ্রমিকদের বিরুদ্ধে পুলিশি হিংসা।
আইটিইউসি’র প্রতিবেদন অনুযায়ী, বাংলাদেশে তৈরি পোশাক খাতে সাড়ে ৪ মিলিয়নেরও বেশি শ্রমিক কাজে নিয়োজিত। এই শ্রমিকদের কোনও ট্রেড ইউনিয়নের সাথে যুক্ত হতে বা কোনো ধরনের শ্রমিক সংগঠন করতে বাধা দেওয়া হয়।
প্রতিবেদন অনুসারে, বাংলাদেশে শ্রমিকদের হরতাল কর্মসূচিগুলো দমন করতে পুলিশ চরম বর্বরতার আশ্রয় নিয়ে থাকে। যেখানে অনেক শ্রমিক হত্যার শিকার হয়। অনেক শ্রমিক বিনা অপরাধে আটক হলেও তারা ন্যায়বিচার পায় না।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, বাংলাদেশে শিল্প পুলিশ চরম বর্বরতার সাথে হরতাল দমন করে থাকে। যেখানে শ্রমিকদের ছত্রভঙ্গ করার জন্য লাঠি চার্জ, টিয়ার গ্যাস, সাউন্ড গ্রেনেড, রাবার বুলেটসহ, গুলি পর্যন্ত চালানো হয়। শ্রমিকরা তাদের ন্যায্য দাবি আদায়ে শান্তিপূর্ণ প্রতিবাদের অধিকার থেকেও বঞ্চিত। এমনকি এসবের জন্য তাদেরকে ব্যাপকভাবে বরখাস্ত করা হয় এবং ফৌজদারি বিচারের মুখোমুখিও করা হয় বলে প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে।
সূচকে বলা হয়েছে, ১৪৮টি দেশের মধ্যে ১১৩টি দেশে শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা বা যোগদানের অধিকার থেকে বঞ্চিত করা হয়েছে - যা প্রায় ৭৭ শতাংশ। সমীক্ষাকৃত ১৪৮টি দেশের মধ্যে ৭৪ শতাংশ দেশে কর্তৃপক্ষ ইউনিয়নগুলোর নিবন্ধন প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত করেছে।
বাংলাদেশের শিল্প মালিকরা জানিয়েছেন, দায়িত্বশীল ট্রেড ইউনিয়ন নিয়ে তাদের কোনো আপত্তি নেই। এমনকি, শ্রম অধিকার নিয়ে আইটিইউসি'র এই প্রতিবেদন মানতে নারাজ বাংলাদেশের মালিক পক্ষ। প্রতিবেদনের দাবি অস্বীকার করে তারা বলছেন, এটি বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্র। এর ফলে শ্রমের ন্যায্য মূল পাওয়ার ক্ষেত্রে শ্রমিকের দর কষাকষির ক্ষমতা আরো হ্রাস পাবে।
সংবাদমাধ্যমকে দেওয়া সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশ নিটওয়্যার ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিকেএমইএ) নির্বাহী সভাপতি মোহাম্মদ হাতেম আইটিইউসি’র প্রতিবেদনকে মিথ্যা বলে অভিহিত করে বলেন, ‘প্রতিবেদনটি একটি বিদেশী তহবিল দ্বারা করা হয়েছে। এটি একটি গোষ্ঠীর আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের অংশ। যার উদ্দেশ্য হচ্ছে বাংলাদেশে একটি অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে আমাদের দেশের শিল্পের বিকাশে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা।’
তিনি আরও বলেন, শ্রমিকদের অধিকার রক্ষার জন্য ট্রেড ইউনিয়ন গঠনই একমাত্র সমাধান নয়। কারণ ইউনিয়ন ছাড়াই অধিকার ও অন্যান্য সুবিধা নিশ্চিত করার অনেক প্রমাণ রয়েছে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ গার্মেন্টস ম্যানুফ্যাকচারার্স অ্যান্ড এক্সপোর্টার্স অ্যাসোসিয়েশনের (বিজিএমইএ) পরিচালক মহিউদ্দিন রুবেল গণমাধ্যমকে বলেন, আমরা সাধারণত শ্রম অধিকার ও অন্যান্য আনুষঙ্গিক বিষয়ে আইএলও’র প্রতিবেদনকে অগ্রাধিকার দিই। যেকোন বেসরকারি বা বিশেষায়িত সংস্থা তাদের ইচ্ছামতো রিপোর্ট প্রকাশ করতে পারে। কিন্তু আমরা মনে করি না যে, সেই রিপোর্টে প্রকৃত বাস্তব তথ্য উঠে এসেছে। এসব প্রতিবেদন বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে করা।
তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশে সরকার শ্রমিকদের কল্যাণে শ্রম আইন সংশোধনসহ সবকিছুই করেছে এবং আমরা তা বাস্তবায়নও করছি। প্রতিবেদনটি সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন এবং তা গ্রহণ করার কোনো সুযোগ নেই।
এই প্রতিবেদন প্রকাশের সাথে অনেক প্রতিযোগী দেশ জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ করেন তিনি।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন