এবার বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সামনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পরপর দুটি কারচুপি ও একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতায় যাওয়ার পর এবার একটি অবাধ, নিরপেক্ষ, অংশগ্রহণমূলক ও সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা এবং ক্ষমতায় যাওয়া। এই চ্যালেঞ্জ সামনে রেখে, জয়ের নিশ্চয়তা নিয়ে, দেশে বিদ্যমান রাজনৈতিক সংকটের কোনো সমাধান না করে নির্বাচনের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে ক্ষমতাসীনরা। অন্যদিকে নির্বাচন বর্জনকারী বিরোধী দলগুলো সরকারের সর্বাত্মক দমন-পীড়ন মাথায় নিয়ে নির্বাচন প্রতিহত করতে মাঠে আন্দোলন করে যাচ্ছে।
এমন পরিস্থিতিতে সরকার যদি সবকিছু তাদের নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারে এবং নির্বাচনকারী বিরোধী রাজনৈতিক দলগেুলো যদি শক্ত কোনো আন্দোলন গড়ে তুলে নির্বাচন প্রতিহত করতে না পারে তাহলে আগামী বছরের ৭ জানুয়ারি বাংলাদেশে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এখন পর্যন্ত সরকারের যে অবস্থান তাতে নির্বাচন হয়ে যাওয়ার সম্ভবনাই বেশি।
এই নির্বাচনে বাংলাদেশের প্রধান বিরোধী রাজনৈতিক দল বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি) এবং তাদের আন্দোলনের শরিক দল ও জোটগুলো অংশ নিচ্ছে না। একইসাথে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, জামায়াতে ইসলামীসহ অনেক দল নির্বাচন বর্জন করেছে। তবে বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন প্রাপ্ত ৪৪টি দলের মধ্যে ২৬টি দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। নির্বাচনে অংশ নেওয়া ২৬টি দলের মধ্যে একমাত্র ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ বাদে আর কোনো দলেরই ভোট ব্যাংক নেই।
অন্যদিকে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি এবারের নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাথে আসন সমঝোতা করে। ২৬টি আসনে আওয়ামী লীগ নৌকা প্রতীকের প্রার্থী প্রত্যাহার করেছে। জাতীয় পার্টি ২৬টি আসনে ছাড় পাওয়ার আগে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের সাথে দফায় দফায় বৈঠক করেছে আসন ভাগাভাগি নিয়ে। এরপর আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ২৬টি আসনে নৌকা প্রার্থী প্রত্যাহার করার নিশ্চয়তা পেয়েই জাতীয় পার্টি এখনো পর্যন্ত নির্বাচনী মাঠে আছে এবং সংসদে বিরোধী দল হতে যাচ্ছে।
জাতীয় পার্টি বাদে বিরোধী দলের আরো দাবিদার হচ্ছে, বিএনপি থেকে হয়ে আওয়ামী লীগের সহযোগিতা নিয়ে গড়ে উঠা তৃণমূল ও সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী আন্দোলন (বিএনএম)। এই দল দুটি ইতোমধ্যে ‘কিংস পার্টি’ নামে সাধারণ মানুষের কাছে পরিচয় পেয়ে। সাধারণ মানুষ এই দুটি দলকে সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় তৈরি রাজনৈতিক দল হিসেবেই চিনে। আর এটাই সত্য। এই দল দুটিও দাবি করছে তারাই একমাত্র খাঁটি বিরোধী দল।
বাংলাদেশের এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে কে ক্ষমতায় যাবে সেটার চাইতে কে বিরোধী দল হবে তা নিয়ে আওয়ামী লীগ ও তাদের ১৪ দলীয় জোট বাদে নির্বাচনে অংশগ্রহণকারী অন্য দলগুলোর মাঝে বাদানুবাদ হচ্ছে। তৃণমূল বিএনপির চেয়ারপার্সন শমশের মুবিন চৌধুরী ও মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার দুজনেই বিএনপির সাবেক নেতা। তারা বিএনপি থেকে বহিষ্কৃত হয়ে তৃণমূল বিএনপিতে গিয়েছে। তৃণমূল বিএনপির মহাসচিব তৈমুর আলম খন্দকার কিছু দিন আগে বলেছেন, বাংলাদেশে তারাই একমাত্র খাঁটি বিরোধী দল। তারা আগামী নির্বাচনে বিরোধী দল হিসেবে সংসদে যাচ্ছে।
এর বাইরে বেশ কিছু ইসলামপন্থী দল নির্বাচনে অংশ নিচ্ছে। যাদের নামও সাধারণ মানুষ জানে না। তবে নির্বাচন কমিশনে তাদের নিবন্ধন আছে। এছাড়া সাবেক সেনা কর্মকর্তা সৈয়দ মুহাম্মদ ইবরাহিম (বীর প্রতীক) বিএনপির যুগপৎ আন্দোলন থেকে বের হয়ে গিয়ে শেষ মুহূর্তে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছে। তার দল বাংলাদেশ কল্যাণ পার্টি এখন ভাগ হয়ে গেছে। দল থেকেও তাকে বহিষ্কার করেছে একটি অংশের নেতারা। এই দলটিও সাধারণ মানুষের কাছে তেমন পরিচিত না। ফলে আওয়ামী লীগ সরকার দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন যাদের নিয়ে আয়োজন করছে তারা কেউই গণভিত্তি সম্পন্ন রাজনৈতিক দল নয়। একমাত্র জাতীয় পার্টি বাদে ২৭টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে অন্য কারোই ভোটের মাঠে ১ শতাংশ ভোটও নেই। বর্তমানে জাতীয় পার্টির ২-৩ শতাংশ ভোট হয়তো আছে।
ফলে বাংলাদেশের এবারে আওয়ামী লীগ যে সংসদ নির্বাচন আয়োজন করেছে এবং যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে এটাকে একতরফা নির্বাচন বলাতে কোনো সন্দেহ নেই। যা ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারিতে অনুষ্ঠিত দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মতোই আরেকটি একতরফা নির্বাচন। তবে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও এবারের নির্বাচনের মধ্যে পার্থক্য হচ্ছে সেই নির্বাচনে আওয়ামী লীগের ১৫৪ জন সংসদ সদস্য বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জয়লাভ করে ছিল। বাংলাদেশে মোট তিনশটি সংসদীয় আসনের মধ্যে নির্বাচনের আগেই সরকার গঠনের জন্য আসন পেয়েছিল আওয়ামী লীগ। তবে এবার সেটা হচ্ছে।
এবার যেন বিনাভোটের জয়ের অপবাদ কেউ না দিতে পারে সে জন্য আওয়ামী লীগের সভাপতি বাংলাদেশের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নির্দেশ দিয়েছেন, আওয়ামী লীগের কোনো প্রার্থী বিনাভোটে জয়ী হলে তার বিরুদ্ধে দল থেকে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আওয়ামী লীগের প্রার্থীর বিপরীতে কোনো দলের প্রার্থী না থাকলে দরকার হলে একজন ‘ডামি’ প্রার্থী রাখতে হবে বা যারা স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচনে অংশ নিবে তাদেরকে সহযোগিতা করে জিতে আসতে হবে। (সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৬ নভেম্বর ২০২৩) ভোটহীন নির্বাচনের অপবাদ দেশে ও আন্তর্জাতিক অঙ্গনে না ছড়ায়। ফলে এবারের নির্বাচনে একদিকে যেমন আওয়ামী লীগের অনুগত রাজনৈতিক দলগুলো অংশ নিয়েছে অন্যদিকে বিনাভোটে জয় রোধ করতে আওয়ামী লীগ তাদের দলের মনোনীত প্রার্থী বিপরীতে দল থেকে বা সাধারণ মানুষে মধ্য থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থীও রেখেছে।
বাংলাদেশের বয়স এখন ৫৩ পেরিয়ে ৫৪ শুরু হতে যাচ্ছে। এখনো পর্যন্ত দেশটিতে ১১টি জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। অতীতে কোনো জাতীয় নির্বাচনেই এমন ডামি প্রার্থী বা দল থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী রেখে ‘অংশগ্রহণমূলক’ নির্বাচনের আয়োজন করতে দেখা যায়নি। অন্যদিকে ১১টি জাতীয় নির্বাচনের মধ্যে ৪টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দল নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে। আর বাকি ৭টি নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে দলীয় সরকারের অধীনে। বাংলাদেশের এই নির্বাচনী রাজনীতির সংক্ষিপ্ত ইতিহাস তুলে ধরে পিপলস রিপোর্টারে বিস্তারিত লেখেছি। আগ্রহী পাঠক চাইলে সেখান থেকে পড়েও বুঝতে পারেন যে, বাংলাদেশে বিএনপিসহ অন্যান্য বিরোধী দলগুলো কেনো দল নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে নির্বাচন দাবি করছে।
বাংলাদেশে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ তাদের রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অবাধ, সুষ্ঠু, নিরপেক্ষ ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিলেও বিএনপিসহ নির্বাচন বর্জনকারী রাজনৈতিক দলগুলো ২০১৪ ও ২০১৮ সালে পরপর দুটি কারচুপি ও একতরফা নির্বাচনের পর আর আওয়ামী লীগকে বিশ্বাস করেনি। আর বিশ্বাস করার কোনো কারণও নেই। ফলে এবারের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ তার মিত্র ও কিছু নামমাত্র রাজনৈতিক দল বাদে আর কাউকে পাশে পায়নি। আওয়ামী লীগের মিত্র রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে একটি রাজনৈতিক দলও তিনশ আসনের মধ্যে ১শ আসনে প্রার্থী দেওয়ার মতো সামর্থ্য নেই। অন্যদিকে সংসদের বিরোধী দল জাতীয় পার্টি ২৮৩ আসনে প্রার্থী দিলেও দলটি কখনোই সুষ্ঠু নির্বাচনে ৩৫টির বেশি আসন পায়নি। এছাড়া তৃণমূল বিএনপি ও বিএনএম নতুন রাজনৈতিক দল, যে দল দুটিও ৩শ আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। এই দলে দুয়েকজন বাদে কেউই রাজনৈতিকভাবে পরিচিত ব্যক্তি নয়। ফলে যে নির্বাচন হতে যাচ্ছে সেখানে আওয়ামী লীগ শক্ত কোনো প্রতিদ্বন্দ্বিতার মুখে পরবে না এটা নিশ্চিত।
আওয়ামী লীগও এটা বুঝতে পেরেছে যে, এবার নির্বাচনে ৩শ আসনে তাদের প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারে এমন কোনো দল নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেনি। ফলে বিনা ভোটে জয়ের অপবাদ এড়াতে শুরু থেকেই কৌশল নিয়েছে দলটি। তাদের এই কৌশল হচ্ছে, নিজ দলের মনোনীত প্রার্থীর বাইরে দলের যারা নির্বাচনে অংশ নিতে চায় তাদেরকেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হওয়ার সুযোগ দিয়েছে।
প্রশ্ন হচ্ছে, একটি দেশের জাতীয় নির্বাচন মানে হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট মেয়াদে সেই দেশের রাষ্ট্র ক্ষমতায় কারা থাকবে সেটা জনভোটের মাধ্যমে ঠিক করার প্রক্রিয়া। সাধারণত ভোটাররা জাতীয় নির্বাচনে ভোট দেওয়ার ক্ষেত্রে ব্যক্তি বা প্রতীকের চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেয় সেই ব্যক্তি বা প্রতীককে, যাদের দল নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি তথা ইশতেহার দেশের জন্য, সাধারণ মানুষের জন্য বেশি কল্যাণকর। জাতীয় নির্বাচনে মানুষ ভোট দেয় দলীয় ইশতেহার দেখে। যে দল যত বেশি জনস্বার্থ ও রাষ্ট্রস্বার্থ সংশ্লিষ্ট ইশতেহায় দেয় ভোটাররা সেই দলকেই রাষ্ট্র ক্ষমতায় যাওয়ার ম্যান্ডেট দেয়। কিন্তু বাংলাদেশে বিএনপি নির্বাচন বর্জন করায় ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নির্বাচনকে অংশগ্রহণমূলক দেখানোর জন্য নিজ দল থেকেই স্বতন্ত্র ও ‘ডামি’ প্রার্থী রাখছে। স্বতন্ত্র বা ডামি প্রার্থীরা আওয়ামী লীগেরই। তাদের কোনো ইশতেহার নেই।
মজার দিক হলো, যারা আওয়ামী লীগে দলীয় প্রার্থী আর দলের স্বতন্ত্র প্রার্থী সবাই আওয়ামী লীগের ঘোষিত ইশতেহারকে সামনে রেখে, আওয়ামী লীগের আদর্শকে সামনে রেখে, দীর্ঘ পনের বছরে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্র ক্ষমতায় থেকে যে ‘উন্নয়ন’ করেছে সেই উন্নয়নের কথা প্রচার করেই ভোট চাইছে। তাহলে বিষয়টি এমন যে, সাধারণ ভোটাররা আওয়ামী লীগের দলীয় প্রতীক ‘নৌকায়’ ভোট দিক আর স্বতন্ত্র প্রার্থীদের প্রতীক ‘ঈগল’, ‘ট্রাক’ বা অন্য যা প্রতীক আছে সেখানে ভোট দিলেও দিন শেষে আওয়ামী লীগের পকেটেই রায় যাবে।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকছে এটা ধরেই ভোট দিতে হবে। তাহলে এই নির্বাচনকে একতরফা না বলে অংশগ্রহণমূলক বলার কোনো অবকাশ আছে? আওয়ামী লীগ তাদের দীর্ঘ দিনের রাজনৈতিক মিত্র নামমাত্র ২৭টি দল নিয়ে সেই একতরফা নির্বাচনের দিকেই এগিয়ে যাচ্ছে। যেখানে বাংলাদেশের ভোটাররা যাকেই ভোট দিক না কেনো তা দিন শেষে আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় থাকতেই রায় দেওয়া হবে। বাংলাদেশের এবারের জাতীয় নির্বাচনে ক্ষমতার পালাবদল হচ্ছে না এটা এখন নিশ্চিত।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন