আজ থেকে ৭০ বছর আগে ১৯৫২ সালের ২৬ এপ্রিল ভাষা আন্দোলনের অগ্নিগর্ভ থেকে জন্ম লাভ করে তৎকালীন পূর্ব-পাকিস্তানের প্রথম অসম্প্রদায়িক ও প্রগতিশীল ছাত্র সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন (তৎকালীন নাম পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়ন)। সাম্যের সমাজ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে শত লড়াই-সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ৭০টি বসন্ত পার করেছে ছাত্র ইউনিয়ন। শিক্ষার অধিকার আদায়ে, সমাজ-প্রগতির লড়াইয়ে, মানুষের জীবন-জীবিকার সংগ্রামে, দেশের মানুষের অধিকার আদায়, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার আন্দোলনে ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই সাম্যের আদর্শকে ধারণ করে আপোষহীনভাবে রাজপথে লড়ছে। সাম্প্রদায়িকতা-মৌলবাদ-সাম্রাজ্যবাদ, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস-দখলদারিত্ব, চাঁদাবাজি, ট্যান্ডারবাজি, প্রশ্নফাঁস, নিয়োগবাণিজ্যের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন সর্বদাই ছিল সোচ্চার। আদর্শিক লড়াইয়ে কখন কারো সাথে আপোষ করেনি।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্ম থেকেই দেশের মানুষের মুক্তির প্রশ্নে, শিক্ষার অধিকার আদায়ে প্রশ্নে, শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস-দখলরিত্বের বিরুদ্ধে, সাম্রাজ্যবাদ, সাম্প্রদায়িকতা, মৌলবাদ, খুন-ধর্ষণ, প্রশ্নফাঁস, ট্যান্ডারবাজির বিরুদ্ধে সন্ত্রাসীর অস্ত্রের মুখে, শোষক রাষ্ট্রযন্ত্র ও নিপীড়নকারী শাসকের উদ্যত বায়োনেট ও বন্দুকের নালের সমানে দৃঢ় আদর্শ চেতা সৈনিকের মতো বুক চিতিয়ে প্রতিবাদ করেছে। বুকের তাজা রক্তে রাজপথ রঞ্জিত করেছে কিন্তু কখনও আদর্শের প্রশ্নে আপোষনামা লেখেনি। সমাজ পরিবর্তনকামী লাখো লাখো স্বপ্নবাজ বিপ্লবীর সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এদেশের মানুষের মুক্তি-সংগ্রামে, অধিকার আদায়ের লড়াইয়ে তার জন্মলগ্ন থেকেই নিবেদিত প্রাণ ছিল, আছে। ১৯৬২ সালে আইয়ুব খান প্রণীত শরিফ কমিশনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তুলে বৃহৎ ছাত্র আন্দোলন। সেই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে তিন জন শহীদ হন। স্বৈরাচারী আইয়ুব খান সরকার বাধ্য হয় শিক্ষাকে পণ্য বানানোর সেই শিক্ষা কমিশন বাতিল করতে। গত শতকের ষাটের দশক ছিল এদেশের মানুষের মুক্তি-সংগ্রামের দাবিতে উত্তাল সময়। সেই সময়েও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তার ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনে পিঁছপা হয়নি। বঙ্গবন্ধু কর্তৃক প্রণীত ৬ দফার সাথে ছাত্র সমাজের ৫ দফা দাবিকে যুক্ত করে ১১ দফার ভিত্তিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন গড়ে তুলে সর্বদলীয় বৃহৎ ছাত্র আন্দোলন। যেটা পরবর্তীতে রূপ নেয় গণঅভ্যুত্থানে। ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের নায়ক আসাদ ছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়েন কর্মী। ২০ জানুয়ারি আসাদের হত্যাকাণ্ডের প্রতিবাদে ছাত্র জনতা ফুসে উঠে শুরু হয় গণ-অভ্যুত্থান। সেই অভ্যুত্থানের তোড়ে ভেসে যায় পাকিস্তানের স্বৈরাচরী শাসকদের গদি। শুরু হয় চূড়ান্ত মুক্তির লড়াই।
১৯৭১ সাল ছিল বাংলার মানুষের মুক্তির বছর। ৭ মার্চের ভাষণের পর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন প্রথম ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খেলার মাঠে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি স্বরূপ ডামি রাইফেল দিয়ে অস্ত্র চালানো শেখায়। বিভিন্ন শহীদদের নামে ব্রিগেড গড়ে তুলে। এসব ব্রিগেডের আওতায় সামরিক কুচকাওয়াজের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। এর আগে ফেব্রæয়ারি মাসে এক জরুরী কাউন্সিলে ঘোষণাপত্র সংশোধন করে পূর্ব-পাকিস্তান ছাত্র ইউনিয়নের বদলে নাম পাল্টে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন করা হয়। সে সময়ের কঠিন পরিস্থিতিতে এমন উদ্যোগ ছিল সময়ের সবচে সাহসী পদক্ষেপ। ২৬ মার্চের পর যখন চূড়ান্ত যুদ্ধ শুরু হয়ে যায় তখন এদেশের মুক্তির সংগ্রামে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতাকর্মীরা আবারও তাদের ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনের জন্য তাদের সবচে মূল্যবান সম্পদ নিজের জীবন বাজি ধরে গেরিলা যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পরে। মুক্তিযুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়ন-ন্যাপ-কমিউনিস্ট পার্টির গেরিলা বাহিনী ছিল সবচে বড়। যার সদস্য সংখ্যা ছিল ১০ হাজারেরও বেশি। দীর্ঘ নয় মাসের সংগ্রামে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ। কিন্তু ছাত্র ইউনিয়ন থেমে থাকেনি তার ইতিহাস অর্পিত দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ১৯৭২ সালের ২৬ এপ্রিল ছাত্র ইউনিয়নের প্রথম জাতীয় সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় সোহরাওয়ারর্দী উদ্যানে। সম্মেলনের শেষ দিন ৫০ হাজার কর্মী নিয়ে ঢাকায় র্যালী বের করা হয়। ১৯৭২ সালে স্বাধীনতার পর প্রথম ডাকসু নির্বাচনে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন জয়লাভ করে। কেবল ডাকসু নয়, পাকিস্তান আমলে এবং বাংলাদেশ স্বাধীনতা হবার পরও দেশের যে কোন কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্র সংসদ নির্বাচনে অধিকাংশ জায়গায় ছাত্র ইউনিয়ন জয় লাভ করেছে। আদর্শিক ছাত্র রাজনীতিতে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন তার জন্মলগ্ন থেকেই শিক্ষার্থীদের পছন্দের তালিকায় শীর্ষ সংগঠন।
স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন স্বাধীন দেশে সাম্রাজ্যবাদ ও মৌলবাদ বিরোধীতায় কখনও পিঁছপা হয়নি। ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ স্বরূপর ১৯৭৩ সালের ১ জানুয়ারি বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের নেতৃত্বে ডাকসুর সাথে যৌথ আয়োজনে ভিয়েতনাম সংহতি দিবস পালন উপলক্ষে মিছিল বের করে করা হয়। সেই মিছিল যখন হাইকোর্ট মোড় পাড় হয়ে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে কদম ফোয়ারর কাছে আসে তখন শান্তিপূর্ণ মিছিলের উপর পুলিশ গুলি চালায়। পুলিশের গুলিতে শহীদ হন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী মির্জা কাদেরুল ও মতিউল। স্বাধীন বাংলাদেশে সা¤্রাজ্যবাদ বিরোধী আন্দোলনের দায়ে প্রথম ছাত্র হত্যার ঘটনার কালো অধ্যায়ের সাক্ষী হয় ছাত্র ইউনিয়ন। একইভাবে শিক্ষাঙ্গনে সন্ত্রাস ও দখল দখলদারিত্বের বিরুদ্ধেও প্রাণ দেয় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের অসংখ্য নেতাকর্মী। ইতিহাসের ফিনিক্স পাখি খ্যাত শামসুর রাহমানের ‘পুরাণের পাখি’ শহীদ মঈন হোসেন রাজু ১৯৯২ সালের ১৩ই মার্চ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগ ও ছাত্রদলে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের প্রতিবাদে মিছিল করতে গিয়ে সন্ত্রাসীদের গুলিতে শহীদ হন। একইভাবে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র শিবিরের সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হন ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী সঞ্জয় তলাপাত্র।
স্বাধীন বাংলাদেশে ছাত্র ইউনিয়ন তার আদর্শকে সামনে রেখে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রথম প্রতিবাদ মিছিল করেছিল বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। স্বৈরাচার এরশাদ বিরোধী আন্দোলনেও নেতৃত্বের ভূমিকায় ছিল ছাত্র ইউনিয়ন। নব্বইয়ের দশকে কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে সন্ত্রাস-দখলদারিত্বের বিরুদ্ধে ছাত্র ইউনিয়নে প্রতিবাদ ছিল সবচে সোচ্চার। ২০০৭ সালে সেনাশাসনের বিরুদ্ধে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আন্দোলন গড়ে তুলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে ঢাকার শাহবাগ’সহ সারাদেশে গণজাগরণ মঞ্চ তৈরিতেও ছাত্র ইউনিয়ন ছিল মূল ভূমিকায়। ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপর ১০ শতাংশ ভ্যাট আরোপের বিরুদ্ধে বৃহৎ ছাত্র আন্দোলন গড়ে তুলে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন। যে আন্দোলনের চাপে সরকার ভ্যাট প্রত্যাহার করে নিতে বাধ্য হয়। ধর্ষণ ও নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে ২০১৫ সালে ‘পাল্টা আঘাত’ নামে আন্দোলন গড়ে তুলে ছাত্র ইউনিয়ন। তথা ইতিহাসের যে কোন সময়ে জাতির ক্রান্তিকালে বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন অগ্র-সেনানীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছে।
বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে সব সময়ই মানুষের পাশে থেকেছে। তারই ধারাবাহিকতায় ২০১৪ সালের দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচন ও ২০১৮ সালের একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পর বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন এদেশের মানুষে গণতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছে। সংবাদমাধ্যম ও মানুষের বাক-স্বাধীনতা হরণকারী কালা-কানুন ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ বাতিলের দাবিতেও বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন মাঠে আন্দোলন করছে। প্রগতিশীল বিভিন্ন সংগঠনগুলোকে সাথে নিয়ে বৃহৎ গণ-আন্দোলন গড়ে তোলার প্রয়াস চালিয়ে যাচ্ছে। সারাদেশে ধর্ষণ ও বিচার হীনতার বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ২০২০ সালের অক্টোবর মাসে বৃহৎ আন্দোলন গড়ে তুলে। ছাত্র ইউনিয়ন তার রাজপথের লড়াই সংগ্রামের মাধ্যমে যেমন মানুষের অধিকার, শিক্ষার অধিকার আদায়ের আন্দোলন করে আসছে তেমনি জাতীয় দুর্যোগের সময়েও অগ্রণী ভূমিকা পালন করে আসছে।
বিশ্বব্যাপী প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস ছড়িয়ে পরলে বাংলাদেশেও যখন তার প্রকোপ দেখা দেয় তখন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়ন ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েল টিএসসিতে ক্যাম্প বানিয়ে হ্যান্ড স্যানিটাইজার প্রকল্প শুরু করে। নি¤œ আয়ের মানুষের মাঝে এবং ঢাকা’সহ সারাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালের ডাক্তার, নার্স ও চিকিৎসাকর্মীদের মাঝে, মাদ্রাসায়, চা শ্রমিকাদের মাঝে ও আদিবাসীদের মাঝে তা সরবরাহ করে। একইভাবে ২০২১ সালের ৫ এপ্রিল থেকে যখন নতুন করে লকডাউন ঘোষণা করা হয় তখন ঢাকা’সহ বিভিন্ন জেলায় শ্রমজীবী ক্যান্টিন চালু করে নিম্ন আয়ের মানুষের মুখে খাবার তুলে দিতে চেষ্টার ত্রুটি করেনি।
বায়ান্নর সংগঠন বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের আগের তুলনায় জৌলুস কমেছে। পতন ও পঁচনের সমাজে সবাই যেখানে বিকিয়ে গেছে ছাত্র ইউনিয়ন এখনও তার আদর্শে অটুট থেকে শিক্ষার ও মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। পেশী শক্তি প্রদশর্নের রাজনীতিতে সংখ্যা কম হলেও মনোবলে কখনও কমেনি লড়াইয়ের গতি। প্রত্যেক নীল পতাকার সৈনিকের দৃঢ় বিশ্বাস ‘আসছে ফাল্গুনে আমরা দ্বিগুণ হব।’ তারা স্বপ্ন দেখে ‘একদিন আমাদের সব আমাদের হবে দ্রোহে আর বিপ্লবে।’ তারা শত শহীদের নামে, শহীদের রক্তের ঋণের কথা স্মরণ করে শপথ গ্রহণ করে নিজের শ্রেষ্ঠতম সম্পদ জীবনকে বাজি রেখে। জীবনের শ্রেষ্ঠতম শিক্ষালয় বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের ৭০তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকীতে নীল পতাকার সকল সাবেক ও বর্তমান কর্মীদের জানাই বিপ্লবী শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন। শহীদদের জানাই লাল সালাম।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন