আমি বাঙালি। এটা আমার কাছে গর্বের বিষয়। তবে এই চেতনায় আমার লজ্জাও আছে। কিন্তু কেন সেই লজ্জা? ঐ যে যখন আমি ইতিহাসের আলপথ ধরে খুঁজি সেই প্রশ্নের উত্তর, যেখানে বলা হয় – বাঙালি আদৌ কি কোন জাতি? ঠিক তখনই আমি ইতিহাসের চোরাবালিতে হারিয়ে যাই। কারণ, এই প্রশ্নের উত্তরসন্ধানী হয়ে আমি আরও হাজারো প্রশ্নের মুখোমুখি হই। বলা হয়, বাঙালির ভাষা প্রকৃতই কি বাংলা? সেই ভাষার গঠনবিন্যাস কোন ধরনের? বাঙালির কোন বাস্তবিক ইতিহাস আদৌ কি আছে? যদি তা থাকে, তবে সেই ইতিহাস কবে থেকে শুরু? কি তার পরিবর্তনের অভিমুখ? এই পরিবর্তনের বাঁকে বাঙালির ধর্মবোধ ঠিক কোন জায়গায় বাঙালির জাতিবোধকে জাগিয়ে তোলে?
এই সমস্ত প্রশ্ন অনেক সময়ই আমাদের মনে উঁকি দেয়। আমরা কেউ কেউ সেগুলোর উত্তর খুঁজি, খুঁজতে চাই। আবার কেউ আছেন যিনি এতো জটিল করে ভাবতে চান না। এই মিশ্র রূপ বাঙালির মজ্জাগত নৃতাত্ত্বিক চরিত্র। বাঙালির সেই নৃতাত্ত্বিক পরিচয় করিয়েছেন অতুল সুর। তিনি বলছেন বাঙলার আদিম অধিবাসীরা ছিল প্রাক্-দ্রাবিড় গোষ্ঠীর লোক। “নৃতত্ত্বের ভাষায় তাদের বলা হয় আদি-অস্ত্রাল”। আলপীয়রা ছিল বাঙলার আগন্তুক জাতি। এই দু’য়ের মিশ্রণ বাঙালি জাতির প্রাথমিক রূপ গঠন করে। এই পরিচয়ে যে “আদি অস্ট্রিক” বা “ভেড্ডিড” উপাদানের আধিক্য থাকে সেই কথা জোরের সঙ্গে বলেন সমাজতাত্ত্বিক রাধাকমল মুখোপাধ্যায়। হয়তো সেই জন্যই মার্কামারা বাঙালীর চেহারা মাঝারি গোছের। ভেড্ডিড উপাদানই বাংলার জনগঠনের প্রধান ভিত্তি। কালক্রমে নানা অবস্থায় কমবেশি ইন্দো-আর্য ও শক-পামিরীয় উপাদান এবং পূর্বে মঙ্গোলীয় প্যারোইয়ান ও মালয়-ইন্দোনেশীয় উপাদান এসে মিশেছে। বাঙালির নিজস্ব গড়ন হয়েছে পাঁচমিশালী রক্তধারায় সম্পৃক্ত।
এই জাতি সংকর পরিচয়ে বাঙালি হিসেবে কোন লজ্জা থাকার কথা নয়। সেটা নেইও। কিন্তু লজ্জা হয় যখন দেখি বাঙালি তার ইতিহাস ভুলে আত্মঘাতী হয়। সে ভুলে যায় যে প্রাচীন চর্যাগীতিতে ভুসুকুপাদের পদাবলীতে প্রথম বাঙালি শব্দের সাক্ষাৎ পাওয়া যায়। “আজি ভুসু বঙ্গালী ভইলী / নিঅ ঘরিণী চণ্ডালী লেলীয়॥” সে ভুলে যায় যে ভাষাতাত্ত্বিক বিশ্লেষণের মাধ্যমে চর্যাপদের সঙ্গে বাংলা ভাষার অনস্বীকার্য যোগসূত্র বৈজ্ঞানিক যুক্তিতে প্রতিষ্ঠিত করেন আচার্য সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায়। তর্কপ্রিয় বাঙালি সেখানেও প্রশ্ন তোলেন যে “ভুসুকু কথিত ‘বঙ্গালী’ কি আজকের বাঙালী?”
এখানেও উঠে আসে সেই পাঁচমিশালী ভৌগোলিক অঞ্চলের কথা। ইতিহাস বলে, তখনকার দিনে ‘বঙ্গাল’ বা ‘বঙ্গ’ নামে অভিহিত জনপদ আজকের বাংলা নয়। বাংলা বলতে যে দ্বিখন্ডিত সীমানাকে আমরা এখন এক করে বুঝি, তখন তার অস্তিত্ব ছিল না। এই দেশ তখন খণ্ড খণ্ডভাবে সূক্ষ্ম, রাঢ়, তাম্রলিপ্তি, বঙ্গাল, সমতট, হরিকেন, পুণ্ড্রবর্ধন (বরেন্দ্র), গৌড় (কর্ণসুবর্ণ) ইত্যাদি নামে পরিচিত ছিল। “বঙ্গাল বা বঙ্গ বলতে বর্তমানকালের ঢাকা, বিক্রমপুর, সোনারগাঁও সংলগ্ন পূর্ববঙ্গর একটা অঞ্চলকে নির্দেশ করত।” পশ্চিমবঙ্গে যাদের ‘বাঙাল’ বলা হয়, ভুসুকুপাদের ‘বঙ্গালী’ সেই বঙ্গাল জনপদের অধিবাসী ছিল। তখন সে যে ভাষা ব্যবহার করত তা বোধ হয় মাগধী অপভ্রংশ থেকে উদ্ভূত বাংলা ভাষার কোনও আঞ্চলিক প্রত্নরূপ। সে ভাষা আজকের বাংলা নয়।
আজ বাঙালি বলতে আমাদের ভাবনায় যে জাতির কথা আমরা বুঝি, সেই জাতি তখনও দানা বাঁধেনি। ভাইয়ের রক্তে রাঙানো ভাষা আন্দোলনের আগে কোন দিনই সেই ভাবনা এই গঙ্গা-মহানন্দা-ব্রহ্মপুত্রের অববাহিকা অঞ্চলে তেমনভাবে জোট বাঁধেনি। তবু আজ রাজনীতির ক্ষুদ্র স্বার্থে ভাষার পাশাপাশি ধর্মকে বাঙালির পরিচিতি সত্তার সঙ্গে জুড়ে দেওয়া হচ্ছে! বাঙালি মনন অভিযোজনের হাত ধরে যে শতবর্ষ অতিক্রম করেছিল তাকে আবার গোড়ায় নামানো হচ্ছে। ধর্মসমন্বয়ের যে আদর্শ শ্রী চৈতন্য থেকে রামকৃষ্ণ, লালন থেকে মউলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন, তাকে অস্বীকার করার রাজনৈতিক বয়ান রচনা করা হচ্ছে।
এই চক্রান্ত বুঝতে হলে আমাদের একটু সাহিত্য ও ধর্মাচারের বিষয়গুলোতে চোখ ফেরাতে হবে। বাঙালির পূর্ণাঙ্গ ইতিহাস জানতে এই অঞ্চলের ক্ষুদ্র অথবা বৃহৎ পরিসরে ঘটা বিভিন্ন ধর্মান্দোলন এবং সেই সম্পর্কিত আচার অনুষ্ঠানের ইতিবৃত্ত সম্পর্কে আমাদের অবগত হতে হবে। জনশ্রুতি অবলম্বনে নির্মিত সকল ধর্মমত সম্পর্কেও প্রচলিত থাকা বিভিন্ন অতিরঞ্জিত অলৌকিক কাহিনী অথবা মিথ্যা অপবাদকে বাস্তবের কোষ্ঠী পাথরে যাচাই করে নিতে হবে। জনসাধারণের মধ্যে প্রচারিত থাকলেই যে তা সত্য, তা ইতিহাস, সেটা ধরে নেওয়া যে একপ্রকার মুর্খামি তা মানতে হবে। যদিও এই ধরনের বিষয়গুলো সম্পর্কে প্রকৃত সত্য অবগত হওয়া খুবই দুরূহ ব্যাপার, তবুও ঘটনার স্থান-কাল বিচার করাটা প্রয়োজন হয়ে দাঁড়ায়। অনুসন্ধিৎসু জনসাধারণ ও ভক্তজনের মধ্যে প্রায়ই এ সম্পর্কে যে প্রচুর কৌতুহল লক্ষ্য করা যায়, কিন্তু তা চরিতার্থ করার উপায় সহজে মেলে না।
তাহলে সহজ উপায় কি নেই? আলবাত আছে। সাহিত্য, সমাজ, অর্থনীতি, রাজনীতি ও সংস্কৃতির নিবিড় পাঠ, এবং সেই সঙ্গে সত্যনিষ্ঠ, মোহমুক্ত মন সেই সহজ দর্শনের দিশা দেখায়। কিন্তু কীভাবে? এই প্রশ্নের উত্তরে একটা সহজ ও বাস্তব অভিজ্ঞতার কথা উদাহরণ হিসেবে বলা যেতে পারে। আমি তখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি। শরৎচন্দ্র আর বিভূতিভূষণ ছিলেন তখন আমার প্রিয় লেখক। একদিন দেখলাম ‘শ্রীকান্ত’ বলেছে, “আজ মুসলমানদের সঙ্গে বাঙালীদের খেলা।” সেদিন মুসলমান বুঝলেও বাঙালি তবে কারা সেটা বুঝতে আমার সময় লেগেছিল। স্নাতক স্তরে এসে সেটা বুঝলাম। দেখলাম সাহিত্যে এর ভুরি ভুরি উদাহরণ। ভাষাগত অমিল থাকাটাকে একটা কারণ হিসেবে দাঁড় করানো হয় ঠিকই তবে এটাও দেখেছি যে সেই ভিন্নতা না থাকলেও শতবর্ষ পূর্বের বাংলা হিন্দুকে বাঙালি, আর বাঙালিকে হিন্দু ভাবতেই অভ্যস্ত হয়েছে।
ঠিক যেমন বাঁকুড়ায় থাকার সময় অন্নদাশঙ্কর রায়কে কথাপ্রসঙ্গে সুলতানা বলেছিল যে তার সঙ্গে “বাঙালী মেয়েদের খুব ভাব।” সুলতানার এই সরল ভাবনা অন্নদাশঙ্করকে ভাবিয়েছে। তিনি ভেবে দেখেছেন যে বাঙালি হিন্দুদেরও একই অভ্যাস। বহুবার তিনি হিন্দু পরিচিতদের মুখে শুনেছেন, “আমরা বাঙালী, ওরা মুসলমান।” মনে রাখতে হবে সময়টা ছিল ১৯৩০। ঔপনিবেশিক শাসনকাল। তবে কি ভাষাগত অমিলের বাইরে এই বিদেশী শাসকের জন্যই বাংলার মুসলমান বাঙালি হয়ে উঠতে পারেনি? কোন্ পার্থক্য বোঝানোর জন্যে তারা নিজেদের মুসলমান বলেই ভাবে, বাঙালী বলে নয়?
প্রথমে আসি ভাষার প্রসঙ্গে কয়েকটি কথায়। এটা ঠিক যে বিংশ শতাব্দীর প্রথমার্ধে শিক্ষিত বাঙালি মুসলমানদের একটা অংশের মধ্যে সাধারণভাবে এই বিশ্বাস ও ধারণা ব্যাপকভাবে প্রচলিত ছিল যে মুসলমানদের বাংলা ভাষা শেখার দরকার নেই। জীবনের প্রয়োজনে, আল্লার দোয়া পেতে, বিদেশী ভাষা কিছুতেই শেখা উচিত নয়। কিন্তু আরবি ভাষা অবশ্যই শেখা চাই। আরবির সঙ্গে ফারসি কিংবা উর্দু ভাষা শেখা গেলেও বাংলা ভাষার প্রতি অনীহা তখন প্রকট হয়। বাংলা ভাষাকে অবজ্ঞা করে তখন উর্দু ভাষাকে নিজের ভাষা হিসেবে গ্রহণ করার একটা উগ্র প্রবণতা লক্ষ্য করা যায়।
প্রতিবাদে কলম যে সোচ্চার হয়নি তা নয়। বাঙালি মুসলমান সমাজের ভেতর থেকেই সেই বিরুদ্ধস্বর উঠে এসেছে। সেই সময়ে (১৯২৬ সালের দিকে) লেখা “মাতৃভাষা ও বাঙালি মুসলমান” প্রবন্ধে আবুল ফজল এমন ভাবনার বিরুদ্ধে সোচ্চার হন। ঐ প্রবন্ধে তিনি যে শুধু শ্লেষাত্মক ভাষায় সকল বিভ্রান্তির মূলে কুঠারাঘাত করেছিলেন তা নয়, বাঙালি মুসলমানদের মাতৃভাষা কী হবে সে বিষয়েও নির্দ্বিধায় সঠিক মত ব্যক্ত করেছিলেন। তিনি লিখেছিলেন, “বাঙালি মুসলমানের মাতৃভাষা কী? উর্দু না বাংলা? আমার মতে ইহাই সর্বাপেক্ষা অদ্ভুত কথা। আম গাছে আম ফলিবে না কাঁঠাল— এমন অদ্ভুত প্রশ্ন অন্য কোনো দেশে কেহ করিয়াছেন কি না জানি না।” পরে অবশ্য বাঙালি ও অবাঙালি মুসলমানের ভাষাগত প্রভেদ যে কত গভীর তা কাউকে আর বুঝিয়ে বলতে হয়নি। রক্তপাতই তা বুঝিয়ে দিয়েছে। ধর্মবোধের উর্ধে উঠেছে বাঙালির ভাষা চেতনা। বাংলার মুসলমান সমাজ সময়ের দাবি মেনে বাঙালি হয়েছে।
এইবার আসি ঔপনিবেশিক শাসন সংক্রান্ত দ্বিতীয় ভাবনা প্রসঙ্গে কয়েকটি কথায়। ইংরেজদের বিরুদ্ধে প্রধান অভিযোগ ধর্মঘটিত নয়, অর্থনীতিঘটিত। রাজনৈতিক-অর্থনীতির সমীকরণে ইংরেজ শাসনব্যবস্থাকে দেখা যেতে পারে। পর্তুগীজদের থেকে ইংরেজরা প্রথম দিকে ছিলেন কিছুটা উদার। ধর্মের পরিসরে তারা ছিলেন কিছুটা মোঘল শাসকদের মতো। পর্তুগীজরা যখন হিন্দু-মুসলমান উভয় সম্প্রদায়ের ওপর নির্বিচারে আক্রমণ হানতেন, তখন ইংরেজগণ ঐ দুই সম্প্রদায়ের দুর্বল অংশকে নিজেদের ধর্মে সামিল করতে উদ্যোগী ছিলেন। কিন্তু তারা সমৃদ্ধ ভারতকে শোষণ ক্ষেত্র করে তুলতে সেই সহনশীল ভাবকে ক্রমে হিংস্র করে তোলে। মূলত সিপাহী বিদ্রোহের পর থেকে ধর্মীয় বিভাজনের আঁচে ভারতকে তারা সেঁকে নিতে শুরু করে। ভারতকে তারা শুধু নিরস্ত্র, নিঃস্ব ও দুর্বল করেই ক্ষান্ত থাকেনি, ভারতবাসীর জনজীবনে বিভাজনের বীজ পুঁততে এবং সেই বিষবৃক্ষকে যত্নের সঙ্গে লালন করে দুর্বহ করে তোলে নাগরিক জীবন।
“তুমিও ভালো, আমিও ভালো” – ধর্ম প্রসঙ্গে এমন হিন্দু-মুসলিম বোঝাপড়াটাকে তারা ভেঙে দেয়। স্বাধীনতার প্রাক্কালে সাম্প্রদায়িক হানাহানি এবং দেশভাগে স্বাধীনতার নোনতা স্বাদ, সেই রূঢ় বাস্তবতাকেই প্রকাশ করে। বাঙালি জনমানস সেই সাম্রাজ্যবাদী কূটকৌশলের মূল্য চোকায়। কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ অনেক আগে থেকেই সেই সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে অনেকের বিরাগভাজন হয়েছিলেন। জাতীয়তাবাদের সঙ্কীর্ণ গণ্ডীর বাইরে তিনি মনটাকে নিয়ে যেতে বলেছেন। অসংখ্য কবিতা, গানে ও নাটকে তিনি এই বেপরোয়া মনোভাবের পরিচয় জনসমক্ষে দিয়েছেন। সাহিত্যেরও যে একটা বেপরোয়া ভাবের প্রয়োজন তা সেই সময় দাঁড়িয়ে তিনিই যে কীভাবে আগে বুঝলেন সেটা আজ ভাবলে অবাক হতে হয়।
বেপরোয়া মনোভাবের উত্তরাধিকারী ছাড়া বড় সাহিত্য, মহৎ সাহিত্য রচিত হতে পারে না। বাঙালি লেখকগণই তার প্রমাণ রেখেছেন। তাঁরা মানতেন যে অনুকূল পরিবেশ তেমন মনোভাবের রচনাকে জন্ম দিতে পারে যা তোষণসর্বস্ব গুণগান হয়ে প্রচার পেলেও সাহিত্য মূল্য তাতে কমই থাকে। শরৎচন্দ্র ছাড়া সেই সময়ে বইয়ের নাম চরিত্রহীন রাখা কেউ কি কল্পনা করতে পারতো? এক বিখ্যাত মাসিক পত্রিকা তো শুধু এই নামের জন্যই ওই লেখা ছাপতে অস্বীকার করেছিল। অমন বেপরোয়া ছিলেন বলেই তো তার পক্ষে “রাজলক্ষ্মী”র মত মেয়েকে, বাসার ঝি “সাবিত্রী”কে বাংলা সাহিত্যে এক অভাবিত মর্যাদাপূর্ণ স্থান দিতে সক্ষম হয়েছিলেন। বঙ্কিমচন্দ্রও কি কম বেপরোয়া ছিলেন? না হলে সেই যুগে “রোহিণী” চরিত্র আঁকা কি তাঁর পক্ষে সম্ভব হত? ভাবুন, কতখানি বেপরোয়া হতে পারলে “বিদ্রোহী”র মত কবিতা লেখা যায়? নজরুল ছাড়া “বারাঙ্গনা” নিয়ে অমন জোরালো কবিতা আর কে লিখতে পারতো? এখন তো অমন কবিতা লিখতে পারার কথা ভাবাই যায় না। এ বিষয়ে আমাদের সকলেরই যথেষ্ট সন্দেহ আছে। প্রচলিত ধারার বাইরে দাঁড়ানোর এই চেষ্টা বাঙালির মজ্জায় গ্রথিত থাকে।
এই দুই ব্যাখ্যার বাইরে তৃতীয় যে বিষয়টি বাঙালির ধর্মবোধ সম্পর্কিত আলোচনায় গুরুত্বপূর্ণ হয় তা হল এর বিকল্প নির্মাণ। বৌদ্ধ অথবা বৈষ্ণব ধর্মাচারের উদাহরণ শুধু নয়, অষ্টাদশ শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়েও আমরা দেখেছি যে তৎকালীন নদীয়া জেলার সন্নিহিত কয়েকটি অঞ্চলে তিনটি লোকায়ত ধর্মসম্প্রদায়ের উদ্ভব ঘটেছিল। সহজিয়া ধারার অনুবর্তী এই তিনটি স্বতন্ত্র লোকায়ত ধর্মসম্প্রদায়ের মধ্যে সাধনপদ্ধতি ও আচার আচরণে বেশ কিছু অমিল সত্ত্বেও সেখানে রীতিগত দিক থেকে কিছু সাদৃশ্যও বর্তমান ছিল। বাহ্যত তারা পৃথক সম্প্রদায় হলেও আন্তরধর্মে তাদের মধ্যে যে ঐক্যসূত্র বজায় ছিল তাতে এমন অনুমান মিথ্যা নয় যে তারা একই মূল প্রবাহের তিনটি ভিন্নমুখী ধারায় সচল ছিল। এই তিনটি ধারা হল, ঘোষপাড়া কেন্দ্রিক কর্তাভজা সম্প্রদায়, বৃত্তিহুদা কেন্দ্রিক সাহেবধনি সম্প্রদায় এবং কুষ্টিয়ার লালন ফকিরের সম্প্রদায়। এছাড়াও সন্নিহিত অঞ্চলের অপেক্ষাকৃত ক্ষুদ্র কিন্তু অনুরূপ মতবাদী বলরামভজা, খুশি বিশ্বাসী, ইত্যাদি সম্প্রদায়ের নামও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা যায়।
এই দৃষ্টিকোণে কালকের দোল উৎসবের কথা মাথায় রেখে “হোলি মোবারক” বলার আগে একটু ধর্মান্দোলনের সূত্রপাত ও বাঙালির জীবনাচারে চোখ ফিরিয়ে নেওয়া যেতেই পারে। কৌতুহলোদ্দীপক হয়ে বাংলার সামাজিক এবং যুগগত পটভূমি সম্পর্কে কিছু আলোচনা করে নেওয়াও খুব একটা অপ্রাসঙ্গিক হবে না বলেই আমার মনে হয়। সেই আলোচনায় উদাহরণ হিসেবে বাংলার অনতিক্ষুদ্র একটি ধর্মমত – কৰ্ত্তাভজা সম্প্রদায়ের কথা বলা যায়। শ্ৰীশ্ৰীআউলাদ প্রবর্তিত এই কৰ্ত্তাভজা সম্প্রদায়ের কথা জার্মান সমাজতাত্ত্বিক ম্যাক্স হ্বেবারও তাঁর “ভারতের ধর্ম” সম্পর্কিত গ্রন্থে আলোচনা করেছেন। এই কৰ্ত্তাভজা সম্প্রদায়ের সমাজতাত্ত্বিক মূল্যায়ন করলে দেখা যায় যে অবিভক্ত বাংলার বিপুল সংখ্যক জনসাধারণের মধ্যে এই মতাদর্শের প্রবল জনপ্রিয়তা ছিল। আউলাদ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত বলেই এই সম্প্রদায়ীদের আউল বা আউলিয়া নামেও অভিহিত করা হয়। এই সম্প্রদায়ীদের কিছু কিছু আঞ্চলিক নাম আজও পাওয়া যায়। আজও তাদের সম্মেলন ঘটে এবং এদের ঘোষপাড়া মতাবলম্বীও বলা হয়।
কৰ্ত্তাভজা সম্প্রদায়ের ধর্মাচারণ একেশ্বরবাদী। কৰ্ত্তা অর্থাৎ ঈশ্বর, আর যারা তাকে ভজনা করেন তারাই হলেন কৰ্ত্তাভজা। বীজ মন্ত্রের মূল সূত্র হল “গুরু সত্য” - “কর্তা আউলে মহাপ্রভু, আমি তোমার, তুমি আমার। তোমার মুখে চলি বলি, যা বলাও তাই বলি, যা খাওয়াও তাই খাই, তোমা ছাড়া তিলার্ধ নাই। গুরু সত্য, বিপদ মিথ্যা।” এই মন্ত্রের নাম ষোল আনা মন্ত্র। কোন ব্যক্তি এই সম্প্রদায়ভুক্ত হইতে চাইলে প্রথমেই তাকে এই “গুরু সত্য”র বীজমন্ত্র মানতে হবে। অবিভক্ত বাংলার হিন্দু এবং মুসলমানদের মধ্যে এই মতাবলম্বীদের সন্ধান মেলে। বাহ্যত তারা হিন্দু অথবা মুসলমান, কিন্তু ধর্মজীবনের সাধন পদ্ধতিতে, জীবনাচার পালনে এবং মতবিশ্বাসের ক্ষেত্রে তারা একটি বিশিষ্ট সম্প্রদায়ভুক্ত।
বাঙালি সমাজে এই রকম সম্প্রদায়ীর সংখ্যা ঠিক যে কত—সেটা কোন আদমসুমারীর রিপোর্ট দেখে সম্পূর্ণভাবে জানা সম্ভব হয় না। কারণ এই সম্প্রদায়ীরা তাদের নিজেদেরকে হিন্দু বা মুসলমান বলেই উল্লেখ করে থাকেন। তবুও যুক্তবঙ্গ থেকে বিভক্তবঙ্গে এমন সম্প্রদায়ীর সংখ্যা আজও প্রচুর রয়েছে। এরা শুধু হিন্দু-মুসলমানেই মেলেনি, সেখানে যুক্ত হয়েছে নানা উপজাতি সম্প্রদায়েরও মানুষ। বাঙালি সংস্কৃতির ধারা-উপধারাগুলি সেই সমন্বয়ের বার্তায় সম্পৃক্ত ও সমৃদ্ধ হয়েছে। মন্দিরে গো-হত্যা, কিম্বা মসজিদের সামনে বাজনা ইত্যাদি বিষয় নিয়ে আপস কোন দিনই এই সংস্কৃতি প্রশ্রয় দেয়নি। এই সাংস্কৃতিক সংঘাতের সম্ভাবনাকে বাদ দিলে আপসের মনোভাব চিরদিনই বাঙালি বজায় রেখে আসছিল। মহরম, দোল বা হোলি হিন্দু-মুসলিম নির্বিশেষে সকলেরই উৎসব হয়ে উঠেছিল। মহরম একপ্রকার বাঙালির উৎসবেই পরিণত হয়েছিল। না হলে সেখানে হিন্দুরাও লাঠি খেলত না, বাঘ নাচত না।
এহেন বাঙালির আজ হঠাৎ হল কী? অহেতুক একধরনের বাঙালি অস্মিতা তৈরীর চেষ্টা কেন করা হচ্ছে? আজ আমরা দেখছি যে “বাংলা পক্ষ” বা এই জাতীয় কিছু সংগঠন সক্রিয়ভাবে বিভিন্ন অবাঙালি অধ্যুষিত অঞ্চলে গিয়ে তাদের হেনস্থা করা থেকে শুরু করে “গুটকাখোর” ইত্যাদি অশালীন ভাষায় গালাগালি করছে। “বহিরাগত” তত্ত্ব খাড়া করে মানুষকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা হচ্ছে। কেন? যে বাঙালি জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের নেতৃত্বে থেকেও সেটার বিপদ সম্পর্কে সচেতন ছিল, সেই বাঙালি আজ আঞ্চলিকতাবাদের পৃষ্ঠপোষক? বাঙালির ধর্মবোধ, সেই সংক্রান্ত রসবোধ, আজ তাহলে কি “শমীবৃক্ষের শিকড়ে বারি সিঞ্চন” না করে সংকীর্ণ রাজনৈতিক স্বার্থ সিদ্ধির লক্ষ্যে হানাহানির বিষবৃক্ষকে ফুলে-ফলে ভরিয়ে তুলতে চাইছে? বৈচিত্র্যকে নস্যাৎ করে একমুখী হতে চাইছে?
তাই কি পিছিয়ে পড়া সকল সম্প্রদায়ের মানুষকে সরাসরি যারা জানাতে চাইছেন যে গরিবের কাছে বেঁচে থাকার লড়াইটাই হল ধর্ম, যেখানে নিজেদের অধিকারেই বাঁচতে হবে, বাঁচার কৌশল রপ্ত করতে হবে, মানুষের পরিচয়ে জীবনবোধ জাগাতে হবে, তারা হয়ে যাচ্ছেন সাম্প্রদায়িক? কেন এটা পরিকল্পিতভাবে দাগিয়ে দেওয়া হচ্ছে? শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, নিরাপত্তার সাংবিধানিক অধিকারের কথাগুলোকে কেন “টুপি চিহ্নে” নির্দিষ্ট করা হচ্ছে? দয়া ভিক্ষায় বেঁচে থাকতে তো বাঙালি কোনদিন শেখেনি। তবে কেন আজ তাকে সেই জীবনাভ্যাসে গড়ে তুলতে রাষ্ট্রযন্ত্রের ক্ষমতাকে ব্যবহার করা হচ্ছে? বাঙালির সমন্বয়ী চরিত্রকে কেন ফ্যাসিবাদী কায়দায় ভেঙে ফেলার চেষ্টা হচ্ছে? অধিকারহীন বাঁচা তো ফ্যাসিবাদের বৈশিষ্ট্য। মুসলিমাতঙ্কের নামে সংখ্যাগরিষ্ঠের সাম্প্রদায়িকতাকে তবে আড়াল করা হচ্ছে কেন? তবে কি বাঙালি তার সহনশীল ধর্মবোধকে সমকালের বিদ্বেষে রাঙিয়ে নিয়ে আত্মবিস্মৃতির ঘোরে স্বেচ্ছাচারের জীবনালাপে ফ্যাসিবাদকেই স্বাগত জানাচ্ছে?
হয়তো নয়। সেই উত্তরে নিশ্চিত হতে, জনাদেশ জানতে, আমাদের কয়েকটা দিন আরও হয়তো অপেক্ষা করতেই হবে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন