দক্ষিণ আফ্রিকার জোহানেসবার্গে ব্রিকসের ১৫তম সম্মেলনে সংস্থার সদস্যপদ পাওয়ার আবেদন করেছিল বাংলাদেশ। বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছিল, আগস্টে জোহানেসবার্গে ব্রিকসের সম্মেলনে বাংলাদেশ সংস্থাটির সদস্যপদ লাভ করতে যাচ্ছে। যদিও শেষ পর্যন্ত সদস্যপদ পায়নি দেশটি। তিন মহাদেশের ছয়টি দেশকে বিকাশমান অর্থনীতির এই জোটে যোগ দিতে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছে। দেশগুলো হলো সৌদি আরব, ইরান, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মিসর, ইথিওপিয়া ও আর্জেন্টিনা।
নতুন ছয়টি সদস্য দেশ আগামী বছরের ১ জানুয়ারি আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসে যোগ দেবে বলে ঠিক হয়েছে। ব্রাজিল, রাশিয়া, ভারত, চীন ও দক্ষিণ আফ্রিকার এই জোট মনে করেছে, তাদের সঙ্গে যোগ দেওয়ার জন্য এই মুহূর্তে ওই ছয় দেশের যোগ্যতা রয়েছে।
দক্ষিণ আফ্রিকায় অনুষ্ঠিত সম্মেলনের আগে ২২টি দেশ ব্রিকসে যোগ দিতে আবেদন জানিয়েছিল। যোগদানে আগ্রহ প্রকাশ করেছিল আরও ২০টি দেশ। আনুষ্ঠানিকভাবে আবেদন জানানো দেশের মধ্যে বাংলাদেশও ছিল। তবে বাংলাদেশ আপাতত এই জোটে সদস্য হিসেবে যোগ দিতে পারছে না।
বাংলাদেশের ব্রিকস সদস্যপদ না পাওয়া নিয়ে দেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন রকমের আলোচনা চলছে। বর্তমান ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের এক সাংগঠনিক সম্পাদক এস এম কামাল হোসেন বাংলাদেশের শীর্ষস্থানীয় এক বেসরকারি টেলিভিশনের টকশোতে দাবি করেছেন, বাংলাদেশ এবার সদস্যপদ না নেবার অবস্থান নিয়েছিল। তাই সদস্যপদ না পাওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের পক্ষ থেকে কোনো আন্তরিকতার ঘাটতি কিংবা ইচ্ছের কমতি ছিলো এমনটা নয়।
অন্যদিকে বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনামন্ত্রী এম এ মান্নান ডয়েচ ভেলে বাংলার এক টকশোতে জানিয়েছেন, বাংলাদেশ এবার ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য আবেদন করেছিল। কিন্তু কোনো কারণে হয়তো পায়নি। তবে ঠিক কী কারণে পায়নি তা তিনি উল্লেখ করেনি।
২২টি দেশ আবেদন করলেও মাত্র ৬টি দেশকে সদস্যপদ দেয়া হয়েছে। বাকি এই দেশগুলোকে আমন্ত্রণ না জানানোর কারণ সম্পর্কে এখনো পর্যন্ত সুনির্দিষ্ট করে কিছু জানা যায়নি। তবে নতুন সদস্যদের নাম ঘোষণা করে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসা বলেছেন, এমন একটি বিশ্ব যা হবে ন্যায্য, এমন একটি বিশ্ব যা হবে ন্যায়পরায়ণ, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও সমৃদ্ধিশালী, তেমন একটি বিশ্ব গড়ে তোলার চেষ্টায় ব্রিকস একটি নতুন অধ্যায় শুরু করেছে।
বাংলাদেশের সদস্যপদ না পাওয়ার সম্ভাব্য দুটি কারণ দেখছে বিশ্লেষকরা। অনেকেই বলছেন, এবার ব্রিকসের সদস্যপদ পাওয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কেবল আবেদন করা বাদে অন্য কোনো ধরনের তৎপরতা চালানো হয়নি। তথা সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সরকারেরই আগ্রহের ঘাটতি ছিল।
গত জুন মাসে ব্রিকসে যোগ দিতে বাংলাদেশের আগ্রহের কথা জানিয়েছিলেন বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ কে আব্দুল মোমেন। সে সময় জেনেভায় বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সঙ্গে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রেসিডেন্ট সিরিল রামাফোসার বৈঠকের পর মূলত বিষয়টি সামনে আসে। ওই বৈঠকের পর অর্থাৎ ১৪ জুনের পর বাংলাদেশ আনুষ্ঠানিকভাবে ব্রিকসের সদস্যপদের জন্য আবেদন করে।
কূটনৈতিক সূত্র অনুসারে, সাধারণত এ ধরনের কোনো ফোরাম বা জোটে যোগ দিতে শুধু আবেদন করে বসে থাকলেই চলে না। কারণ, এ ক্ষেত্রে সদস্য দেশগুলোকে নতুন কোনো দেশকে যুক্ত করার বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছাতে হয়। ফলে ওই সব দেশের রাষ্ট্র বা সরকার প্রধানের কাছে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে চিঠি পাঠানোর পাশাপাশি এই দেশগুলোতে বিশেষ দূত পাঠানোর মতো প্রয়াস চালাতে হয়।
কিন্তু জুনে আবেদন করা ছাড়া এসবের কিছুই বাংলাদেশ করেনি। অন্য এক সূত্রের দাবি, ব্রিকসের নতুন সদস্যপদের মানদণ্ড কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্ত ছিল অনেক দেশ। এটা জানার পর বাংলাদেশও ব্রিকসের সদস্য হওয়ার ক্ষেত্রে কিছুটা হাল ছেড়ে দিয়েছিল।
বাংলাদেশ সরকারের অনাগ্রহের কারণ সম্পর্কে বলা হচ্ছে, এমনিতেই গণতন্ত্র ও মানবাধিকার ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের চাপে রয়েছে বর্তমান সরকার। আমেরিকার ভাবছে বাংলাদেশ চীন-রাশিয়া বলয়ে ঢুকে গেছে। এমন পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ যদি ব্রিকসের সদস্যপদ পেতো তাহলে বর্তমান সরকার পশ্চিমাদের পক্ষ থেকে আরো চাপের শঙ্কা করছিল। আর এই শঙ্কা থেকেই ব্রিকসে যোগ দিতে তেমন তৎপরতা দেখায়নি বাংলাদেশ সরকার।
অন্যদিকে অনেকেই বলছে, ব্রিকসে যোগ দেয়ার জন্য বাংলাদেশ সরকারর ইচ্ছে থাকলেও ব্রিকসের নতুন সদস্য পদের মানদণ্ড কী হবে, তা নিয়ে দ্বিধাবিভক্তি ছিল। বর্তমানে বাংলাদেশের ঋণ খেলাপি অবস্থা, বৈদেশিক রিজার্ভসহ অর্থনৈতিক পরিস্থিতি তেমন ভালো নয়। ফলে ব্রিকসের সদস্য পদ পাওয়ার যে মানদণ্ড সেটা পূরণ করাও সম্ভব হবে না বলেই বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে কেবল আবেদন করা ছাড়া তেমন কোনো তৎপরতা চালানো হয়নি।
তবে এই দুটি কারণই হয়তো যৌথভাবে কাজ করেছে। গণতন্ত্র ও মানবাধিকার পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমাদের চাপের মুখে রয়েছে। মানবাধিকার ইস্যুতে বাংলাদেশের একটি আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর (র্যাব) উপরে মার্কিন নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। অন্যদিকে, সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের উপরে নতুন ভিসা নীতি আরোপ করেছে। এছাড়াও বিভিন্ন পশ্চিমা দেশ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো বাংলাদেশের আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রম নিয়ে জাতিসংঘে একাধিকবার অভিযোগ করেছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের দায়ে তারা নিষেধাজ্ঞাও চাইছে। ফলে বাংলাদেশ সরকার এখন যদি আমেরিকার বিরুদ্ধে গিয়ে চীন-রাশিয়ার কোনো জোটে যুক্ত হয় সে ক্ষেত্রে আরো চাপে পরতে পারে। তাই সরকারের পক্ষ থেকে ব্রিকসে যোগদানের বিষয়ে কোনো বাড়তি তৎপরতা চালানো হয়নি।
বাংলাদেশের বর্তমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতিও আগের যে কোনো সময়ের তুলনায় মন্দ যাচ্ছে। ব্যাংক রিজার্ভ ৪৮ বিলিয়ন ডলার থেকে কমে ২৬ বিলিয়ন ডলারে দাড়িয়েছে। তীব্র ডলার সংকটে ভুগছে দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক। ডলার সংকটের কারণে বিভিন্ন ব্যাংক আমদানি ব্যায় মেটাতে পারছে না। একদিকে ব্যাংকে ডলার সংকট অন্যদিকে দেশটিতে বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ব্যাংক ঋণ খেলাপির শিকার হয়েছে। টাকা পাচারের কারণে বেশ কয়েকটি ব্যাংক বন্ধ হয়ে যাওয়ার উপক্রমও হয়েছে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপক দুর্নীতির কারণে সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছে না। ব্রিকস জোট বাংলাদেশের এমন অর্থনৈতিক অবস্থার কথা ওয়াকিবহাল থাকার কথা।
ফলে বাংলাদেশকে ব্রিকসের সদস্য না করার ক্ষেত্রে হয়তো এসব কারণ যৌথভাবেই কাজ করে থাকতে পারে।
স্বাধীন সংবাদমাধ্যমকে বাঁচিয়ে রাখতে পিপলস রিপোর্টারের পাশে দাঁড়ান। পিপলস রিপোর্টার সাবস্ক্রাইব করতে এই লিঙ্কে ক্লিক করুন