করোনাভাইরাস মহামারির কারণে ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে বাংলাদেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকা নিয়ে শিক্ষার্থীদের মাঝে বাড়ছে ক্ষোভ। এখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবি নিয়ে তারা আন্দোলনে নেমেছে। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ফেসবুকে 'অবিলম্বে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা দাও' নামে একটি গ্রুপকে কেন্দ্র করে এই আন্দোলন গড়ে উঠেছে।
গত ২৪ মে ২০২১ তারিখ থেকে শিক্ষার্থীরা আন্দোলন শুরু করে। এর আগে গত ফেব্রুয়ারি মাসে আরেক দফা দানা বেঁধেছিল এই আন্দোলন। তখন বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর বাস শ্রমিকদের হামলা ও জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের উপর স্থানীয়দের হামলার ঘটনাকে কেন্দ্র করে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। সেই আন্দোলনে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা তালা ভেঙে হলে উঠে গিয়েছিল। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও তালা ভেঙে হলে উঠে পরে। একই দাবিতে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয় ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের বৃহৎ আন্দোলন শুরু হয়।
রাজধানী ঢাকার সাত কলেজের শিক্ষার্থীরাও যৌথভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার দাবিতে রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন শুরু করেছিল। সারাদেশে শিক্ষার্থীদের তুলুম আন্দোলনের মুখে শিক্ষামন্ত্রী ড. দীপু মণি সংবাদ সম্মেলন করে ১৭ মে হল খুলে দেয়া ও ২৪ মে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার ঘোষণা দেন। তার আগে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার রোডম্যাপ ঘোষণা ও বিশ্ববিদ্যালয়ের সকল আবাসিক শিক্ষার্থীদের করোনার টিকার আওতায় নিয়ে আসার কথাও জানান। গত ফেব্রুয়ারি মাসে এই ঘোষণা দেয়া হলেও সরকার ২ মাসের অধিক সময় হাতে পেয়েও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার রোডম্যাপ ঘোষণা করেনি এমনকি শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় আনারও উপযুক্ত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি।
প্রায় দেড় বছর ধরে দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে সরকারের পক্ষ থেকে অনলাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম চালানোর কথা বলা হয়। অনলাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম চালানোও হয়। কিন্তু নানাবিধ কারণে অনলাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম কোনো সুফল বয়ে আনতে পারেনি। বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের তথ্যমতে ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রমের বাইরে ছিল। এমন প্রেক্ষিতে গত মে মাসের ১৫ তারিখে বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) পক্ষ থেকে বিশ্ববিদ্যালয়গুলোকে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের জন্য প্রস্তুতি নিতে বলে।
ইউজিসির এই সিদ্ধান্ত প্রত্যাখ্যান করে শিক্ষার্থীরা তাদের অনলাইন গ্রুপ থেকে পাল্টা সংবাদ বিবৃতি দেয়। সেখানে অনলাইনে পরীক্ষা গ্রহণের সমস্যা ও অনলাইন শিক্ষা-কার্যক্রমের অসারতা তুলে ধরে এই সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসার আহ্বান জানিয়ে স্বাস্থ্যবিধি মেনে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে শিক্ষা-কার্যক্রম স্বাভাবিক করার দাবি তুলে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ২৪ মে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা সারাদেশে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করে।
এর আগে গত ২৩ মে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ছুটি বৃদ্ধি করে ২৪ মে'র বদলে ২৯ মে করা হয়। ২৪ মে সারাদেশে শিক্ষার্থীদের মানববন্ধনের পর ২৬ মে শিক্ষামন্ত্রী দুপুর ১২টায় অনলাইনে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছুটি আগামী ১৩ জুন পর্যন্ত বৃদ্ধি করে।
সংবাদ সম্মেলনে শিক্ষামন্ত্রী দেশের করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি কথা উল্লেখ করেন। একই সাথে নতুন করোনা ভ্যারিয়েন্ট শনাক্ত হয়েছে সেই বিষয়টি উল্লেখ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হলে শিক্ষার্থীদের মাঝে ব্যাপক করোনা সংক্রমণের ঝুঁকির কথা বলেন। তাই শিক্ষার্থীদের অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে দ্রুত ভ্যাকসিনের আওতায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের অবকাঠামো উন্নয়ন ও বিশ্ববিদ্যালয়ের আবাসন ব্যবস্থার উন্নয়ন করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার কথা জানান। তবে কবে নাগাদ শিক্ষার্থীদেরকে ভ্যাকসিনের আওতায় আনা হবে সেটা তিনি স্পষ্ট করে উল্লেখ করেননি।
শিক্ষামন্ত্রীর এই বক্তব্যের পর শিক্ষার্থীদের মাঝে ক্ষোভ ছড়িয়ে পরে। শিক্ষামন্ত্রীর সংবাদ সম্মেলনের পরপরই শিক্ষার্থীরা পাল্টা সংবাদ সম্মেলন করে ও সংবাদ বিবৃতি দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করে তাদের আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেন। এরই ধারাবাহিকতা সারাদেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার আন্দোলন চলমান রয়েছে। আগামী ১৩ জুন ইউজিসির সামনে বিক্ষোভ কর্মসূচির ডাক দিয়েছে তারা।
সারাদেশে যখন করোনা সংক্রমণ বৃদ্ধি পাচ্ছে সেই মূহুর্তে শিক্ষার্থীদের এই আন্দোলন নিয়ে প্রশ্ন জাগা ও পাল্টা যুক্তি স্বাভাবিক এবং সরকারের পক্ষ থেকে শিক্ষার্থীদের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার যে শঙ্কা করা হচ্ছে তা অমূলক নয়। কিন্তু তারপরও কেন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা এই আন্দোলন করছে?
আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার বিষয়ে সরকারের ইতিবাচক মনোভাবের অভাব ও শিক্ষা নিয়ে তার উদ্বেগহীনতাকেই মূল কারণ হিসেবে দেখছেন৷ এই বিষয়ে আন্দোলনরত বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের সাথে কথা বলে তাদের মতামত জানতে চেষ্টা করি৷ তাদের বক্তব্যে উঠে আসে আসলে কেন ও কোন যুক্তি তারা এই আন্দোলনে নেমেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী মোয়াজ্জেম হোসেন বলেন, সরকারের পক্ষ থেকে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী ভ্যাকসিনের আওতায় এনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়া যে কথা বলছেন তা নিয়ে যথেষ্ট সন্দেহ রয়েছে। এবং শিক্ষার্থীদের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পরার যে যুক্তি তিনি দেখাচ্ছেন এটাও আসলে মূল্যহীন। শিক্ষামন্ত্রী ২৬ মে সংবাদ সম্মেলনে বললেন, শিক্ষার্থীদের টিকার আওতায় নিয়ে এসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা হবে। কিন্তু কবে নাগাদ এই কার্যক্রম শুরু হবে, কীভাবে ও কতদিনের মধ্যে শেষ হবে তা উল্লেখ করেননি৷ কেবল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথাই যদি ধরেন তাহলে ঢাবির যে প্রায় ৩০ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছে তাদেরকে দুই ডোজ টিকার আওতায় নিয়ে আসতে অন্তত দুই থেকে তিন মাস সময় লাগবে।
এছাড়াও সারাদেশে ৬ লাখের মতো পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রয়েছে। এখন পর্যন্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরকেই পুরোপুরি টিকার আওতায় আনতে পারেনি৷ অন্যদিকে কর্মকর্তা-কর্মচারীও রয়েছে। তাই অনির্দিষ্টকালের জন্য এমন ঘোষণা আমরা মেনে নিতে পারি না। সরকার কলকারখানা, ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান তথা সব কিছু খুলে দিয়েছে। শিক্ষার্থীরাও বাইরে বের হচ্ছে। তাদের পরিবারের লোকজন বাইরে বের হচ্ছে। তাই কেবল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দিলে সংক্রমণ বাড়বে এই বক্তব্যও যুক্তি সম্মত নয়। শিক্ষার্থীরা মনে করছে এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখার পিছনে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে।
এ বিষয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী রাকিবুল রনি বলেন, 'শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার পিছনে সরকারের রাজনৈতিক উদ্দেশ্য রয়েছে। কারণ দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনেক ধরনের সংকট সৃষ্টি হয়েছে। অনলাইনে পরীক্ষার যে পদ্ধতি সাজানো হয়েছে তাতে ১টি কোর্সের পরীক্ষা শেষ করতে সময় লাগবে ৫ দিনের মতো। একজন শিক্ষক যখন আরও তিন-চারটি কোর্সের পরীক্ষা গ্রহণ করবেন তখন তারাও পেরে উঠবেন না। এই সুযোগে নতুন নিয়োগের দাবি আসবে। তখন বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও সরকার দলীয় লোকজন মিলে পছন্দ মতো নিয়োগের কাজ শুরু করবে। এর ফল পুরোটাই হবে রাজনৈতিকীকরণ।
এ বিষয়ে ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের মাস্টার্সের শিক্ষার্থী অনি আতিকুর রহমান বলেন, বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ রাখার বিষয়টি এখন পুরোপুরি রাজনৈতিক ফায়দা লোটার কৌশলে পরিণত হয়েছে। কারণ সরকার শিক্ষার্থীদের মাঝে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়ার ভয় করছে। কিন্তু তারা দেশের সবগুলো জেলা উপজেলায় স্থানীয় সরকার নির্বাচন অনুষ্ঠিত করেছে। আমরা দেখেছি সেখানে গণ-জমায়েত হয়েছে। সব রাজনৈতিক দলের ছাত্র সংগঠনগুলোও সেই নির্বাচনে দলের পক্ষ হয়ে কাজ করেছে। তখন তো সরকার বলেনি যে সংক্রমণ ছড়িয়ে পড়বে? অন্যদিকে আমরা দেখেছি গত বছর মার্চ-এপ্রিলে যখন করোনা সংক্রমণের হার উর্ধ্বমুখী তখন সারাদেশের কওমী মাদ্রাসাগুলো খোলা ছিল এবং তারা শিক্ষা-কার্যক্রম চলমান রেখেছে। সরকারি হিসেব মতেই সেখানে ১৫ লাখ শিক্ষার্থী রয়েছে। সরকার যদি শিক্ষার্থীদের জীবন নিয়ে এতোই সচেতন হতো তাহলে ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর জীবন নিয়ে এতো উদাসীন কেন ছিল?
গত ২৬ মার্চের পর হঠাৎ করে সব কওমী মাদ্রাসা বন্ধ ঘোষণা করা হলো করোনা সংক্রমণের দোহাই দিয়ে। সেটা কেবলই অজুহাত ছিল। কারণ তখন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির আগমনকে কেন্দ্র করে কওমী শিক্ষার্থীরা বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলেছিল। সেটা ক্রমেই বড় ধরনের সহিংসতার দিকে যাচ্ছিল। যার ফলে কওমী মাদ্রাসাগুলো বন্ধ করে দিয়ে সরকার হেফাজতে ইসলামসহ অন্যান্য কওমী মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠনের নেতা-কর্মীদের গ্রেফতার শুরু করে। কারণ মাদ্রাসা খোলা রেখে এই গ্রেফতার শুরু করলে এর বিরুদ্ধে ১৫ লাখ শিক্ষার্থীর আন্দোলন সামাল দেয়া সরকারের পক্ষে সম্ভব ছিল না।
করেনা সংক্রমণের ঝুঁকি থাকা সত্ত্বেও কোন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা আন্দোলনে নেমেছে তা নিয়ে কথা হয় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলা নিয়ে সিলেটে আন্দোলনরত শিক্ষার্থী ফাহিম চৌধুরীর সাথে। তিনি জানান, শিক্ষার্থীরা করোনা সংক্রমণের ভয় উপেক্ষা করে কোন পরিস্থিতিতে আন্দোলন শুরু করেছে সেটা আগে দেখা প্রয়োজন। বাংলাদেশের শিক্ষার্থীদের মধ্যে বড় একটা অংশ মূলত নিম্ন ও মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে আসা। শিক্ষাজীবন শেষে পরিবারে কন্ট্রিবিউশানের একটা দায় তাদের থাকে। করোনায় কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে কারো অনার্স ফাইনাল ইয়ারের পরীক্ষা আটকে আছে। কারো বা দুয়েকটা কোর্সের পরীক্ষা আটকে থাকার ফলে তারা একদিকে যেমন শিক্ষাজীবন শেষ করতে পারছে না অন্যদিকে পরিবারকেও কোনো সহযোগিতা করতে পারছে না। শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ পড়াশোনার পাশাপাশি টিউশনি বা পার্টটাইম জব করে৷ করোনার ফলে তারা এই উপার্জনও হারিয়েছে। তাদের পরিবারও অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত। এর ফলে শিক্ষার্থীদের মাঝে আত্মহত্যার প্রবণতাও বৃদ্ধি পেয়েছে। এই যে অনিশ্চয়তা সেটা থেকে শিক্ষার্থীরা মুক্তি চাচ্ছে।
শুরু থেকেই বাংলাদেশে করোনা নিয়ন্ত্রণে ভালো কোনো পরিকল্পনা দৃশ্যমান হয়নি৷ মহামারী যত বেড়েছে শিক্ষার্থীদের শিক্ষাজীবন ততই অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে৷ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ এটা যেমন একটা সমস্যা তারচেয়ে বড় সমস্যা কিভাবে, কবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলবে তা নিয়ে সরকারের সুনির্দিষ্ট রোডম্যাপ নেই৷ ফলে চূড়ান্ত রকমের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে দেশের শিক্ষাখাত৷ অথচ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেয়ার জন্য পর্যাপ্ত স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করা, ছাত্র-শিক্ষকদের জন্য ভ্যাক্সিনের আয়োজন করা, করোনাকালের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশেষ বাজেট বরাদ্দ দেয়া এই ধরনের কোনো উদ্যোগই সরকারের পক্ষ থেকে দেখা যাচ্ছে না। এর ফলাফল ভয়াবহ হচ্ছে।
বাংলাদেশে এই দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার ফলে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংকটও চরম আকার ধারণ করেছে। সে বিষয়ে ইউরোপিয়ান ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী ও নো ভ্যাট অন এডুকেশন আন্দোলনের সংগঠক মুক্ত রেজোয়ান বলেন, আপনি দেখেছেন এই করোনাকালে কী রকম সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছে দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা। দেশের সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, অনলাইন ক্লাসের নামে চলছে এক রকম ভন্ডামি। এই পরিস্থিতিতে একদিকে শিক্ষার্থীদের মধ্যে এক রকম হতাশার উৎপত্তি হচ্ছে অন্যদিকে অনলাইন ক্লাসের মধ্যদিয়ে শিক্ষার যে পর্যাপ্ত মান, সেই মানসন্মত শিক্ষা প্রদানে ব্যর্থ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। এই পরিস্থিতিতে আমরা পর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার দাবিতে আন্দোলনও করেছি এখনো দেশব্যাপী আমাদের এই আন্দোলন চলছে কিন্তু সরকার বা শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের কোন সাড়া আমরা দেখিনি।
বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় এবং কলেজগুলোতে অনলাইন ক্লাস শিক্ষার্থীদের কাছে থেকে বেতন/ফি আদায়ের একটা প্রক্রিয়া মাত্র। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা করোনাকালে এক সেমিস্টার টিউশর ফি মওকুফের যে আন্দোলন গড়ে তুলেছিলাম, সেখানে নামেমাত্র ফি মওকুফ করা হলেও তা শিক্ষার্থী বা অভিভাবকদের তেমন কোন উপকারে আসেনি। সরকার এই দুঃসময়ে ব্যবসায়ীদের পাশে দাঁড়িয়েছে, তাদের হাজার হাজার কোটি টাকা প্রণোদনা দিয়েছে কিন্তু শিক্ষাখাতে সরকার কোন প্রনোদনা দিতে পারেনি। এ থেকে শিক্ষাখাতে সরকারের অবহেলার চিত্র স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে।
সারাদেশে সাধারণ মানুষ যখন এক রকম অর্থনৈতিক সংকটে নিমজ্জিত ঠিক তখনই সরকার ২০২১-২২সালের বাজেট প্রস্তাবনায় বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপরে ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছে। আমরা মনেকরি এই কর সম্পূর্ণ অনৈতিক এবং শিক্ষাকে পণ্যে রূপান্তর করার একটি নীলনকশা। ২০১৫ সালেও সরকার বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপরে ১৫% ভ্যাট আরোপ করেছিল, যা সাধারণ শিক্ষার্থীদের নো ভ্যাট অন এডুকেশন প্ল্যাটফর্মের আন্দোলনের মুখে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করতে বাধ্য হয়। এবারও এই ১৫% কর বাতিলের দাবি সহ ৬ দফা দাবিতে সাধারণ শিক্ষার্থীদের নিয়ে ২০১৫ সালের আন্দোলনের প্ল্যাটফর্ম, নো ভ্যাট অন এডুকেশনের ব্যানারে আমরা রাজপথে নেমে এসেছি এবং আমাদের দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত আমরা আমাদের আন্দোলন চালিয়ে যাবো।'
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি ও প্রগতিশীল ছাত্র জোটের অন্যতম নেতা মো. ফয়েজ উল্লাহ জানান, সরকার যে শিক্ষা নিয়ে চরম উদাসীন তার সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীদের সামনে স্পষ্ট হয়েছে। কারণ দীর্ঘ দেড় বছর ধরে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার পরও এখন পর্যন্ত সরকার কোনো ধরনের রোডম্যাপ দিতে পারেনি। শিক্ষার্থীদের ভ্যাকসিনের আওতায় আনার কথা বারবার বললেও এখন পর্যন্ত ভ্যাকসিনেশনের কার্যক্রম শুরুই করতে পারেনি৷ আমরা দেখছি এখন ভ্যাকসিন নিয়ে অনিশ্চিয়তা সৃষ্টি হয়েছে। আবার কবে নতুন চালান আসবে সেটারও নিশ্চিয়তা নেই৷
অন্যদিকে আমরা দেখলাম সরকার ২০২১-২২ অর্থবছরের যে বাজেট প্রস্তাব করেছে সেখানে করোনাকালে শিক্ষাখাতের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে বিশেষ কোনো প্রণোদনা নেই। উল্টো শিক্ষাখাতে গত বছরের তুলনায় বাজেটে কম বরাদ্দ রাখা হয়েছে এবং বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের উপরে ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব করেছে৷ করোনার কারণে অনেক বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান যেখানে বিক্রি করে দেয়ার পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে সেখানে ১৫ শতাংশ কর আরোপের প্রস্তাব শিক্ষাখাত ধ্বংস করার স্পষ্ট প্রমাণ। এমন পরিস্থিতিতে শিক্ষার্থীরা মাঠে নেমে এসেছে৷ তারা দাবি আদায়ের জন্য আন্দোলনকেই শেষ উপায় হিসেবে নিয়েছে।
প্রাণঘাতী করোনাভাইরাসের কারণে বিশ্বের যে সকল দেশে সবচেয়ে দীর্ঘ সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে তার মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম। ইউনিসেফের তথ্য মতে, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই সবচেয়ে বেশি সময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে৷ এই সময়ে অনলাইনে শিক্ষা-কার্যক্রম চালানোর কাজ করলেও সেটা হালে পানি পায়নি। কারণ পর্যাপ্ত ইন্টারনেট সুবিধা ও অনলাইনে ক্লাস করার মতো উপযুক্ত ডিভাইস না থাকা এর অন্যতম কারণ। তাই এভাবে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার যে নেতিবাচক প্রভাব তা গোটা শিক্ষাখাতকেই ধ্বসিয়ে দিচ্ছে বলেই মনে করছেন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন