সব কিছু ঠিক থাকলে ২০২৪ সালের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে এই নির্বাচন বর্জনের ঘোষণা করেছে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি)। বর্তমান সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দাবিতে লাগাতার আন্দোলন করে যাচ্ছে এই দল। বিএনপির এই আন্দোলনের সাথে তাদের সমমনা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও জোটগুলোও একই দাবি নিয়ে আন্দোলন করছে। বিএনপি বলয়ের বাইরে এই দাবিতে আন্দোলন করছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট। এছাড়াও বিএনপির সাথে কোনো জোটে না থেকেও এককভাবে আন্দোলন করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ।
আন্দোলনরত সবগুলো দলের দাবি হচ্ছে, বর্তমান আওয়ামী সরকারের পদত্যাগ ও নির্দলীয় সরকারের অধীনে অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন। জাতীয় নির্বাচন নিয়ে আন্দোলনরত বিরোধী দলগুলোর এই দাবির প্রতি সমর্থন জানাচ্ছে জাতিসংঘসহ আমেরিকা ও ইউরোপিয় ইউনিয়ন ও পশ্চিমা অনেক রাষ্ট্র। আবার ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সংবিধান মেনে দলীয় সরকারের অধীনে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে এটিকে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ বিষয় আখ্যা দিয়ে সরকারের এই নির্বাচনকে সমর্থন দিচ্ছে চীন, রাশিয়া ও ভারতের মতো আঞ্চলিক ও বিশ্ব শক্তিগুলো। ফলে বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে দেশের জনগণ ও রাজনৈতিক দলগুলো যেমন দুই ভাগে ভাগ হয়ে গেছে একইভাবে বিশ্বের পরাশক্তি ও আঞ্চলিক শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোও দুইভাগে ভাগ হয়ে গেছে।
বাংলাদেশের নির্বাচন ঘিরে দেশের জনগণ, রাজনৈতিক দল ও বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিধর রাষ্ট্রগুলোর এমন অবস্থানের ফলে এই মূহুর্তে বাংলাদেশ জটিল এক রাজনৈতিক সংকটের মূহুর্ত পার করছে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকট আরো বেশি শঙ্কা তৈরি করছে দেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট। বর্তমানে বাংলাদেশের রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে নেমে ২০ বিলিয়ন ডলারে চলে এসেছে। দেশটিতে ব্যাপক মূল্যস্ফীতির কারণে জনগণের নাভিশ্বাস উঠেছে। এই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সংকট আগামী দিনে বাংলাদেশকে কোন পরিণতির দিকে নিয়ে যায় তা নিয়েও শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ সরকার অভ্যন্তরীণ চাপ তথা আন্দোলন মোকাবিলায় এখন পর্যন্ত বেশ সাফল্য দেখিয়েছে। গত ২৮ অক্টোবর রাজধানী ঢাকায় বিএনপির সমাবেশ ঘিরে পুলিশের সাথে দলীয় নেতাকর্মীদের ব্যাপক সংঘর্ষের পর থেকে দলটির কেন্দ্রীয় কার্যালয় বন্ধ রয়েছে। কেন্দ্রীয় কার্যলয়ের সামনে দীর্ঘদিন পুলিশের কড়া পাহারা ছিল। এখন সেই পাহারা কিছুটা শিথিল হলেও দলের কোনো নেতাকর্মী তাদের দলীয় কার্যালয়ে যাচ্ছেন না।
বিএনপির মহাসচিব থেকে শুরু করে সিনিয়র নেতাদের অধিকাংশই এখন কারাগারে। আর যারা এখনো বাইরে তারা কেউই প্রকাশ্যে নেই। সবাই পলাতক। সারাদেশে বিএনপির প্রায় ২ কোটি নেতাকর্মী ঘর ছাড়া বলে দাবি দলটির। সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রধান দল বিএনপির এমন অবস্থায় আরো যে দলগুলো একই দাবি নিয়ে বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলন করে আসছিল তারাও আন্দোলন তেমন একটা জমাতে পারছে না। ফলে নির্দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনের দাবিতে দেশের অভ্যন্তরে জনগণের ব্যাপক চাপ সরকার বেশ সফলভাবেই সামাল দিয়েছে।
একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ সবচেয়ে বেশি চাপের মুখে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। এর বাইরে আছে জাতিসংঘ, ইউরোপিয় ইউনিয়নের চাপ। অন্যদিকে বাংলাদেশের মানবাধিকার ও গণতান্ত্রিক পরিস্থিতি নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলোও একট্টা হয়ে বাংলাদেশ সরকারকে অনেকটা চাপের মুখেই রেখেছে। ফলে আওয়ামী লীগ দেশের অভ্যন্তরে রাজনৈতিক দলগুলোর চাপ সামলিয়ে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিকে এগিয়ে গেলেও শেষ পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়ন, জাতিসংঘ ও বিভিন্ন মানবাধিকার সংগঠনের চাপ কতটা সামাল দিতে পারে সেটাই এখন দেখার বিষয়।
যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিশ্চিত করার জন্য ইতোমধ্যে নতুন ভিসানীতি আরোপ করেছে। যা নিয়ে সরকারি দল অনেকটাই অস্বস্তিতে। এছাড়াও বাংলাদেশের শ্রম আইন ও শ্রম অধিকার নিয়েও যুক্তরাষ্ট্রের পক্ষ থেকে ব্যাপক চাপ রয়েছে। ইতোমধ্যে বাংলাদেশের যুক্তরাষ্ট্র দূতাবাস থেকে জানানো হয়েছে যে, বাংলাদেশ শ্রম আইন ও শ্রম অধিকার ইস্যুতে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসতে পারে।
সম্প্রতি বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পের মালিক পক্ষের সংগঠন বিজিএমই জানিয়েছে, যুক্তরাষ্ট্রসহ বিভিন্ন পশ্চিমা ক্রেতা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে যদি যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপরে বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা ঘোষণা করে তাহলে তারা আর পোশাক কিনবে না। আর যদি পোশাকের অর্ডার করার পর বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা আসে তাহলে তারা সেই চুক্তি বাতিল করবে। ফলে বাংলাদেশের ৪০ লাখ শ্রমিকের কর্মসংস্থান ও দেশটির সবচেয়ে বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়কারী এই শিল্প নিয়ে ব্যাপক শঙ্কা দেখা দিয়েছে।
অন্যদিকে মানবাধিকার ইস্যুতে ২০২১ সালে বাংলাদেশের এলিট ফোর্স র্যাবের উপরে ও সংস্থাটির ৭ জন উচ্চপদস্থ সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তার উপরে নিষেধাজ্ঞা দেয়া আছে। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে নানা চেষ্টা তদবিরের পরও এই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করানো সম্ভব হয়নি। এছাড়াও নির্বাচন কেন্দ্র করে নতুন ভিসানীতির চাপ, এর বাইরে বিরোধী দল দমনের ক্ষেত্রে পুলিশসহ অন্যান্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো ব্যাপক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগ জানিয়ে আসছে। বেশ কয়েকটি মানবাধিকার সংগঠন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীকে শান্তি রক্ষা মিশনের না নেয়ার জন্যও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে। এমন পরিস্থিতিতে সামনের দিনে দেশের অভ্যন্তরে বিরোধী পক্ষকে নিয়ন্ত্রণে রাখতে গিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে সরকার আরো কী ধরনের চাপের মুখে পরে সেটাও ভাবনার বিষয়।
অন্যদিকে মানবাধিকার ও গণতন্ত্র ইস্যুতে বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের সাথে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বেশ খারাপ সময় পার করছে। এর পরিণতি শেষ পর্যন্ত কী হয় সেটাও ভাবনার বিষয়। বাংলাদেশ এককভাবে সবচেয়ে বেশি পোশাক রপ্তানি করে যুক্তরাষ্ট্রে। মানবাধিক, গণতন্ত্র ও শ্রম আইনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে যদি বাংলাদেশ সরকার যুক্তরাষ্ট্রের কোনো নিষেধাজ্ঞার মুখোমুখি হয় সে ক্ষেত্রে বর্তমান অবস্থান কতটা ধরে রাখতে পারবে সেটাও ভাবনার বিষয়। যদি যুক্তরাষ্ট্র বাণিজ্য নিষেধাজ্ঞা জারি করে তাহলে বাংলাদেশের চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিঃসন্দেহে আরো বাড়বে। সেই পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক সংকট ও অর্থনৈতিক সংকট সমাধান দেয়া ক্ষমতাসীন দলের জন্য সহজ হবে না।
আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ইস্যুতে জাতিসংঘ, যুক্তরাষ্ট্র, ইউরোপিয় ইউনিয়নসহ অন্যান্য পশ্চিমা দেশগুলো বারবার একটি অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের তাগিদ দিয়ে আসছে। তবে বাংলাদেশ সরকার এসব বিষয়কে দেখছে দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তাক্ষেপ হিসেবে। ক্ষমতাসীন দলের সাধারণ সম্পাদক ও বাংলাদেশ সরকারের সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের জাতিসংঘকে একটি কার্যকারিতাহীন প্রতিষ্ঠান আখ্যা দিয়ে সংস্থাটির আহ্বানকে তেমন একটা পাত্তা দেয়নি। তবে দেশটির প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়ালের কণ্ঠে উঠে এসেছে চাপের আভাস। তিনি সম্প্রতি এক বক্তব্যে বলেছেন, সুষ্ঠু নির্বাচন ইস্যুতে বিদেশি চাপ রয়েছে। আমাদেরকে দেশের অর্থনীতি বাঁচাতে হবে।
বাংলাদেশ সরকার পশ্চিমাদের সুষ্ঠু নির্বাচনের দাবিতে অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে বিদেশি হস্তাক্ষেপ দেখলেও চীন, রাশিয়া ও ভারতের অবস্থানকে বেশ সম্মান জানাচ্ছে। সম্প্রতি ভারতের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী পর্যায়ের বৈঠক (টু প্লাস টু) মিটিংয়েও বাংলাদেশের প্রসঙ্গ উঠে আসে। সেখানে ভারতের পক্ষ থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে জানানো হয়েছে বাংলাদেশ ইস্যুতে ভারত অন্য কোনো দেশের হস্তাক্ষেপ চায় না। এতে আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা নষ্ট হতে পারে। বাংলাদেশের জনগণ তাদের দেশ নিয়ে যে সিদ্ধান্ত নিবে ভারত সেটাকেই স্বাগত জানাবে বলে জানিয়েছে ভারতে পররাষ্ট্র সচিব বিনয় কোয়াত্রা। চীন, রাশিয়ার অবস্থানও এমন। ফলে বাংলাদেশ সরকার নির্বাচন, গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে পশ্চিমাদের চাপের মুখে চীন, রাশিয়া ও ভারতে পাশে পাচ্ছে। যা বাংলাদেশে বর্তমান ক্ষমতাসীনদের অনেকটাই সাহস যোগাচ্ছে।
ধারণা করা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের চাপের মুখেও সরকার গত ২৮ অক্টোবর ঢাকায় বিএনিপর সমাবেশে পুলিশ দিয়ে যে দমন পীড়ন চালিয়েছে সেটা করেছে ভারতের সবুজ সংকেতে। তবে ভারত তার এই অবস্থা কতটা ধরে রাখতে পারবে সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ। কারণ শিখ বিচ্ছিন্নতাবাদী হত্যাকাণ্ড ইস্যুতে ভারত কানাডার সাথে উত্তেজনাকর সময় পার করছে। অন্যদিকে একই ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের সাথেও ভারতের কূটনৈতিক সম্পর্কের ঘাটতি দেখা যাচ্ছে। ভারতে কিছুদিনের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। বিরোধী দলগুলো বিজেপি বিরোধী শক্ত জোটের কথা জানান দিচ্ছে। আন্তর্জাতিক ও দেশীয় এসব চাপ সামলে ক্ষমতাসীন বিজেপি সরকার বাংলাদেশের রাজনীতি নিয়ে কতটা তৎপরতা দেখাবে সেটাও প্রশ্ন সাপেক্ষ।
দিন যত যাচ্ছে সরকারের উপরে চাপও বাড়ছে আবার জাতীয় নির্বাচনের তারিখও ঘনিয়ে আসছে। এখন দেখার বিষয় বাংলাদেশ সরকার ২০১৪ ও ২০১৮ সালের মতো আরো একটি এক তরফা নির্বাচন করে ভারত, চীন ও রাশিয়ার সমর্থন নিয়ে টিকে থাকতে পারে কি না। আর দেশের অর্থনীতির ঘনিভূত সংকটই বা কতটা সামাল দিতে পারে। কারণ অর্থনৈতিক সংকট রাজনৈতিক সংকটকে যেমন প্রভাবিত করছে একইভাবে রাজনৈতিক সংকট অর্থনৈতিক সংকটকেও ঘনিভূত করছে। দুই ফ্রন্টে সংকট সমাধান করে আওয়ামী লীগ এক তরফা নির্বাচন করে টিকে থাকতে পারে কি না সেটা সময়ই বলবে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন